মতপার্থক্যে আটকা ড্যাপ

এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব বিন্যাস, নগরজীবন রেখা, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন, নাগরিক সুযোগ-সুবিধার মানদণ্ড প্রণয়ন, ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন ও উন্নয়ন স্বত্ব বিনিময়— সবমিলিয়ে রাজধানী ঢাকার সমস্যাগুলো কমিয়ে পরিকল্পিত শহর গড়ার লক্ষ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ২০২২ সালে। বর্তমানে এটির সংশোধন নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। ফলে আটকে আছে ড্যাপের সংশোধন এবং এর বাস্তবায়ন।
ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বেশকিছু শর্ত শিথিল করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রণীত ডিটেল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) সংশোধনীর দাবি ওঠে আবাসন ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে। সংশোধিত ড্যাপে সরকারি-বেসরকারি আবাসন, ব্লকভিত্তিক আবাসন, একীভূত প্লটের মালিকদের কিছুটা ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। ফলে আগের চেয়ে ভবনের প্রশস্ততা ও উচ্চতা বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, নগরপরিকল্পনাবিদেরা বলছেন, আবাসন ব্যবসায়ীদের স্বার্থে ড্যাপ এভাবে সংশোধন করা যাবে না। এতে নগরীর বাসযোগ্যতা হারাবে। এছাড়া অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়সঙ্গত শহর গড়ে তুলতে বর্তমান ড্যাপের বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি বলেও উল্লেখ করছেন নগরপরিকল্পনাবিদেরা।
তারা বলছেন, নানামুখী চাপে রাজউক আবাসন ব্যবসায়ীদের দাবির পক্ষে অবস্থান নিয়ে ড্যাপ সংশোধন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। যেখানে তাদের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে। তাদের যৌক্তিক পরামর্শ উপেক্ষা করে বা তাদেরকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র আবাসন ব্যবসায়ীদের ব্যবসাকে প্রাধান্য দেওয়ার জন্য ড্যাপের সংশোধন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ড্যাপে জনঘনত্ব ও অন্যান্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে ভবনের উচ্চতা বেঁধে দেওয়া হয়। এজন্য বিভিন্ন মহল, বিশেষ করে আবাসন ব্যবসায়ীরা বেঁকে বসেন। শুরু হয় ড্যাপের নানা সংশোধন। আগে প্রশস্ত রাস্তা না থাকলেও আট থেকে ১০তলা পর্যন্ত ভবন করা যেত। কিন্তু গেজেট আকারে ড্যাপ প্রকাশের পর সেই সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়
এ অবস্থায় ঢাকার মহাপরিকল্পনা ড্যাপ সংশোধন নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ও আবাসন ব্যবসায়ীদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। উভয় পক্ষই নানা যুক্তি দিচ্ছেন। রাজউক যেহেতু কাউকে বাদ দিয়ে কাজ করতে পারবে না। তাই চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেও দুই পক্ষের মতপার্থক্যের দ্বন্দ্বে ড্যাপ সংশোধন, সেই সঙ্গে বাস্তবায়ন আটকে গেছে।

ড্যাপে জনঘনত্ব ও অন্যান্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে ভবনের উচ্চতা বেঁধে দেওয়া হয়। এজন্য বিভিন্ন মহল, বিশেষ করে আবাসন ব্যবসায়ীরা বেঁকে বসেন। শুরু হয় ড্যাপের নানা সংশোধন। আগে প্রশস্ত রাস্তা না থাকলেও আট থেকে ১০তলা পর্যন্ত ভবন করা যেত। কিন্তু গেজেট আকারে ড্যাপ প্রকাশের পর সেই সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। অপ্রশস্ত রাস্তার ক্ষেত্রে চার থেকে পাঁচতলা ভবন নির্মাণের বিধান রাখা হয়। ফলে জমির মালিক, হাউজিং প্রতিষ্ঠান, ডেভেলপারদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা বাণিজ্যিকভাবে বাড়ি ও ভবন নির্মাণ তুলনামূলক কমিয়ে দেন। বেড়ে যায় রাজধানীর ফ্ল্যাটের দাম। বাড়তে থাকে বাড়িভাড়াও। এ অবস্থায় আবাসন ব্যবসায়ী, জমির মালিকসহ সংশ্লিষ্টরা বারবার ড্যাপ সংশোধন নিয়ে চাপ দিতে থাকেন। যে কারণে রাজউক ড্যাপের সংশোধনী আনতে সব প্রস্তুতি শেষ করে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। সেখানে ব্যবসায়ীদের দাবিগুলো প্রাধান্য দিয়ে ভবনের উচ্চতা সংশ্লিষ্ট শর্ত থেকে সরে আসে রাজউক।
