ড্রোন থেকে ব্যাঙ—সব উদ্যোগই ব্যর্থ, মশার কাছে হার মানছে সবাই?

বছরজুড়ে মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ঢাকাবাসীর কাছে রীতিমতো এক আতঙ্কের নাম ‘এডিস ইজিপ্টাই’। ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণু বহনকারী এই মশা বর্ষা মৌসুম এলেই যেন আরও ‘ভয়ংকর’ হয়ে ওঠে। এ সময় মশা মারতে কর্তৃপক্ষও যেন একটু উদ্যোগী হয়। রাজধানীবাসীকে স্বস্তি দিতে প্রতি বছর বাজেট বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন নতুন উদ্যোগ নিতেও দেখা যায়।
এডিস মশা নিধনে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন (উত্তর-দক্ষিণ) বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ‘থেরাপি’ ব্যবহার করেছে। মশা শনাক্তে ব্যবহার করা হয়েছে ড্রোন। পানিতে ছাড়া হয়েছে ব্যাঙ, হাঁস, তেলাপিয়া ও গাপ্পি মাছ। কিন্তু তাতে কি মশা কমেছে?
এদিকে, গত এক বছর ধরে সিটি কর্পোরেশনে নেই কোনো ওয়ার্ড কাউন্সিলর। যথাযথ তদারকির অভাবে মশক নিধন ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে নেওয়া বিভিন্ন কার্যক্রমের গতি শ্লথ হয়ে পড়ায় পরিস্থিতি এখন রীতিমতো নাজুক। হাসপাতালে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এ বছরের ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এখনই ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে উৎস শনাক্ত করে এডিস মশার বিস্তার রোধ করতে হবে। প্রজননস্থল নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে আগামীতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলেও তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ১৩টি ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব স্বাভাবিক মানদণ্ডের তুলনায় উদ্বেগজনক হারে বেশি। ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ অনুযায়ী কোনো এলাকায় এডিস লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হলে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে হিসেবে ধরা হয়। ঢাকা উত্তরে ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো হলো— ২, ৮, ১২, ১৩, ২২ ও ৩৪। দক্ষিণের ঝুঁকিতে থাকা ওয়ার্ডগুলো হলো—৩, ৪, ২৩, ৩১, ৪১, ৪৬ ও ৪৭
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী (২২ সেপ্টেম্বর), চলতি বছর দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ১৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪২ হাজার ৫০৯ জন।

জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ সময়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিচালিত এক জরিপে (প্রাক-বর্ষা) দেখা গেছে, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের ১৩টি ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব স্বাভাবিক মানদণ্ডের তুলনায় উদ্বেগজনক হারে বেশি। জরিপে ব্যবহৃত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সূচক ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ অনুযায়ী কোনো এলাকায় এডিস লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হলে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে হিসেবে ধরা হয়।
জরিপে দেখা যায়, দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৩টিতে ব্রুটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি। অর্থাৎ এসব এলাকায় ১০০টি পানির পাত্রের মধ্যে ২০টিরও বেশি জায়গায় এডিস মশা বা লার্ভা পাওয়া গেছে। ফলে এলাকাগুলোকে ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো হলো—২, ৮, ১২, ১৩, ২২ ও ৩৪। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ঝুঁকিতে থাকা ওয়ার্ডগুলো হলো—৩, ৪, ২৩, ৩১, ৪১, ৪৬ ও ৪৭।
নগরবাসীকে মশার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে গত ১০ বছরে দুই সিটি কর্পোরেশন বাজেটে বরাদ্দ রেখেছিল প্রায় ৮৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) বরাদ্দ ছিল ৫৬০ কোটি টাকার বেশি এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) বরাদ্দ ছিল প্রায় ২৭০ কোটি টাকা। এরপরও নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি মশার উপদ্রব
নগরবাসীর অভিযোগ, মশা থেকে তাদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ। রাজধানীতে মশার উপদ্রব বেড়ে গেছে, আর এতে তারা রীতিমতো অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। সিটি কর্পোরেশনের নামমাত্র কার্যক্রমে মশা কমার বদলে আরও বেড়েছে বলে অভিযোগ তাদের।

ঢাকার আফতাবনগর এলাকার গৃহিণী শারমিন আক্তার বলেন, ‘প্রতিদিন ভয়ে থাকি ডেঙ্গু নিয়ে। মশা বাড়ছেই। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনকে মশা মারতে ওষুধ ছিটাতে দেখি না। শুধু খবরে আর টিভিতে দেখি তারা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। বাস্তবে তাদের দেখা পাই না। আত্মীয়-স্বজনসহ পরিচিতদের ডেঙ্গু হওয়ার খবর পাই প্রায় প্রতিদিন। ভয় হয়, কয়েল জ্বালাই, মশারি টাঙাই, তাতেও মশার অত্যাচার থেকে রক্ষা পাচ্ছি না।’
আরও পড়ুন
বাসাবো এলাকায় দীর্ঘদিন পরিবারসহ বসবাস করেন বেসরকারি চাকরিজীবী আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশন শুধু লোক দেখানো কাজ করে। মশা মারা কিংবা ওষুধ ছিটানোর কোনো লোক দেখা যায় না। নামেই শুধুই কাজ করে তারা। কখনও বাস্তবে তাদের দেখা যায় না। কী করে তারা, কিছুই বুঝি না। প্রতি বছর শুধু শুনি কোটি কোটি টাকার মশা মারার বাজেট। কিন্তু বাস্তবে ডেঙ্গু মোকাবিলা, মশা মারার উদ্যোগ দেখি না।’

