ইসির নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী সবাই ‘অটোপাস’

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাড়ে চারশ’র বেশি ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে নিয়োগ দেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ইসি ছেড়ে স্বরাষ্ট্রের জননিরাপত্তা বিভাগে যাওয়ার আগেই এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন সাবেক সচিব জাহাংগীর আলম। এই নিয়োগে নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা সবাইকে পাস করানো হয়েছে এবং ৭৪৭ জন পরীক্ষা না দিয়েও পাস করেছেন।
ইসির এ নিয়োগ পরীক্ষায় মোট আবেদনকারীর মধ্যে মাত্র ১৩ শতাংশ উপস্থিত ছিলেন। যাদের মধ্যে সবাই পাস করেন। তারাসহ পরীক্ষা না দিয়ে পাস করা ৭৪৭ জন লিখিত পরীক্ষায় বসবেন আগামী ৩১ জানুয়ারি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ডাটা এন্ট্রি অপারেটরের ৪৬৮টি পদে জনবল নিয়োগের লক্ষ্যে ২০১৯ সালের ২০ মে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ইসি। এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে মোট এক লাখ ৩৮ হাজার ৮৯৪ জন চাকরিপ্রত্যাশী আবেদন করেন। কিন্তু আইডিইএ প্রকল্পের আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্ত ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের মামলাজনিত কারণে দীর্ঘদিন এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিষয়ে কার্যক্রম গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
এরপর ২০২৩ সালের ১৬ জুন আবেদনকারীদের নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন ১৮ হাজার ৮১৫ জন। পরবর্তী সময়ে আদালতের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আইডিইএ প্রকল্পের আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্ত ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের মধ্যে ৭৪৭ জন এবং নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ১৮ হাজার ৮১৫ জনসহ মোট ১৯ হাজার ৫৬২ জনকে লিখিত পরীক্ষার জন্য মনোনীত করা হয়। প্রথমে ২০২৪ সালের ১৭ জুন লিখিত পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু সেসময় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন চলমান থাকায় আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্তদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সেই পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। আগামী ৩১ জানুয়ারি স্থগিত থাকা এই পরীক্ষা নিতে ইসির জনবল ব্যবস্থাপনা শাখার উপসচিব খোরশেদ আলম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছেন।
আরও পড়ুন
নিয়োগ প্রক্রিয়া ও পরীক্ষাকে ত্রুটিপূর্ণ দাবি করে সংশ্লিষ্টরা জানান, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগসহ মাঠপর্যায়ের সব অফিস আইডিইএ-২ প্রকল্পের জনবল দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এ প্রকল্পে কর্মরত ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদটির প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন এ পদগুলো রাজস্বখাতে স্থানান্তরের লক্ষ্যে পদ সৃজনের জন্য সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে চিঠি প্রেরণ করেন। সংস্থাপন ও অর্থ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের মাঠপর্যায়ের থানা বা উপজেলা নির্বাচন অফিসের জন্য চাহিত দুটি পদের বিপরীতে একটি পদ সৃজন করে। যার ফলশ্রুতিতে ২০১৮ সালে ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের ৫১৭ পদ সৃজন হয়।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন আইডিইএ প্রকল্পে কর্মরত ডাটা এন্ট্রি অপারেটদের কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ না করে ২০১৯ সালে এ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এতে আইডিইএ প্রকল্পে কর্মরত ডাটা এন্ট্রি অপারেটররা ক্ষুব্ধ হয়ে হাইকোর্টে রিট দাখিল করেন এবং ২০২২ সালে হাইকোর্ট তাদের বয়স শিথিল করে এ নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার আদেশ দেন। পরবর্তী সময়ে নির্বাচন কমিশন এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। কিন্তু আপিল শুনানি শেষেও রায় বহাল থাকে। এরপর বাধে বিপত্তি। কারণ, ততদিনে কমিশন ২০১৯ সালে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির আলোকে আবেদনকারীদের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নিয়ে নেয়।