আরও পড়ুন
এদিকে, রাজউকের ওই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নেন নগরপরিকল্পনাবিদেরা। তাদের বাদ দিয়ে ঢাকার মহাপরিকল্পনা সংশোধনের ওই প্রক্রিয়াকে অস্বচ্ছ দাবি করে দফায় দফায় সংবাদ সম্মেলন এবং সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেয় পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্স (বিআইপি)।
ড্যাপে জনঘনত্ব ও অন্যান্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে ভবনের উচ্চতা বেঁধে দেওয়া হয়। এজন্য বিভিন্ন মহল, বিশেষ করে আবাসন ব্যবসায়ীরা বেঁকে বসেন। শুরু হয় ড্যাপের নানা সংশোধন। আগে প্রশস্ত রাস্তা না থাকলেও আট থেকে ১০তলা পর্যন্ত ভবন করা যেত। কিন্তু গেজেট আকারে ড্যাপ প্রকাশের পর সেই সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। অপ্রশস্ত রাস্তার ক্ষেত্রে চার থেকে পাঁচতলা ভবন নির্মাণের বিধান রাখা হয়। ফলে জমির মালিক, হাউজিং প্রতিষ্ঠান, ডেভেলপারদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা বাণিজ্যিকভাবে বাড়ি ও ভবন নির্মাণ তুলনামূলক কমিয়ে দেন। বেড়ে যায় রাজধানীর ফ্ল্যাটের দাম। বাড়তে থাকে বাড়িভাড়াও। এ অবস্থায় আবাসন ব্যবসায়ী, জমির মালিকসহ সংশ্লিষ্টরা বারবার ড্যাপ সংশোধন নিয়ে চাপ দিতে থাকেন। যে কারণে রাজউক ড্যাপের সংশোধনী আনতে সব প্রস্তুতি শেষ করে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়। সেখানে ব্যবসায়ীদের দাবিগুলো প্রাধান্য দিয়ে ভবনের উচ্চতা সংশ্লিষ্ট শর্ত থেকে সরে আসে রাজউক
অন্যদিকে, আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) ও ঢাকা সিটি ভূমি মালিক সমিতি পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে দফায় দফায়। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে মতের দ্বন্দ্ব বাড়তেই থাকে। জনস্বার্থ না দেখে একটি শ্রেণিকে বিশেষ সুবিধা দিতে নতুন করে ড্যাপের সংশোধনী আনা হচ্ছে— এমন অভিযোগ জানাতে থাকে এ খাতের বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় আটকে যায় ড্যাপের সংশোধন।
সর্বশেষ সংশোধনীর খসড়া চূড়ান্ত করার আগে ড্যাপে ১২ থেকে ১৬ ফুট পর্যন্ত রাস্তার পাশে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) ধরা হয়েছিল ১.৭৫ অর্থাৎ এমন প্রশস্ত রাস্তার পাশে পাঁচ কাঠার প্লটে পার্কিংসহ পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করা যাবে। এমন হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নতুন ড্যাপে ৬-৮ ফুট প্রশস্ত রাস্তার পাশের ফ্ল্যাটের ফার ধরা হয়েছে ১.২৫। ৮-১২ ফুট প্রশস্তের রাস্তার ফার ১.৫, ১৬-২০ ফুট প্রশস্ত রাস্তার ফার ২, ২০ ফুট রাস্তার ফার ২.৫, ৩০ ফুট রাস্তার ফার ৩ এবং ৪০-৬০ ফুট রাস্তার ফার ৩.৫ থেকে ৩.৭৫ ধরা হয়েছে। ফলে পাঁচ কাঠার একটি জমিতে আগে আট ও দশতলার নকশা পাওয়া যেত, এখন পাওয়া যাবে পাঁচতলার। ভবনের ব্যবহারযোগ্য স্পেসের পরিমাণও সেই অনুপাতে হবে। আগে যেখানে প্রশস্ত রাস্তা না থাকলেও ৮/১০ তলা ভবন করা যেত, এখন সেখানে অনুমোদন পাওয়া যাবে ৪/৫ তলার। এ কারণে স্বল্প প্রস্থের রাস্তার পাশের জমির মালিকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। দাম বেড়ে যাচ্ছে ফ্ল্যাটের। সেই সঙ্গে আবাসন বা ডেভেলপার কোম্পানিগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এরপর থেকে বেঁকে বসেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। শুরু হয় ড্যাপ সংশোধনের দাবি। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বেশকিছু শর্ত শিথিল করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) প্রণীত ডিটেল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) সংশোধনী চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তখনই নগরপরিকল্পনাবিদেরা এ সংশোধনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। যে কারণে আটকে যায় ড্যাপ সংশোধনীর প্রক্রিয়া।

