ডেমুর ব্যর্থতার পরও চীনা ইঞ্জিনেই ভরসা!

ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট বা ডেমু ট্রেনের ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা ভুলে রেলপথ মন্ত্রণালয় আবারও চীনা ইঞ্জিনে (লোকোমোটিভ) ভরসা রাখতে চলেছে। ২০১৩ সালে চীন থেকে আনা ২০ সেট ডেমু ট্রেন ছয় বছরের মধ্যেই অকেজো হয়ে গেলে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রায় ৬০০ কোটি টাকা অপচয় হয়েছিল। এবার রেলওয়ে ২০টি মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক ইঞ্জিন চীনের অনুদানে আনার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। চীন সরাসরি অর্থ দেবে, নাকি ইঞ্জিন সরবরাহ করবে— এ বিষয়ে এখনও লিখিত নিশ্চয়তা মেলেনি।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তে ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) এই অনুদানের জন্য আবেদন করা হয়েছে। এই প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৭২৩ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দেবে ৪৯৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা এবং চীনের অনুদান হিসেবে থাকবে এক হাজার ২২৫ কোটি ৬ লাখ ১০ হাজার টাকা। প্রকল্পের মেয়াদকাল ধরা হয়েছে জুলাই ২০২৫ থেকে জুন ২০২৯ পর্যন্ত।
পুরোনো ইঞ্জিন প্রতিস্থাপন জরুরি
বাংলাদেশ রেলওয়ের মোট ৩০৬টি ইঞ্জিনের মধ্যে ১৭৪টি হলো মিটারগেজ। এই মিটারগেজ ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে ১২৪টির বয়স ২০ বছরের বেশি এবং ৬৮টির বয়স ৪০ বছরেরও বেশি। এগুলোর প্রতিস্থাপন অত্যন্ত জরুরি। পুরোনো ইঞ্জিনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন, খুচরা যন্ত্রাংশের অভাব রয়েছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে এগুলো লাভজনক নয়।
২০১৩ সালে চীন থেকে আনা ২০ সেট ডেমু ট্রেন ছয় বছরের মধ্যেই অকেজো হয়ে গেলে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রায় ৬০০ কোটি টাকা অপচয় হয়েছিল। এবার রেলওয়ে ২০টি মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক ইঞ্জিন চীনের অনুদানে আনার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে
মিটারগেজ লাইনগুলো ডুয়েলগেজে রূপান্তরে বিলম্ব হওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে ২০৫৫ থেকে ২০৬০ সাল পর্যন্ত মিটারগেজ ট্রেন চালু রাখতে হবে। ফলে নতুন ইঞ্জিন আনা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে বলেও জানিয়েছে দায়িত্বশীল সূত্র।
আরও পড়ুন
চীনের প্রেক্ষাপট ও সামঞ্জস্যের প্রশ্ন
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চীনের জাতীয় রেলওয়ে নেটওয়ার্কে মিটারগেজ ইঞ্জিন ব্যবহৃত হয় না। শুধুমাত্র কিছু শিল্পাঞ্চল এলাকায় এই ধরনের ইঞ্জিন ব্যবহার হয়। চীনের জাতীয় রেলওয়ে মূলত স্ট্যান্ডার্ড গেজ (১.৪৩৫ মিটার) ব্যবহার করে। এই প্রশস্ত গেজ হাই-স্পিড ট্রেন ও ভারী কার্গো পরিবহনের জন্য উপযুক্ত। এই স্ট্যান্ডার্ড গেজ আমাদের মিটারগেজ লাইনের (১ মিটার) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা: ফিজিবিলিটি জরুরি
এদিকে, চীন থেকে আনতে যাওয়া ইঞ্জিন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আমরা অনুদান নিই বা কিনে নিই। যেভাবেই নিই না কেন, সেটা আমাদের জলবায়ু ও রেলপথের সঙ্গে মিলবে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। এটা টেকনিক্যাল বিষয়। টেকনিক্যালি এর সম্ভাবনা দেখা উচিত।
