উল্টোপথে অবাধ চলাচল, অসহায় ট্রাফিক বিভাগ

দুই যাত্রী নিয়ে শ্যামলী ক্রস করার সময় মূল সড়কে ঢোকার মুখে একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা আটকে দেয় ট্রাফিক পুলিশ। সেটিকে ফেরত পাঠানো হয়। একই অটোরিকশা আবার ঘুরে তেজগাঁও ডিসি অফিসের পেছন দিয়ে মূল সড়কে ওঠে। এরপর উল্টোপথে শিশুমেলার সামনে দিয়ে ঢুকে পড়ে। বাস ও অন্য রিকশার জটলা পেরিয়ে বাধাহীনভাবেই পৌঁছায় গন্তব্যে, আগারগাঁও মেট্রো স্টেশনের নিচে।
সেখানে কথা হয় ওই ব্যাটারিচালিত রিকশার চালক রুহুল আমিনের সঙ্গে। তিনি থাকেন বছিলায়। প্রতিদিন যাত্রী নিয়ে দূর-দূরান্তের ট্রিপ মারেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি একলা আইন মানলে কী হবে? আইন মানতে হলে সবাইকে মানতে হবে। দূরের ভাড়ায় টাকা বেশি, রিকশাও বেশি।’
সম্প্রতি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিনে তেজগাঁও এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শিশুমেলা থেকে শুরু করে আগারগাঁও, এরপর আগারগাঁও থেকে উড়োজাহাজ ক্রসিং পর্যন্ত মূল সড়কে বাধাহীনভাবে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। কখনো কখনো এক-দুজন ট্রাফিক পুলিশ ও সহযোগী সদস্যরা ব্যাটারিচালিত রিকশা আটকে দিলেও অধিকাংশই চলছে দাপটের সঙ্গে।
শিশুমেলা থেকে শুরু করে আগারগাঁও, এরপর আগারগাঁও থেকে উড়োজাহাজ ক্রসিং পর্যন্ত মূল সড়কে বাধাহীনভাবে চলছে ব্যাটারিচালিত রিকশা। কখনো কখনো এক-দুজন ট্রাফিক পুলিশ ও সহযোগী সদস্যরা ব্যাটারিচালিত রিকশা আটকে দিলেও অধিকাংশই চলছে দাপটের সঙ্গে
রাস্তায় এত বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা যে তা নিয়মের মধ্যে বা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না পুলিশ। আনার কথাও না। ট্রাফিক পুলিশ বলছে, ঢাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা অবৈধ বাহন, প্রাতিষ্ঠানিক কোনো অনুমোদন নেই। অথচ ঢাকার যানজট ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বড় বাধা এখন ব্যাটারিচালিত রিকশা।

এক কথায়, রাস্তায় এত বেশি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা যে বিরক্ত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরাও অসহায়।
ডিএমপির ট্রাফিক তেজগাঁও বিভাগের শেরে-বাংলা নগর জোনের সহকারী কমিশনার জাকির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের স্বাভাবিক ট্রাফিক পুলিশিং কার্যক্রম চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আগারগাঁও মোড়ে হরহামেশা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ঢুকে পড়ছে। সিগন্যাল, রুট কিছুই মানে না। মানতেও চায় না। কখনো কখনো উড়োজাহাজ ক্রসিংয়েও ঢুকে পড়ে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ তো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না, এটা তো পুরোটাই অবৈধ। উল্টোপথে চলাচল করে। এই অবৈধ বাহনের কারণে আমার মূল দায়িত্ব পালন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।’
শেরে-বাংলা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছুটির সময় তখন। ভরদুপুরেও একরকম জট লেগেছে আগারগাঁও সড়কে। বাচ্চারা স্কুল থেকে বের হচ্ছে, আর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলো অভিভাবকসহ শিশুদের যাত্রী হিসেবে নিতে যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সড়ক সোজা নাকি উল্টো, সেদিকে যেন ভ্রুক্ষেপ নেই কারো; না যাত্রী, না চালকের।
নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের বিপরীতে পরিবেশ অধিদপ্তরের সামনে দিয়ে উল্টোপথে চলাচল যেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে সঠিক পথে আসা অনেক যানবাহনের চালক ক্ষণিকের জন্য হলেও সম্বিৎ হারাতে পারেন। যে কেউ দাঁড়ালে হয়তো ভেবে নিতে পারেন, সঠিক পথে আসা যানবাহনটাই উল্টোপথে আসছে।

ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদক ছয় মিনিট সেখানে অবস্থান করেন। এই সময়ের মধ্যে দুই শতাধিক যানবাহনকে উল্টোপথে চলাচল করতে দেখা যায়। তার মধ্যে ১৩০টির বেশিই ছিল ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা।
আগারগাঁও এলাকার এক ট্রাফিক ইন্সপেক্টর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালকেরা এখন দলবদ্ধ হয়ে বিক্ষোভ করেন, কান্নাকাটি করে সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করেন। আমরা যদি নিয়মিত কাজের বাইরে গিয়ে শুধু অটোরিকশার পেছনে সময় দিই, তাহলে সড়ক সচল থাকবে না। আর ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ কিংবা নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টা করাটাও আমার ম্যান্ডেটের মধ্যে পড়ে না।
ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ট্রাফিক পুলিশের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে নাজুক করে তুলেছে। শুধু আগারগাঁও-শ্যামলীই নয়, পুরো ঢাকার বড় সমস্যা এখন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা।
ডিএমপির ট্রাফিক তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার মো. আসলাম সাগর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ঢাকা উদ্যান, বছিলা, চন্দ্রিমা উদ্যান, বিভিন্ন হাউজিং, আদাবর, শেখেরটেকসহ নানা স্থান থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাগুলো আসে। আগে কখনো এগুলো মূল সড়কে চলত না। এখন হরহামেশা চলে। মিরপুর রোডে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করি। গত মাসে আমি প্রায় ১৪০০টি ডাম্পিং করেছি। কিন্তু কোনো কাজে আসছে না।’
তিনি বলেন, ‘এখন অবস্থা এমন যে অটোরিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা বা অভিযান পরিচালনা করতে গেলেই তারা রাস্তা বন্ধ করে দেয়, বিক্ষোভ করে। প্রধান সড়কে তাদের চলাচলকে তারা নিজেদের অধিকার করে নিয়েছেন। সেখানে সহযোগী ভূমিকা পালন করছেন যাত্রীরা। কারণ যাত্রীরা সচেতন নন, আটকালে চালকদের সঙ্গে তারাও তর্ক করেন।’

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘এটিকে বন্ধ করার দায় তো আমার না। মোহাম্মদপুরের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ বলব। নিউমার্কেট এলাকায় গ্যারেজ কম, অন্য এলাকার রিকশা হয়তো সেখানে চলাচল করে। কিন্তু মোহাম্মদপুরের চালকেরা এখানেই থাকেন, গ্যারেজও এখানে, রিকশা তৈরি হচ্ছেও এখানে। সঙ্গত কারণেই বছিলায় তৈরি অটোরিকশা হরহামেশা শ্যামলী পর্যন্ত চলে আসছে। আমরা আর কতটাই বা করতে পারি। এমন না যে তারা কথা শোনে বা বোঝে।’
ডিএমপির ট্রাফিক রমনার ধানমন্ডি জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) রাজিব গাইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অবৈধ যানবাহন চলাচল করবে, এটাই স্বাভাবিক। সেখানে মূল সড়কে তো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা মূল সড়কে চলে আসছে। আমরা বাধা দিই, আটকে রাখি, তার কেটে দিই। কখনো ব্যাটারি ও সিট জব্দ করি। এটা সবসময় সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, অলিগলি থেকে হঠাৎ মূল সড়কে চলে আসছে এবং বাসের পেছনে জায়গা নিচ্ছে। হুট করে ঢুকে পড়া অটোরিকশাকে হুট করেই মূল সড়কে জব্দ বা আটকে দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণও বটে।’
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, ‘আমাদের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। যথাসম্ভব সব পয়েন্টে আমরা ট্র্যাপার বসাচ্ছি। কিন্তু ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা শুধু বাড়ছেই, অন্য এলাকার রিকশাও চলে আসছে। সবমিলিয়ে আমরা আসলে অসহায়।’
ডাম্পিং নিয়েও বিড়ম্বনার কথা জানান ট্রাফিক পুলিশের এ মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা। বলেন, ‘আমাদের তো ডাম্পিং স্পেস খুবই কম। ডাম্পিং যা করি, সব তো ডাম্পিং স্টেশনে ঢোকানো সম্ভব হয় না। দুটি বিভাগে আটটি ডাম্পিং জোন আছে। প্রতিদিন যদি আমরা দুটি বিভাগ মিলে ১৫০-২০০ অটোরিকশা জব্দ করি, সব তো ডাম্পিং স্টেশনে পাঠানো সম্ভব হয় না।’
তিনি বলেন, ‘গাড়ি কমছে না, সিগন্যালও ছাড়া; জটলা, চাপ কমছে না! কারণ কী? একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি যে মূল সড়কে রিকশা ঢুকে গেছে। এই বিড়ম্বনা থেকে মুক্তি ট্রাফিক পুলিশকে দিয়ে সম্ভব না।’

