দখলে বাইসাইকেল লেন, খবর রাখেনি ডিএনসিসি-পুলিশ

Md Jasim Uddin

০১ জুন ২০২৩, ১১:০১ এএম


বিশ্বে বাসযোগ্য শহরের তালিকায় তলানিতে আছে ঢাকা। অসুস্থ হওয়ার মতো সব উপাদান আছে ঢাকার বাতাসে। যান্ত্রিক এ শহরে একটু হলেও স্বস্তির খবর দিয়েছিল সড়কে পরীক্ষামূলক চালু করা বাইসাইকেল লেন।

উন্নত দেশগুলোর আদলে রাজধানীর আগারগাঁও ও মানিক মিয়া এভিনিউতে আলাদা বাইসাইকেল লেন তৈরি করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। কিন্তু ঘটা করে উদ্বোধন হলেও চালু করা লেন আদৌ চালু কি না, খোঁজ রাখেনি খোদ সিটি কর্পোরেশন! বাইসাইকেল লেন বলে কিছু যে ঢাকায় আছে সেটিও যেন ভুলতে বসেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ।

বাইসাইকেল লেন চালুর খবরে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন পরিবেশবাদী ও সাইক্লিস্টরা। কিন্তু অবৈধ পার্কিং বিশেষ করে সরকারি যানবাহন, অ্যাম্বুলেন্স, ভ্রাম্যমাণ দোকানে দখল হওয়া লেনে সাইকেল চালানোর কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এ কারণে সুপ্রশস্ত সড়কের কালো পিচের ওপর সাদা, হলুদ, নীল রঙের প্রলেপে ঝকঝকে-তকতকে বাইসাইকেল চিহ্ন আঁকা লেনও যেন ভুলে গেছেন সাইক্লিস্টরা।

এভাবে মোটরসাইকেল রেখে দখল করে রাখা হয়েছে বাইসাইকেল লেন। রাজধানীর আগারগাঁও এলাকা থেকে তোলা ছবি / ঢাকা পোস্ট

অথচ গত ১৯ মে সকালে জাতিসংঘ সড়ক নিরাপত্তা সপ্তাহ- ২০২৩ উপলক্ষ্যে ব্র্যাকের উদ্যোগে হাতিরঝিলের অ্যাম্ফি থিয়েটারের পাশে আয়োজিত পরিবেশবান্ধব সাইকেল র‍্যালির উদ্বোধন করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার। রাজধানীতে বাইসাইকেলের জন্য আলাদা লেন করা হয়েছে, তবে সেটি অবৈধ দখলে। ট্রাফিক পুলিশ জেনেও কেন লেন দখলে— জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঢাকায় বাইসাইকেল লেন চালু রয়েছে জানি। কিন্তু সেটি দখলে, এমন কিছু জানতে পারিনি। আপনি বলছেন, বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে দেখব।

আরও পড়ুন >> সরকারি যানের পেটে বাইসাইকেল লেন!

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, রাজধানী ঢাকায় বাইসাইকেল চলাচল উৎসাহিত করতে আগারগাঁওয়ে প্রায় নয় কিলোমিটার সড়কে আলাদা লেন তৈরি করা হয়। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে আলাদা সাইকেল লেন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই। ২০২০ সালের মার্চে আগারগাঁওয়ে অবস্থিত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উত্তরপ্রান্ত থেকে এলজিইডি সড়ক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ভবন পর্যন্ত চালু করা হয় আলাদা লেন।

উন্নত দেশগুলোর আদলে রাজধানীর আগারগাঁও ও মানিক মিয়া এভিনিউতে আলাদা বাইসাইকেল লেন তৈরি করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। কিন্তু ঘটা করে উদ্বোধন হলেও চালু করা লেন আদৌ চালু কি না, খোঁজ রাখেনি খোদ সিটি কর্পোরেশন! বাইসাইকেল লেন বলে কিছু যে ঢাকায় আছে সেটিও যেন ভুলতে বসেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ

ওই সময় ডিএনসিসি কর্মকর্তারা জানান, সাইকেলের জন্য ছয় ফুট প্রশস্ত আলাদা লেন চালুর মধ্য দিয়ে বদলে যাবে আগারগাঁও এলাকার চিত্র। মডেল সড়ক হিসেবে সাইকেল লেন তৈরির পাশাপাশি ফুটপাত, অনস্ট্রিট পার্কিং ও সবুজায়নে আগারগাঁও হবে মডেল এলাকা।