এ বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা অনুদানে আনি বা যেভাবেই আনি না কেন, ইঞ্জিনগুলো আমাদের পরিবেশের সঙ্গে কতটুকু খাপ খাইয়ে চলতে পারবে, সেটা প্রযুক্তিগত দিক থেকে দেখতে হবে। বিশেষ করে ইঞ্জিনের ক্যাবে চালকের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা আছে কি না এবং চালক কতটুকু আরামবোধ করবেন— বিষয়গুলো দেখতে হবে। এটা আশা বা নিরাশার বিষয় নয়। এজন্য ছোটখাটো হলেও একটি সম্ভাব্যতা যাচাই (ফিজিবিলিটি স্টাডি) করা উচিত।’
প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৭২৩ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দেবে ৪৯৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা এবং চীনের অনুদান হিসেবে থাকবে এক হাজার ২২৫ কোটি ৬ লাখ ১০ হাজার টাকা। প্রকল্পের মেয়াদকাল ধরা হয়েছে জুলাই ২০২৫ থেকে জুন ২০২৯ পর্যন্ত
তিনি আরও বলেন, অনুদানের হলেও ভ্যাট-ট্যাক্স আমাদেরই দিতে হবে। যদি সেটা সঠিকভাবে না চালাতে পারি এবং রক্ষণাবেক্ষণের বোঝা আমাদের ওপর পড়ে, তাহলে তা খুব বেশি কার্যকর হবে না।
লোকো মাস্টারদের উদ্বেগ: প্রশিক্ষণ ও যন্ত্রাংশ সংকট
বাংলাদেশে ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত লোকো মাস্টাররা বলছেন, সংকটের কথা উল্লেখ করে ২০২০ সালে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ৩০টি মিটারগেজ ইলেকট্রো-মোটিভ ডিজেল (ইডিএম) ইঞ্জিন আনা হয়। পাঁচ বছর না পেরোতেই সেগুলোর বেহাল দশা, এমনকি দুই বছর আগে থেকেই সমস্যা শুরু হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘একটা ইঞ্জিন এনে যদি ২০ বছর না চালানো যায়, তাহলে তো লস। শুধু তো ইঞ্জিন আনলেই হবে না, স্পেয়ার পার্টসও পেতে হবে। রাস্তায় ইঞ্জিন খারাপ হতেই পারে নানা কারণে। কিন্তু যদি স্পেয়ার পার্টসের অভাবে সেগুলো বসে থাকে, তাহলে তো পুরোটাই লস।’
আরও পড়ুন
‘গতবার কোরিয়া থেকে আনা ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনগুলোর কোনো পার্টস নেই। জোড়াতালি দিয়ে কোনোমতে চলছে, তার মধ্যে অর্ধেক বসে গেছে। পাঁচ বছরেই এই অবস্থা! এখন মিটারগেজ ইঞ্জিনের সংকট, ট্রেন বন্ধ। মন্ত্রণালয়ের প্রতি আমাদের দাবি থাকবে, যেখান থেকেই ইঞ্জিন আনেন না কেন, পার্টস যেন নিয়মিত থাকে। আমাদের দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে রাখার ব্যবস্থা থাকতে হবে। পাশাপাশি লোকোমাস্টারদের নতুন ইঞ্জিনের বিষয়ে প্রশিক্ষণ করাতে হবে।’
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের বৈঠক ও সিদ্ধান্ত
সম্প্রতি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে—
• প্রকল্পের শিরোনাম নির্ধারণের আগে নিশ্চিত করতে হবে ২০টি ইঞ্জিন সরবরাহ করা হবে, নাকি শুধু অর্থায়ন করা হবে এবং যৌক্তিকভাবে বাস্তবায়নকাল নির্ধারণ করতে হবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মোট ৩০৬টি ইঞ্জিনের মধ্যে ১৭৪টি হলো মিটারগেজ। এই মিটারগেজ ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে ১২৪টির বয়স ২০ বছরের বেশি এবং ৬৮টির বয়স ৪০ বছরেরও বেশি। এগুলোর প্রতিস্থাপন অত্যন্ত জরুরি। পুরোনো ইঞ্জিনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন, খুচরা যন্ত্রাংশের অভাব রয়েছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রে এগুলো লাভজনক নয়
• প্রকল্পের বর্ণনা, অফিস সরঞ্জাম ও জনবলের বেতন সংক্রান্ত বিষয় বাদ দিতে হবে।
• প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (পিডিপিপি) ৬নং অনুচ্ছেদে রেলওয়ে মাস্টার প্ল্যান, এসডিজি এবং সরকারি পরিবহন নীতির আলোকে তথ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