ড্যাপ সংশোধনীর বিষয়ে এর আগে সদ্য বিদায়ী রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) সিদ্দিকুর রহমান সরকার দাবি করে বলেছিলেন, ‘আমরা সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মতামত নিয়েছি। তাদের দাবি এবং সার্বিক দিক বিবেচনা করে ড্যাপ সংশোধন হচ্ছে। খুব শিগগিরই এটি কার্যকর হবে। তখন আর ভবনের উচ্চতা ও আয়তনকেন্দ্রিক কোনো সমস্যা বা জটিলতা থাকবে না। আমরা সাধারণ মানুষের মতামত চেয়েছি, বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে ড্যাপ সংশোধন কার্যকর হবে।’
অন্যদিকে, ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের মত ও সুপারিশ উপেক্ষা করা হয়েছে। শহরের বাসযোগ্যতার বিষয়টি বিবেচনা না করে আবাসন ব্যবসায়ীদের মতো করে ড্যাপ সংশোধনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। যা শহরকে আরও ধ্বংস করবে, ধীরে ধীরে বাসযোগ্যতা হারাবে।’
সার্বিক বিষয় নিয়ে রাজউকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সবার মতামত ও পরামর্শের ভিত্তিতে ড্যাপ সংশোধন করা হবে। সংশোধন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেও আপাতত থেমে আছে। একপক্ষ চাচ্ছে কিন্তু আরেক পক্ষ চাচ্ছে না। এমন সংশোধনের ক্ষেত্রে জনগণ ও শহরের যেভাবে ভালো হবে সেটাই করবে রাজউক। ফ্লোর এরিয়া রেশিওসহ কয়েকটি বিষয়ের আলোচনা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত, বিরোধিতার বিষয়গুলো উঠে এসেছে। এগুলো যৌক্তিক পর্যায়ে রেখে ড্যাপ সংশোধন করে বাস্তবায়নের কাজ ত্বরান্বিত করা হবে।
ড্যাপ সংশোধনীর পক্ষে-বিপক্ষের কারণ কী
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ও ইমারত বিধিমালা সংশোধন করার সাম্প্রতিক যে উদ্যোগ, সেটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকায় ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি আরও ব্যাপক হারে বাড়বে। সরু রাস্তায় বহুতল ভবন নির্মাণের অবাধ স্বাধীনতা কিংবা ১০ তলা পর্যন্ত আবাসিক ভবনকে বহুতল বিবেচনা না করে কাঠামোগত ও অগ্নিনিরাপত্তায় ছাড় দেবার উদ্যোগগুলো অত্যন্ত বিপজ্জনক। নাগরিক, পেশাজীবী ও পরিকল্পনাবিদদের পক্ষ থেকে বিষয়গুলো বারবার তুলে ধরা হলেও রাজউক ও মন্ত্রণালয় মানুষের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি উপেক্ষা করে আবাসন ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষায় অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

এদিকে, আইপিডির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়েছে, নগর পরিকল্পনাবিদদের পরামর্শ আমলে না নিয়েই স্বেচ্ছাচারীভাবে এ কার্যক্রম চলছে। বিবেচনাহীনভাবে এলাকাভিত্তিক ও প্লটভিত্তিক ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) ও জনঘনত্ব বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে রাজউক, যাতে যানজট ও বায়ুদূষণে প্রায় অচল ও মৃতপ্রায় এ শহরের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হবে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও রাজউকের অপরিণামদর্শী এ ধরনের উদ্যোগের পেছনে কোনো উদ্দেশ্য এবং কারও স্বার্থ কাজ করছে কি না, সেটির নির্মোহ তদন্ত করতে হবে সরকারকে। ঢাকার বাসযোগ্যতা বাড়াতে পরিকল্পনাবিদদের কারিগরি পরামর্শ এবং সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করে ইমারত বিধিমালা ও ড্যাপের যৌক্তিক সংশোধন করার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে।