ট্রাফিক রমনা জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) কাজী রোমানা নাসরিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পুরো ঢাকা শহর অটোরিকশার কারণে অস্থির। কোনো নিয়ম মানার বালাই নাই। আমাদের হাতে তো অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণের উপায় নাই। আমরা পারি ধরে ধরে ডাম্পিং করতে। মূল কাজ বাদ দিয়ে এটা নিয়মিত করা কতটা সম্ভব!’
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এক লাখ ৯১ হাজার ২৫২টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নিয়েছে ট্রাফিক পুলিশ। এর মধ্যে ৪০ হাজার ২৫৭টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ডাম্পিং করা হয়েছে
তিনি বলেন, ‘আমার তো ভিআইপি এলাকা। এখানে সরকারি দপ্তর, সচিবালয়, মন্ত্রিপাড়া, মন্ত্রণালয়ের ভিআইপিদের চাপ। সেখানে হুটহাট অটোরিকশা ঢুকে পড়ছে। অনেক দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। অটোরিকশার কারণে সড়কে গতি কমে গেছে। এটার কোনো সুরাহা করতে পারছি না। এই সমস্যা সমাধানের প্রশ্ন আমাকে না করে যাদের মূল দায়িত্ব, তাদের উচিত সমাধান করা, প্রশ্ন করা।’
৮ মাসে ডাম্পিং ৪০ হাজার অটোরিকশা
ডিএমপি সদর দপ্তরের ট্রাফিক বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এক লাখ ৯১ হাজার ২৫২টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ নিয়েছে ট্রাফিক পুলিশ। এর মধ্যে ৪০ হাজার ২৫৭টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ডাম্পিং করা হয়েছে।
জানতে চাইলে ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক-অ্যাডমিন, প্ল্যানিং অ্যান্ড রিসার্চ) মো. আনিছুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের নাম ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। অবৈধ অটোরিকশা অনেক বেড়েছে। যদিও আমাদের কাছে কত লাখ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলে, সেই পরিসংখ্যান নেই।’
ট্রাফিক পুলিশের চেষ্টা-উদ্যোগ আছে বলেই ঢাকা এখনো সচল
যুগ্ম কমিশনার আনিছুর রহমান বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা মূল সড়কে আসে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে, আমরা যদি সচেতনভাবে চেষ্টা না করতাম, উদ্যোগ না নিতাম, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিতাম, তাহলে ঢাকা শহরে যানচলাচল স্থবির হয়ে পড়ত। ঢাকা এখনো সচল, কারণ আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
ডাম্পিংয়ে ৩ মাস আটকে রাখার কৌশল ট্রাফিক পুলিশের
‘ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ডাম্পিং করা কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। অনেক ওজনের হয়। ডাম্পিং গ্রাউন্ড দূরে। সবমিলিয়ে ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। এছাড়া, আমাদের পর্যাপ্ত স্পেস নাই। সেজন্য আগে আমরা এক মাস ডাম্পিং করা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা আটকে রাখতাম। এরপর আসলে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দিতাম। এখন সেটা তিন মাস পর্যন্ত আটকে রাখছি। এরপর মুচলেকা নেওয়ার সময় ঢাকার বাইরে চালানোর শর্তে ফেরত দিচ্ছি। কারণ, এটা ডেস্ট্রয় করা যায় না। এখানে অর্থ খরচের বিষয় আছে। পরিবার আছে বলেই আমরা খুব বেশি কঠোর হতে পারি না।’
আনিছুর রহমান বলেন, ‘আমাদের ট্রাফিক বিভাগে জনবল প্রয়োজনের তুলনায় কম। তবে, ঢাকার অন্তত নয়টি পয়েন্টে আমাদের ২৪ ঘণ্টা সার্ভিস দিতে হয়। আগে রাত ১০/১১টা পর্যন্ত ডিউটি দেওয়া হতো, এখন অন্তত ১২টা পর্যন্ত। অর্থাৎ আমাদের ডিউটির পরিধি ও সময় বেড়েছে। কিছুদিনের মধ্যে অন্তত আরও ৫০টি স্থানে আমাদের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ডিউটির পরিধি ২৪ ঘণ্টা করতে হবে।’
জেইউ/এমএআর/