ইসি সূত্রে জানা যায়, এ নিয়োগে মোট আবেদনকারী ছিল এক লাখ ৩৮ হাজার ৮৯৪ জন এবং পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ১৮ হাজার ৮১৫ জন। কিন্তু আপিলের রায় প্রকাশের পর রিটে অংশগ্রহণকারী ৭৪৭ জনকে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করা সত্ত্বেও উত্তীর্ণ দেখিয়ে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ১৮ হাজার ৮১৫ জন এবং ৭৪৭ জনসহ মোট ১৯ হাজার ৫৬২ জনকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ দেখিয়ে ফলাফল প্রকাশ করে ইসি।
অভিযোগ উঠেছে, পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী সবাইকে এখানে পাস দেখানো হয়েছে এবং কমিশনে কর্মরত ডাটা এন্ট্রি অপারেটররা পরীক্ষা না দেওয়া সত্ত্বেও উত্তীর্ণ হয়েছেন। এছাড়া প্রকল্পে তৎকালীন ১১৩০ জন ডাটা এন্ট্রি অপারেটর কর্মরত থাকলেও কর্তৃপক্ষের হুমকির কারণে সবাই রিটে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। একই পদে কর্মরত থেকেও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকায় তাদেরই একটা অংশ আবার বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।
একাধিক সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন কমিশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্যের লক্ষ্যে আগারগাঁওয়ের তালতলায় অবৈধভাবে কোচিং সেন্টার, মেস ব্যবসা পরিচালনা ও শিক্ষকতা করেন। তারা আবেদনকারীদের কাছ থেকে অগ্রিম কোটি-কোটি টাকা নিয়েছেন এবং কোচিং সেন্টারের কিছু ছাত্র এনে কৃত্রিম আন্দোলন করিয়ে নির্বাচন কমিশনে চাপ প্রয়োগ করেন। অবৈধ চাকরি বাণিজ্যের মাধ্যমে নামে-বেনামে গাড়িসহ ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট বা প্লটও করেন অনেকেই।
কী বলছেন কমিশনের কর্মকর্তারা
নির্বাচন কমিশনের জনবল ব্যবস্থাপনা শাখার উপসচিব খোরশেদ আলম বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন ২০১৯ সালে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়। কিন্তু আইডিইএ প্রকল্পের আউটসোর্সিয়ের জনবলের রিটের কারণে নিয়োগ পরীক্ষা সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আদালতের রায়ে ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
প্রিলি. পরীক্ষায় সবাই পাস করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের সরাসরি লিখিত পরীক্ষা হয় এবং পরবর্তী সময়ে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু আবেদনকারীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় আমাদের নিয়োগ কমিটির সিদ্ধান্তের আলোকে লিখিত পরীক্ষার আগে প্রিলি অথবা নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। এই নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা সবাইকে লিখিত পরীক্ষার সুযোগ দিয়ে ফলাফল প্রকাশ করা হয়।’
নিয়োগ বিধিমালার বাইরে গিয়ে নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের পাস করানো হয়নি বলে জানান এই কর্মকর্তা।
বিধিমালার বাইরে গিয়ে পরীক্ষা নেওয়ার সুযোগ আছে কি না— জানতে চাইলে উপসচিব খোরশেদ আলম বলেন, ‘নিয়োগ কমিটি চাইলে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কারণ, নিয়োগ প্রক্রিয়া কেমন হবে সেটার দায়িত্ব শুধু কমিটির।’
আরও পড়ুন
নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষায় সবার পাস করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই বিজ্ঞপ্তিতে এক লাখ ৩৮ হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়ে। এতো বেশি আবেদন জমা পড়ার কারণে নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মাত্র ১৮ হাজার ৮১৫ জন। এজন্য নিয়োগবিধি অনুযায়ী সরাসরি তাদের লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়।’
আইডিইএ প্রকল্পের ডাটা এন্ট্রি অপারেটররা নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা না দিয়ে কীভাবে পাস করলো— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আইডিইএ প্রকল্পের ৭৪৭ জনকে আদালতের আদেশে লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আদালত তাদের আবেদন করার সুযোগ দিতে বলেছিল। পরে তাদের নৈর্ব্যক্তিক ছাড়াই সরাসরি লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।’