আইপিডির পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০০৮ সালের ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় আবাসিক ভবনের জন্য মোটা দাগে রাস্তার প্রশস্ততা ও প্লটের আয়তনের ওপর ভিত্তি করে সর্বনিম্ন ‘এফএআর’ মান ৩.১৫ ও সর্বোচ্চ ৬.৫ দেওয়া হয়েছিল। বর্তমান বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় আবাসিক এ৩ (ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্ট) শ্রেণির জন্য এ মান সর্বোচ্চ ৪.২৫ নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা মে-২০২৪ সালের খসড়া ইমারত বিধিমালায় অনুসরণ করা হয়েছিল।
অথচ ডিসেম্বর-২০২৪ সালে রাজউক কর্তৃক প্রণীত ইমারত বিধিমালার খসড়াতে প্লটভিত্তিক আবাসিক এ৩ ক্যাটাগরির ফার মান ৫.৫ করা হয়েছে, যা প্রায় অবাসযোগ্য ঢাকা শহরের ওপর চাপ আরও মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে দেবে। অথচ বৈশ্বিকভাবে ছোট আয়তনের প্লটভিত্তিক আবাসিক ভবনের ক্ষেত্রে ফার মান সাধারণত ১ থেকে ৩ এর মধ্যে হয়ে থাকে। ড্যাপে এলাকাভিত্তিক ফার ও জনঘনত্ব দুই থেকে তিনগুণ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে রাজউক। অথচ সেসব এলাকার নাগরিক সুবিধাদি একই থাকছে। গোষ্ঠীস্বার্থে বিধিমালার ফার মান পরিবর্তন শহরের জন্য বাসযোগ্যতার জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ বিবেচনায় নিয়ে ফার মান সাধারণত থাকে ১-৩ এর মধ্যে। অথচ প্রস্তাবিত বিধিমালায় ফার মান সর্বোচ্চ ৬, ৭ এমনকি এনএর বা নিয়ন্ত্রণহীন ফার মান প্রস্তাব করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘ইমারত নকশা ও নির্মাণ সংশ্লিষ্ট অনেক পেশাজীবী নতুন ড্যাপের প্রস্তাবনা অনুযায়ী ভবন নকশায় আগ্রহী না হয়ে ভবন মালিকদের ভিন্ন বার্তা দেবার চেষ্টা করেছেন। ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে সঙ্গে বারবার স্বার্থান্বেষী মহলের বাধার কারণে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হতে পারছে না।’
‘গত দুটি বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা প্রণয়নের পরপরই রিভিউ কমিটি গড়ে ড্যাপ বাস্তবায়নের মূল শক্তিটাই নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই প্রভাবশালী মহলের কাছে সামগ্রিক জনস্বার্থ এবং শহরের বাসযোগ্যতাকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। অনুরূপভাবে বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের ভূমি উন্নয়ন বিধিমালা- ২০০৪ এর সংশোধন করা হয় ২০১৫ সালে, যাতে আবাসন ব্যবসায়ীদের চাপে জনস্বার্থ উপেক্ষা করে নাগরিক সুবিধাদির মানদণ্ড বা স্ট্যান্ডার্ড অনেক কমিয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে পরিমাণ কমেছে পার্ক, খেলার মাঠ, বিদ্যালয়সহ নানা নাগরিক সুবিধাপ্রাপ্তিতে।
বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়কারী আমিরুল রাজীব বলেন, ড্যাপ পর্যালোচনার জন্যে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট যে কমিটি গঠন করা হয়েছে সেখানে কয়েকজন সরকারি আমলা, পেশাজীবী আর্কিটেক্ট, ইঞ্জিনিয়ার ও একজন প্ল্যানার রয়েছেন। এ কমিটিতে উচিত ছিল আরও প্ল্যানার, নিরপেক্ষ পেশাজীবী, পরিবেশকর্মী ও নাগরিক সমাজকে সংযুক্ত করা।
বিআইপির উপদেষ্টা পরিষদের আহ্বায়ক পরিকল্পনাবিদ মো. ফজলে রেজা সুমন বলেন, ‘ড্যাপকে পুরো ঢাকা শহরের সমন্বিত উন্নয়নের একটি দলিল বলা হয়। যেখানে ভূমির ব্যবহার, নাগরিক সুবিধাসহ সবকিছু আলোচনা করা আছে। কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এটাকে সংশোধন করে নিজেদের স্বার্থের দিকে নিয়ে যেতে চায়। যা শহরের বাসযোগ্যতা আরও ধ্বংস করবে।

ড্যাপ সংশোধনের পক্ষে যুক্তি