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণসহ মশার বিরুদ্ধে আমাদের কার্যক্রম চলছে। প্রতিটি কর্মী নিজ নিজ জায়গা থেকে সর্বোচ্চ কাজ করে যাচ্ছেন। মশক, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা দুটি স্তরে কার্যক্রম পরিচালনা করছি। আমাদের নিয়মিত মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চলছে। পাশাপাশি বিশেষ মশক নিধন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম এবং জনগণকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে।’
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমাদের কাজ চলমান। আমাদের কর্মীরা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছেন। অন্যান্য বছরের তুলনায় ডেঙ্গু এখনও নিয়ন্ত্রণে আছে অনেকটা। এছাড়া মশার ওষুধ ঠিকমতো ছিটানো হচ্ছে কি না, সেটি আমরা তদারকি করছি। আমাদের কর্মীরা মাঠে আছেন, তারা নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি নগরবাসীকেও সচেতন করানোর কাজ করছি আমরা।’

জানা গেছে, কয়েক বছর আগে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের নজির স্থাপন করেছিল ডিএনসিসি। মশার উৎপত্তিস্থল শনাক্ত করতে তারা ব্যবহার করে ড্রোন। পরে নগরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এডিস মশার সম্ভাব্য প্রজননস্থল যেমন- পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের খোসা, কমোড, প্লাস্টিকের কাপ, চিপসের প্যাকেট কিংবা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কিনে নেওয়ার উদ্যোগ নেয় সংস্থাটি। তবে সেই প্রচেষ্টাও প্রত্যাশিত ফল দেয়নি।
আরও পড়ুন
অন্যদিকে, ডিএসসিসি গ্রহণ করেছিল কিছু অভিনব কৌশল। দুই বছর আগে তারা খাল, নালা ও জলাশয়ে ব্যাঙ ছাড়ে, ছাড়ে গাপ্পি মাছ, হাঁসও। ধারণা ছিল, এসব ব্যাঙ, গাপ্পি মাছ, হাঁস পানিতে ভেসে থাকা মশার লার্ভা খেয়ে ফেলবে এবং মশার বংশবিস্তার রোধ হবে। এছাড়া জনসচেতনতা তৈরির জন্য তারা প্রচারাভিযান চালায়, এমনকি জিঙ্গেল বাজানোর উদ্যোগও নেয়। কিন্তু ড্রোন থেকে ব্যাঙ— সব ধরনের অভিনব উদ্যোগের পরও মশার উপদ্রব থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে দুই সিটি কর্পোরেশন।
সার্বিক বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনকে গুরুত্বসহকারে কাজ করতে হবে। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আগামীতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খুবই খারাপ হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।’

মশা মারতে দুই সিটিতে বরাদ্দ ছিল ৮৩০ কোটি টাকা
নগরবাসীকে মশার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে গত ১০ বছরে দুই সিটি কর্পোরেশন বাজেটে বরাদ্দ রেখেছিল প্রায় ৮৩০ কোটি টাকা। কিন্তু এত টাকা খরচ করেও নগরবাসীকে মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা করতে পারেনি তারা। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) গত ১০ অর্থবছরে ৫৬০ কোটি টাকার বেশি অর্থ বরাদ্দ দেয় মশক নিধনে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) গত ১০ অর্থবছরে প্রায় ২৭০ কোটি টাকা মশক নিধনে বরাদ্দ দেয়।
জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৪ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ১১.৯৫ কোটি), ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৩.২৫ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ১৬.৮৫ কোটি), ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২০ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ১৭.৫০ কোটি), ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২১ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ১৭.৫০ কোটি), ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৯.৩০ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৫৮ কোটি), ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭০ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৫০.৫০ কোটি), ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৫ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৫১.৫৩ কোটি), ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৬ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৫২.৫০ কোটি), ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৪.৫০ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৮৭.৫০ কোটি) এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়।
অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) গত ১০ অর্থবছরে প্রায় ২৭০ কোটি টাকা মশক নিধনে বরাদ্দ দেয়। যার মধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১২.৫০ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১১.৫০ কোটি টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৫.৬০ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৬ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩২.৭৫ কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০.০২ কোটি টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩১.০২ কোটি টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৭ কোটি টাকা, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৮.৮৩ কোটি টাকা এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪৪.৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এএসএস/জেডএস/এমএআর