নির্বাচন কমিশনের প্রশাসন ও অর্থ শাখার যুগ্মসচিব মো. মঈন উদ্দীন খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এই নিয়োগ নিয়ে যা হয়েছে তা বিধিবিধানের আলোকেই হয়েছে। আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কিছু করা হয়নি। আর আইডিইএ প্রকল্পের আউটসোর্সিয়ের ডাটা এন্ট্রি অপারেটরদের বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা মানা হয়েছে।’
নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষায় সবাই কীভাবে পাস করল— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটার বিষয়ে আমি ফাইল না দেখে কিছু বলতে পারব না। এখানে নিশ্চয়ই কোনো বিষয় আছে। তবে নিয়োগবিধির বাইরে গিয়ে কমিটি কিছু করতে পারে না। আইনের বাইরে কমিটি কিছু করতে গেলে সেটা বাতিল হয়ে যায়।’
তাহলে নিয়োগ বিধির বাইরে গিয়ে নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা কীভাবে নেওয়া হলো— এমন প্রশ্নেও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। বলেন, ‘কোনো না কোনো জায়গায় নিশ্চয়ই বৈধতা আছে। আমার অথরিটি থাকলে আমি লাইন বাই লাইন আপনাকে দেখাতে পারতাম।’
নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব কে, এম, আলী নেওয়াজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষায় তো ফেল নাই এটা এলিমিনেশন করার বিষয়। যখন অনেক পরীক্ষার্থী থাকে এবং এটা ম্যানেজ করা ডিফিকাল্ট হয়ে যাবে, তখন তাদেরকে ধাপে ধাপে পরীক্ষা দিয়ে স্ক্রিনিং করা হয়। এখন যদি দেখি আমাদের ধারণার তুলনায় কম পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে তখন আমরা সবাইকে সমান সুযোগ দেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখনও তো কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। আমাদের ভুল হতে পারে কিন্তু আমরা আল্টিমেট নিয়োগে বিধিমালার বাইরে যেতে পারব না।’
নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিতে স্মারকলিপি
গত ১৯ জানুয়ারি এই নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করতে নির্বাচন কমিশন সচিবকে স্মারকলিপি দেয় আইডিইএ-২ প্রকল্প কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ।
স্মারকলিপিতে তারা উল্লেখ করেন, ‘সাবেক ইসি সচিব শফিউল আজিম জানিয়েছিলেন— আইডিইএ (২য় পর্যায়) প্রকল্পের জনবলের চাকুরির নিশ্চয়তা না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনে নতুন কোনো নিয়োগ প্রদান করা হবে না এবং ৪৬৮ জন ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে চলমান নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করা হবে। একই সঙ্গে আইডিইএ প্রকল্পের জনবল আত্মীকরণের লক্ষ্যে তৎকালীন সচিবের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পের জনবলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ সংক্রান্ত একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি জনবলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের লক্ষ্যে একটি সুপারিশমালা প্রস্তুত করে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব বরাবর প্রেরণ করেন।’
স্মারকলিপিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘আইডিইএ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে কর্মরত দক্ষ, অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত জনবলকে রাজস্বকরণ করা এবং রাজস্বকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার আগে আগামী ৩১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের ২০১৯ সালের ২০ মে প্রকাশিত ৪৬৮ জন ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে চলমান নিয়োগ কার্যক্রম বাতিল এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয় কর্তৃক ২০২৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত বিভিন্ন পদে ৩৬৯ জন জনবলের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি স্থগিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।’
এসআর/এমজে/এআইএস