নির্বাচনে পরাশক্তি বা কোনো এজেন্সির প্রভাব বিস্তারের আশঙ্কা নেই

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এক নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা হয়। বিগত স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার, যার ওপর অর্পিত হয় রাষ্ট্র মেরামত এবং একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করার বিশাল দায়িত্ব। প্রায় ১৫ মাসের এই সময়কালে সরকার একদিকে যেমন বিচার বিভাগীয় ও প্রশাসনিক সংস্কারের ভিত্তি স্থাপন করেছে, অন্যদিকে দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার চেষ্টাও করছে। তবে এই পথ মসৃণ ছিল না; গুজব, মিথ্যাচার, অর্থনৈতিক চাপ এবং নির্বাচনকালীন স্থিতিশীলতা নিয়ে সংশয়— সবমিলিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে ছিল সরকার।
গুরুত্বপূর্ণ এই সন্ধিক্ষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম ঢাকা পোস্টের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রের ভেতর-বাইরের নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি তুলে ধরেছেন সরকারের ১৫ মাসের চ্যালেঞ্জ ও সাফল্য, আসন্ন নির্বাচন ঘিরে নানা সংশয়, জাতীয় পার্টির ভূমিকা, ‘বিদেশিদের কাছে ফরেন পলিসি বর্গা না দেওয়ার’ প্রত্যয় এবং নতুন বাংলাদেশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কথা। নিজস্ব প্রতিবেদক মুছা মল্লিকের নেওয়া এই সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্র, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও অর্থনীতির নানা দিকও।
ঢাকা পোস্ট : প্রেস সচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় এক বছর দুই মাস সময় অতিবাহিত হলো। এই সময়ের সফলতা বা ব্যর্থতা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শফিকুল আলম : সফলতা কী, সেটা আপনারা বলতে পারবেন। আপনি যেটাকে ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন, অন্য কেউ হয়তো সেটাকে সফলতা হিসেবে দেখছেন। এগুলো আপেক্ষিক জিনিস। আমি যখন এই পদটা ছেড়ে দেব, তখন বিচার করা যাবে— আমি কতটুকু সফল বা ব্যর্থ। আমি যেটা বুঝি, প্রায় ১৫ মাস আমি এই দায়িত্ব পালন করছি। এই সময়ে আমি আমার সেরাটা দিয়েছি। আগে তো প্রেস সচিব পদটা ততটা সামনে আসেনি। সেই জায়গায় আমরা চেষ্টা করেছি এই কাজের যে সুযোগ; সেটার পুরোপুরি ব্যবহার করতে। ফলে যেটা হয়েছে— দিনরাত আমার এই কাজেই সময় ব্যয় হয়েছে।
ঢাকা পোস্ট : এই সময়ে কোন কাজটি করতে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?
শফিকুল আলম : সোশ্যাল মিডিয়ার মিথ্যা নিউজ! সারাক্ষণ মিথ্যার পর মিথ্যা যেসব নিউজ (খবর) উপস্থাপিত হয়েছে, সেটাকে সীমিত রিসোর্স দিয়ে ট্যাকেল (মোকাবিলা) করাটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।
ঢাকা পোস্ট : এক্ষেত্রে কাউন্টার ন্যারেটিভ দাঁড় করানো যেত না?
শফিকুল আলম : কাউন্টার ন্যারেটিভ দাঁড় করাতে তো আপনার রিসোর্স লাগবে। এই কাজগুলো করতে অনেক মানুষের প্রয়োজন হয়। দিনে হয়তো ফেইক নিউজ (ভুয়া খবর) হচ্ছে ১০০ থেকে ২০০টা। এটাকে আপনি কীভাবে মোকাবিলা করবেন?