অথচ মডেল এলাকা কেবল কাগজে-কলমেই থেকে যায়। দখলে চলে যায় সাইকেল লেন। ফলে আগের মতো ঝুঁকি নিয়ে মূল সড়কে চলাচল করতে হয় সাইকেলচালকদের।

সরেজমিনে রাজধানীর আগারগাঁও ৬০ ফিট রোডের মাথা থেকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালের সামনে দিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর, নির্বাচন কমিশন ভবনের সামনে দিয়ে এলজিইডি সড়ক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন পর্যন্ত চালু করা বাইসাইকেল লেন বলতে যেন কিছুই অবশিষ্ট নেই। পুরোটাই চলে গেছে দখলে।

আগারগাঁওয়ের পিকেএসএফ ভবনের সামনের সড়ক। ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিং করে রাখা হয়েছে বাইসাইকেল লেনের ওপর / ছবি- ঢাকা পোস্ট

সরকারি যানবাহন, ব্যক্তিগত গাড়ি, স্টাফ বাস, লেগুনা, অ্যাম্বুলেন্স, চায়ের দোকান, রিকশার গ্যারেজ, ভ্রাম্যমাণ দোকান, এমনকি অবৈধভাবে লেনের ওপরই গড়ে তোলা হয়েছে ঔষধের দোকান। সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের সামনের সড়কের বাইসাইকেল লেনের স্থান ঢেকে রেখেছে সারি সারি যানবাহন। খালি চোখে বোঝার উপায় নেই যে তিন বছর আগে এখানে চালু করা হয়েছিল বাইসাইকেল লেন।

পরমাণু শক্তি কমিশনের সামনের সড়কের সাইকেল লেন দখল করে পার্কিং করা একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টাফবাসের চালকের কাছে বাইসাইকেল লেন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘এখানে লেন কই! কখনও তো শুনিনি, আলাদা লেন আছে নাকি? এখানে তো বড় গাড়িই রাখতে দেখি।’

নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের সামনের সড়কের বাইসাইকেল লেনে কি সাইকেল থাকবে? সেখানে লেগুনা, হাসপাতালের চিকিৎসক ও রোগীর স্বজনদের ব্যক্তিগত গাড়ির সারি, অ্যাম্বুলেন্স তো আছেই। ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিং করার সময় জানতে চাওয়া হলে চালক মিন্টু হোসেন বলেন, ‘এখানে তো প্রতিদিনই আসি। কখনও ট্রাফিক পুলিশ কিছু বলেনি। আর এখানে না দাঁড়ালে ডাক্তার সাব নামবে কী করে! শুধু আমি কেন, সাইকেল ছাড়া এখানে সবই আছে!’

পরিবেশ অধিদপ্তর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, নির্বাচন কমিশন ভবন, এনজিও ব্যুরো, পিকেএসএফ কার্যালয়সহ পুরো আগারগাঁওজুড়ে যেন যানবাহন আর দোকানের রাজত্ব। তবে, একটু হলেও বাইসাইকেল লেনের টিকি খুঁজে পাওয়া গেছে মানিক মিয়া এভিনিউতে। সেখানে চালু হওয়া এক কিলোমিটার লেনের ওপরে দেখা গেছে সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিগত বিভিন্ন গাড়ি। ভ্যান-রিকশাও পার্কিং অবস্থায় দেখা যায়।

আরও পড়ুন >> বহির্বিশ্বের সুনাম অর্জন করছে পটুয়াখালীর সেই দৃষ্টিনন্দন সড়ক

রাজধানী ঢাকায় বাইসাইকেল চলাচল উৎসাহিত করতে আগারগাঁওয়ে প্রায় নয় কিলোমিটার সড়কে আলাদা লেন তৈরি করা হয় / ছবি- ঢাকা পোস্ট
সরকারি যানবাহন, ব্যক্তিগত গাড়ি, স্টাফবাস, লেগুনা, অ্যাম্বুলেন্স, চায়ের দোকান, রিকশার গ্যারেজ, ভ্রাম্যমাণ দোকান, এমনকি অবৈধভাবে লেনের ওপরই গড়ে তোলা হয়েছে ঔষধের দোকান। সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের সামনের সড়কের বাইসাইকেল লেনের স্থান ঢেকে রেখেছে সারি সারি যানবাহন। খালি চোখে বোঝার উপায় নেই যে তিন বছর আগে এখানে চালু করা হয়েছিল বাইসাইকেল লেন