ঢাকা শহরের ভূমির মালিকদের সমন্বয়ক ড. দেওয়ান এম এ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘ড্যাপে ঢাকা শহরের মাত্র ২০ শতাংশ এলাকাকে পরিকল্পিত এরিয়া হিসেবে দেখানো হয়েছে। সেখানে সুউচ্চ ভবন নির্মাণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অবশিষ্ট ৮০ শতাংশ এলাকাকে অপরিকল্পিত এরিয়া ট্যাগ দিয়ে ভবনের উচ্চতা ও আয়তন হ্রাস করে দেওয়া হয়েছে। যেন ঢাকা শহরের প্রকৃত ভূমির মালিকেরা কোনোভাবে ভবন নির্মাণ করতে না পারেন। যে কারণে জমির মালিকেরা নতুন করে ভবন-বাড়ি নির্মাণ বন্ধ রেখেছেন।’ তার দাবি, দ্রুত ড্যাপ সংশোধন করে উচ্চতা ও আয়তনকেন্দ্রিক বাধা দূর করতে হবে।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান বলেন, আমরা চাই দ্রুত ড্যাপ সংশোধন হোক। উচ্চতা ও আয়তনকেন্দ্রিক আর কোনো বাধা না থাকুক। ড্যাপে ভবনের আয়তন-উচ্চতা ঠিক করে দেওয়ার পর রিয়েল এস্টেট, হাউজিং কোম্পানিগুলো নতুন ভবন নির্মাণ করা একেবারে কমিয়ে দিয়েছে। যে কারণে ফ্ল্যাট কেনায় মানুষের চাহিদা থাকলেও নতুন করে ফ্ল্যাট নির্মাণের সংখ্যা কমেছে।
বর্তমান ড্যাপে যা আছে
বর্তমান ড্যাপে ভূমি পুনর্বিন্যাস, উন্নয়নস্বত্ব, প্রতিস্থাপন পন্থা, ভূমি পুনঃউন্নয়ন, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন, উন্নতিসাধন ফি, স্কুল জোনিং ও ডেনসিটি জোনিং আছে। রাজউকের অন্তর্ভুক্ত এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে মোট ৪৬৮টি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। সেখানে ঢাকাসহ আশপাশের এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার দুই হাজার ১৯৮ কিলোমিটার জলাধার সিএস রেকর্ড অনুযায়ী উদ্ধার করে সচলের সুপারিশ করা আছে। একই সঙ্গে এসব এলাকাকে বিনোদন স্পটে পরিণত করারও সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।
ঢাকা শহরকে নতুন করে পরিকল্পিত নগরীতে পরিণত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ২০১০ সালে। সেজন্য প্রণয়ন করা হয় ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান বা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)। ১৯৫৩ সালের টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্টের আওতায় ২০১০ সালে ড্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছিল। প্রথম ড্যাপের মেয়াদ ছিল ২০১৫ সাল পর্যন্ত। পরে মেয়াদ বাড়ানো হয়।
পরবর্তী সময়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নতুন ড্যাপ (২০২২-৩৫) তৈরি করে। ঢাকা মহানগরসহ আশপাশের এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে এ মহাপরিকল্পনা করা হয়। ড্যাপে ছয়টি স্বতন্ত্র অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে ঢাকাকে। সেগুলো হচ্ছে— কেন্দ্রীয় অঞ্চল- ঢাকা শহর, উত্তর অঞ্চল- গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, পূর্ব অঞ্চল- কালীগঞ্জ ও রূপগঞ্জ উপজেলা, দক্ষিণ অঞ্চল- নারায়ণগঞ্জ, দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল- কেরানীগঞ্জ উপজেলা এবং পশ্চিম অঞ্চল- সাভার উপজেলা।
এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব বিন্যাস, নগরজীবন রেখা, ট্রানজিটভিত্তিক উন্নয়ন, নাগরিক সুযোগ-সুবিধার মানদণ্ড প্রণয়ন, ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন ও উন্নয়ন স্বত্ব বিনিময়— সবমিলিয়ে রাজধানী ঢাকার সমস্যাগুলো কমিয়ে পরিকল্পিত শহর গড়ার লক্ষ্যে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) গেজেট আকারে প্রকাশ হয়। শহরের বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করতে নাগরিক সুবিধাদি ও পরিষেবার বিপরীতে জনসংখ্যা নির্ধারণ করে শহরের সার্বিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। সেক্ষেত্রে কোন এলাকার উন্নয়নে কতটুকু অনুমোদন দেওয়া হবে তা নির্ভর করবে ওই এলাকার সুবিধাদিপ্রাপ্তির ওপর।
এএসএস/