রোজিনার বিরুদ্ধে মামলা : ‘আইনের অপপ্রয়োগ’ বললেন আইনজ্ঞরা
তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে হেনস্তা, পরে মামলার শিকার হয়ে কারাগারে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম। তার বিরুদ্ধে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া ১৯২৩ সালের ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’-এর ৩ ও ৫ ধারায় ‘গুপ্তচরবৃত্তি ও রাষ্ট্রীয় গোপন নথি নিজের দখলে রাখার’ অভিযোগও আনা হয়েছে।
এ ঘটনার কঠোর সমালোচনা করেছেন দেশের বিশিষ্ট আইনজীবীরা। তারা বলছেন, এটা ‘আইনের অপপ্রয়োগ’ এবং ‘সংবিধান পরিপন্থী’।
দেশের প্রখ্যাত ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক বিচারপতি মনসুরুল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের সঙ্গে যা ঘটেছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। সাংবাদিকদের সঙ্গে এমন আচরণ সমীচীন হয়নি। অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের যে ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে, দেখতে হবে সেই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কি না। আসলে এটা তো প্রিম্যাচিউর (অকালপক্ক) আইডিয়া। আমি মনে করি, তার (রোজিনা ইসলাম) বিরুদ্ধে তো সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নাই। কোনো তথ্য তো সে ফাঁস করেনি। তথ্য আহরণের চেষ্টা করেছে মাত্র।’
‘এ ধরনের আইন দ্বারা রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়াটা সঠিক হয়নি। যে অপরাধটা সংঘটিত হয়নি সেই অপরাধে তাকে আসামি করা সঙ্গত বলে আমি মনে করি না। সে হয়ত তথ্য আহরণের চেষ্টা করেছে। এটা সাংবাদিকরা করতেই পারে। তথ্য আহরণ সাংবাদিকদের অধিকার। অফিসিয়াল সিক্রেসি মেইনটেইন (সরকারি গোপনীয়তা রক্ষণাবেক্ষণ) করবেন তো কর্মকর্তারা।’
ব্রিটিশ আমলের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ধারায় রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, “ব্রিটিশরা তাদের উপনিবেশ টিকিয়ে রাখার জন্য ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’-এর মতো অনেক আইন করেছিল। কারণ, তাদের গোপনীয়তা রক্ষার বিষয় ছিল। হঠাৎ করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এ আইনের ব্যবহার, আমি বলব এটা আইনের অপপ্রয়োগ মাত্র। আইনগতভাবে এ আইন প্রয়োগের কোনো সুযোগ নাই।”
মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসেবে যে বিষয়গুলো নিশ্চিত করা হয়েছে তার মধ্যে মত প্রকাশ বা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতাও রয়েছে। কিন্তু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলেও কিছু কিছু আইন রয়ে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের বিষয়টিও জড়িত। বিশেষ করে, দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য তথ্য বের করা এখন রাষ্ট্রের জন্য, জনগণের জন্য খুবই প্রয়োজন। এ অবস্থায় এসব আইন দিয়ে সাংবাদিক, সংবাদ মাধ্যমকে কোণঠাসার যে চেষ্টা, তা আমাদের সংবিধানের পরিপন্থী।
বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক ভার্চুয়ালি এক আলোচনায় বলেন, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ব্যবহার খুবই ন্যক্কারজনক। যেখানে গণতন্ত্র নাই বা থাকে না সেসব জায়গায় ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা দিয়ে মানুষকে শায়েস্তা করা হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির ঢাকা পোস্টকে বলেন, সংবিধান ও দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সাংবাদিক রোজিনা Investigative Journalism (অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা) এর উদ্দেশ্যে তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। তথ্য পাচার বা Spying (গুপ্তচরবৃত্তি) করা এক বিষয় আর Investigative Journalism করা ভিন্ন বিষয়। এ দুটোকে গুলিয়ে ফেললে মারাত্মক ভুল হবে।
ফৌজদারি এ আইন বিশেষজ্ঞ বলেন, “সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৯ অনুযায়ী, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতা’ নিশ্চিত করা (Guaranteed) হয়েছে। অনুচ্ছেদটি দুই ভাগে বিভক্ত। উপ-অনুচ্ছেদ ১-এ বলা আছে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল।’ উপ-অনুচ্ছেদ- ২ অনুযায়ী কিছু বাধা-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। যথা : রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতা, আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনের প্ররোচনা। অর্থাৎ, সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা (Wide Term) মৌলিক অধিকার। প্রশ্ন হলো, Investigative Journalism বন্ধ হলে বা কার্যকর না থাকলে সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ কি জীবিত থাকবে? উত্তর হলো, ‘না’। সেজন্য Investigative Journalism-ই অনুচ্ছেদ ৩৯ কে লাইভ (বাঁচিয়ে) রাখে। মৌলিক অধিকার জীবন্ত রাখতে হলে Investigative Journalism বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। এতে যদি কারো অসুবিধা হয় তা একান্তই ওই ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা দলের; সংবিধানের কোনো সমস্যা নেই। আইনের কোনো সমস্যা নেই।”