ঢাকায় দুটি বাইসাইকেল লেন রয়েছে। কিন্তু অবৈধ দখল আর পার্কিংয়ের কারণে লেন দুটি অকেজো অবস্থায় রয়েছে। পুলিশ কি জানে না, খোঁজ রাখে না— জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মো. মুনিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘লেনটা কারা করেছে? সিটি কর্পোরেশন তো জানাবে বাইসাইকেল লেন চালু আছে। তাহলে তো আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি।’

সরকারি যানবাহন, অ্যাম্বুলেন্স, ভ্রাম্যমাণ দোকানে দখল হওয়া লেনে সাইকেল চালানোর কোনও সুযোগ রাখা হয়নি / ছবি- ঢাকা পোস্ট

ট্রাফিক পুলিশ জানে না, ব্যাপারটা সেরকম নয়। ঘটা করেই উদ্বোধন করা হয়েছিল। তাহলে লেন কেন দখলে থাকে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আনুষ্ঠানিকভাবে সিটি কর্পোরেশন আমাদের কিছু জানায়নি। অনস্ট্রিট পার্কিংয়ের অনুমতি দেয় সিটি কর্পোরেশন। আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানি না। সিটি কর্পোরেশন জানালে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারব।’

জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) মো. সেলিম রেজা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সেখানে চটপটির দোকান বসে, বিভিন্ন যানবাহন অবৈধভাবে পার্কিং করে। আমরা মাঝেমধ্যে সেখানে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করি।’

আরও পড়ুন >> দৃষ্টিনন্দন গ্রাফিতি আর্ট পোস্টার বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করবে

পুলিশ জানেই না রাজধানীতে বাইসাইকেল লেন আছে। এ বিষয়ে সেলিম রেজা বলেন, ‘আসলে এটা রক্ষার দায়িত্ব সবার। আমরা ঘটা করে এর উদ্বোধন করেছিলাম। ট্রাফিক পুলিশও সেসময় উপস্থিত ছিল। তাদের না জানার কারণ নেই। আমরা শিগগিরই সেখানে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করব।’

কথা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক এবং ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খানের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘টাকা খরচ করে প্রকল্প করলাম কিন্তু দেখভাল করলাম না, সেটি তো কার্যকর হবে না। শুধু লোক দেখানো কাজ কখনও সুফল বয়ে আনে না।’

সিটি কর্পোরেশন জানালে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারব— বলছে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ / ছবি- ঢাকা পোস্ট

‘নগরীকে দূষণমুক্ত করার ক্ষেত্রে বাইসাইকেল চলাচলে বেশি বেশি উৎসাহ দেওয়া দরকার। আমরা সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারের সড়ক বিভাগের কাছে বাইসাইকেল লেন রাখার দাবি জানিয়ে আসছি। অন্তত ঢাকার রাস্তায় বাইসাইকেল লেন যেন রাখা হয়। অথচ পাইলট প্রকল্পেই নজরদারি নাই।’

সিটি কর্পোরেশনের উচিত এ বিষয়ে টেকসই ও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া। যারা দখল করছেন, অবৈধ পার্কিং করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু আমরা সেটি দেখছি না। মনে হচ্ছে সব লোক দেখানো— বলেন ড. আদিল মুহাম্মদ খান।

বিডি সাইক্লিস্ট-এর ভলান্টিয়ার মাহমুদ হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাইসাইকেল যেন বাড়ে সরকার সে ধরনের উদ্যোগের কথাই বলছে। ফুটপাত দিয়ে লাখ লাখ মানুষ হাঁটাচলা করে। সে ফুটপাতও দখলে। সেখানে বাইসাইকেল লেন করে তা মনিটরিং না করলে দখল হবারই কথা। দখলমুক্ত রাখতে না পারলে লেন করে কী লাভ! আগে ফুটপাত দখলমুক্ত করতে হবে, পাশাপাশি বাইসাইকেল লেনও সচল রাখতে হবে। এ বিষয়ে ট্রাফিক পুলিশ, সিটি কর্পোরেশন ও রাজউককে নজর দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।

জেইউ/এমএআর/ওএফ

Link copied