• পিডিপিপি’র ৭নং অনুচ্ছেদে ইঞ্জিন ও ক্যারেজ সংগ্রহের তথ্য, সম্ভাব্য অর্থায়নকারী দেশের নাম, ১১নং অনুচ্ছেদে মে ২০২৩-এ আইআইএফসি কর্তৃক সম্পন্ন সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের (ফিজিবিলিটি স্টাডি) তথ্য এবং ১২নং অনুচ্ছেদে চীনা ইঞ্জিন সংগ্রহের পর রেলওয়েতে মোট ইঞ্জিনের সংখ্যা, খুচরা যন্ত্রাংশের পরিধি বৃদ্ধি, ১০ বছরের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
• জিওবি (GoB) খাত থেকে যানবাহন ক্রয় ও সংশ্লিষ্ট ব্যয় বাদ দিতে হবে।
রেলপথ সচিবের বক্তব্য
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথ সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ওটার প্রস্তুতি হিসেবে আমাদের এখান থেকে প্ল্যানিং কমিশনে গেছে। পিডিপিপি প্ল্যানিং উপদেষ্টা অ্যাপ্রুভ করেছেন। তারপর সেটা ইআরডিতে গেছে। ইআরডি এখন চাইনিজ এম্বাসির মাধ্যমে চায়না সরকারকে পাঠাবে।’
চীন থেকে আনা ডেমুর অভিজ্ঞতা খারাপ— এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা তো ডেমু না, ইঞ্জিন। চায়না তো হাই-স্পিড ট্রেন চালাচ্ছে। চায়নায় রেল নেটওয়ার্ক খুবই ভালো। চায়না, ভিয়েতনাম, আমেরিকা বা রাশিয়া যেখান থেকেই পারি না কেন, আমাদের ইঞ্জিনগুলো লাগবে। বিশেষ করে মিটারগেজ, আমরা খুবই চেষ্টা করছি।’
লোকোমাস্টারদের প্রস্তাব
নতুন ইঞ্জিন কেনার ক্ষেত্রে লোকোমাস্টারসহ সরাসরি ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্তদের সংগঠন বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন গত ১২ আগস্ট বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালকের কাছে তাদের মতামত তুলে ধরে। সেখানে বলা হয়—
• ডিজাইন: নতুন ইঞ্জিন ডিজাইন ২৯০০ বা ৬৬০০ সিরিজের মতো হতে হবে। দৈর্ঘ্য ২৯০০ সিরিজের মতো হলে লং হুড সমস্যা কম হবে। প্রয়োজনে ডাবল ক্যাবও আনা যেতে পারে।
আরও পড়ুন
• ক্যাব সুবিধা: ক্যাবে উন্নত এসি, কার্যকর ফ্যান, দরজা-জানালা এবং যথেষ্ট উচ্চতা থাকতে হবে। লোকো মাস্টার (এলএম) ও অ্যাসিস্ট্যান্ট লোকো মাস্টার (এএলএম) সহজে একে-অপরকে দেখতে ও সিগনাল বিনিময় করতে যেন সক্ষম হন। ব্রডগেজের মতো ইনস্পেক্টর সিট থাকলে ভালো।
• মানসম্মত শৌচাগার: দীর্ঘ ও বিরতিহীন ট্রেন চলাচলে ক্রুদের স্বাস্থ্যের জন্য ইঞ্জিনে মানসম্মত শৌচাগার থাকা আবশ্যক।
• নিরাপত্তা: নিরাপত্তার জন্য শক্তিশালী ক্যাব ফ্রেম এবং দুর্ঘটনায় সামনের ও পিছনের প্রেশার পাইপ অকার্যকর না হওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ
• ট্রাকশন সিস্টেমে ছয়টি মোটরের বেশি হর্স পাওয়ার থাকা প্রয়োজন, যাতে ১–২টি মোটর অকার্যকর হলেও পর্যাপ্ত গতি পাওয়া যায়।
• ব্রেক সিস্টেমে এয়ার ও ভ্যাকুয়াম ব্রেকের পাশাপাশি ৬৬০০ সিরিজের মতো ডাইনামিক ব্রেক সংযুক্ত করতে হবে।
• ক্যাব প্রযুক্তিতে রোটেটিং সিট, উন্নত ভিউ ও কন্ট্রোল প্লেসমেন্ট, চার্জিং পোর্ট এবং স্টেশনের সাথে রেডিও বা ওয়াকিটকি সংযোগ নিশ্চিত করতে হবে। রাত, বৃষ্টি ও কুয়াশায় ভালো ভিউ নিশ্চিত করতে লুক আউট গ্লাস, এলইডি প্রজেক্টর লাইট ও কার্যকর উইন্ডো উইপার থাকবে।
• ফ্রন্ট ও রিয়ার ভিউ ক্যামেরা সংযোগ, জ্বালানি তেল, লুব্রিকেটিং অয়েল ও ওয়াটার লেভেল ম্যানুয়ালি চেকের ব্যবস্থা, স্পেয়ার পার্টস সরবরহ এবং চলার সময় রানিং ক্রু ও মেইনটেন্যান্স স্টাফদের জন্য টেকনিক্যাল ট্রেনিংসহ ফ্যাক্টরি টিউটোরিয়ালে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
এমএইচএন/এমএআর/