সুপ্রিম কোর্টের অপর আইনজীবী তানজিম আল ইসলাম বলেন, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন- ২০১১ এর সঙ্গে ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ সরাসরি সাংঘর্ষিক। কারণ, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ আইনের ৪, ৫ ও ১৪ ধারায় তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। এমনকি তথ্য প্রকাশকারীকে পুরস্কৃত করার কথাও বলা হয়েছে।
‘এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এরকম সাংঘর্ষিক বিদ্যমান দুটি আইনের মাঝে কোনটা প্রাধান্য পাবে। সে হিসেবে আমি বলব, সাংঘর্ষিক দুটি আইনের মধ্যে যে আইনটি নতুন অর্থাৎ তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন- ২০১১ প্রাধান্য পাবে’— বলেন এ আইনজ্ঞ।
কবে থেকে ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ১৯২৩ সালের ২ এপ্রিল ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ আইনটি প্রণয়ন করা হয়। লর্ড কার্জন যখন ভাইসরয় ছিলেন, তখনই আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ৩০ জুন প্রণীত ‘দ্য বাংলাদেশ ল’জ (রিভিশন অ্যান্ড ডিক্লারেশন) অ্যাক্ট – এর দ্বিতীয় তফসিলে দুটি শব্দ পরিবর্তন করে সরকারি গোপনীয়তা সংক্রান্ত ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ আইনটি আত্মীকরণ করে বাংলাদেশ।
আইনটির সংজ্ঞায় সরকারি জায়গা, যোগাযোগের মাধ্যম, নিষিদ্ধ এলাকা ইত্যাদি কতগুলো বিষয় সংজ্ঞায়িত করে বিধি-নিষেধ-শাস্তি আরোপ করা হয়। আইনে ‘সরকারি জায়গা’ বলতে সরকারের যেকোনো বিভাগ কর্তৃক দখলকৃত জায়গাকে বোঝানো হয়েছে, যা ওই বিভাগে ন্যস্ত করা হোক বা না হোক।
‘যোগাযোগ বা যোগাযোগের মাধ্যম’ বলতে কোনো স্ক্যাচ, প্ল্যান, মডেল, ডকুমেন্ট, আর্টিকেল, তথ্য বা এসবের আংশিক বা সম্পূর্ণ বর্ণনা বা ফলাফল দ্বারা যোগাযোগ করাকে বোঝানো হয়েছে। আর ‘নিষিদ্ধ এলাকা’ বলতে সরকার গেজেট জারি করে যে জায়গা বা এলাকাকে নিষিদ্ধ করেছে, সে জায়গা বা এলাকাকে বোঝানো হয়েছে।
কী অপরাধে কী শাস্তি
আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ স্থানে যদি কেউ যায় বা যেতে উদ্যত হয় কিংবা ওই স্থানের কোনো নকশা বা স্কেচ তৈরি করে বা কোনো গোপন তথ্য সংগ্রহ বা প্রকাশ করে তবে সে অপরাধী হবে। ৩ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ স্থানের কোনো ফটো, স্কেচ বা নকশা কেউ প্রকাশ করতে পারবে না।
৪ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো বিদেশি এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে খবর সংগ্রহ করা যাবে না। আবার এ আইনের ৩ (১)ধারায় গুপ্তচরবৃত্তির শাস্তির কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা অথবা স্বার্থের পরিপন্থী কোনো উদ্দেশ্যে নিষিদ্ধ এলাকায় গমন করে, শত্রু পক্ষের উপকারে আসার মতো কোনো স্কেচ, প্ল্যান, মডেল অথবা নোট তৈরি করে কিংবা কোনো অফিসিয়াল গোপন কোড অথবা পাসওয়ার্ড অথবা নোট অথবা অন্য কোনো দলিলপত্র অথবা তথ্য আহরণ করে, রেকর্ড করে, প্রকাশ করে অথবা অন্য কোনো ব্যক্তির কাছে পাচার করে, তবে সে এ ধারার অপরাধে অপরাধী হবে।
৩ (২) ধারায় রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্বার্থের পরিপন্থীমূলক কাজ এবং ৩ (৩) (ক) ধারায় অপরাধটি বিদেশি শক্তির স্বার্থে বা প্রয়োজনে করা হয়েছে বলে ধারণা করা গেলে বা প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড বা ১৪ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে তিন অনধিক তিন বছর কারাদণ্ডের বিধান আছে।
আইনের ৫ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো নিষিদ্ধ এলাকা ও সরকার ঘোষিত কোনো এলাকা সম্পর্কীয় কোনো গোপনীয় অফিসিয়াল কোড বা পাসওয়ার্ড বা কোনো স্কেচ, প্ল্যান, মডেল, আর্টিকেল, নোট, দলিলপত্র অথবা তথ্য কোনো ব্যক্তি আইনসঙ্গত দখলে বা নিয়ন্ত্রণে রেখেও যদি যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন না করে, যদি অন্য কোনো ব্যক্তির নিকট হস্তান্তর করে, তার নিয়ন্ত্রণাধীন তথ্যাদি অন্য কোনো বিদেশি রাষ্ট্র ব্যবহার করে, তাতে সেই ব্যক্তি অপরাধী হবে।
৫ (ক) উপধারা অনুযায়ী, কোনো প্রতিরক্ষা নির্মাণকাজ, অস্ত্রাগার, নৌ, স্থল বা বিমান বাহিনীর স্থাপনা বা স্টেশন বা খনি, মাইনক্ষেত্র, কারখানা, ডকইয়ার্ড, ক্যাম্প বা বিমান বা গোপনীয় অফিসিয়াল কোড সংক্রান্ত অপরাধে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা ১৪ বছর কারাদণ্ড। অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে দুই বছর কারাদণ্ড।
এমএইচডি/এমএআর/