পাশাপাশি, এই লোকগুলোকে আপনি জানতেন দায়িত্বশীল গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে। কিন্তু তারা তো রেসপনসিবল (দায়িত্বশীল) সাংবাদিকতা করছেন না। মিথ্যা নিউজ দিচ্ছেন। আগুনে বাতাস দিচ্ছেন। তারা দেখছেন যে, প্রফেসর ইউনূসের মেয়াদকালে ফ্রিডম অব স্পিচ (বাক স্বাধীনতা) ভালোমতো থাকবে। কেউ আমাদের মুখ বন্ধ করতে আসবে না। ফলে তারা ‘যা ইচ্ছা তাই’ সাংবাদিকতা করছেন।
ঢাকা পোস্ট : আপনি আগুনে বাতাস দেওয়ার প্রসঙ্গ এনেছেন। আপনার কি মনে হয় বিগত সরকারের কেউ আগুনে বাতাস দিচ্ছে?
শফিকুল আলম : আমরা কিছু কিছু সাংবাদিককে চিনি, যারা আগের সরকার থেকে পূর্বাচলে প্লট পেয়েছেন। সারাজীবনে যে আয় করতে পারতেন না, কিন্তু একটি প্লট পেয়ে তার দুই জীবনের আয় হয়ে গেছে। সুতরাং আপনি তো প্রকৃতিগতভাবে ধরেই নিতে পারেন, তিনি আগের সরকারের দোসর হিসেবে কাজ করছেন। সুতরাং, তারা সেই সরকারের একটি ন্যারেটিভ পুশ করার চেষ্টা করবেন। আগের সরকারের কোনো ব্যর্থতার গল্পই তার কাছে আসবে না। এতগুলো লোককে যে খুন করল, গুম করল, সেগুলোর ধারেকাছেও তিনি যাবেন না। তার চিন্তা, কীভাবে এই সরকারকে সমালোচনার মুখে ফেলা যায়। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, যেটা সমালোচনা হওয়ার যোগ্য না, সেই বিষয়েও তিনি সমালোচনা করার চেষ্টা করছেন।
ঢাকা পোস্ট : ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে এখনও অনেকে সংশয়ের কথা বলছেন। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
শফিকুল আলম : এই সংশয়টা প্রো-আওয়ামী সাংবাদিকরাই জনমনে পুশ করছেন। তারা এটাকে একটা খেলা হিসেবে দেখছেন। আমরা বারবার বলছি যে, নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হবে। এতে কোনো সন্দেহ নাই। সেই লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। এ বিষয়ে আমাদের আন্তর্জাতিক অংশীজনরা সমর্থন দিচ্ছেন। আপনি যদি গ্রামে যান, তাহলে দেখবেন যে, নির্বাচনের হাওয়া বইছে। পরশুদিন আমি গ্রাম থেকে আসলাম। দেখলাম, গ্রামে পুরো নির্বাচনের হাওয়া বইছে। এরপরও তারা কীভাবে বলেন যে, নির্বাচন হবে না? কনফিউশন (বিভ্রান্তি) ছড়ানো হচ্ছে। এই কনফিউশন আসার কারণ, তারা পতিত স্বৈরাচারের দোসর। ঘুরেফিরে এই কয়টা লোকই এসব ছড়াচ্ছেন। তারা বলছেন, আমার জীবনেও বিশ্বাস হয় না নির্বাচন ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হবে। এসব লোকের ইউটিউবেও উপস্থিতি ‘পাক্কা’। এসবের মধ্যে দিয়ে তারা বাংলাদেশে একটা কেওয়াজ বা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন। মূলত, এগুলো করলে আওয়ামী লীগ (বেনিফিটেড) লাভবান হয়।
ঢাকা পোস্ট : নির্বাচনে মাঠপ্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আগেও আমরা দেখেছি, জেলা প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে বেশ অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। সাবেক জনপ্রশাসন সচিব বিতর্কিত হয়েছেন। সচিবালয়ে হট্টগোলও হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের মাঠপ্রশাসনে পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা আছে কি না? যদি থাকে, তাহলে সমালোচনা এড়াতে সরকার কোন পথে এগোচ্ছে?
শফিকুল আলম : আগের জনপ্রশাসন সচিব বিতর্কিত কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কি না, আমি জানি না।
ঢাকা পোস্ট : এটা নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে...
শফিকুল আলম : ওই সংবাদ নিয়ে আমরা তদন্ত করেছিলাম। ওইটা একটা মিথ্যা নিউজ। তারা (জাতীয় দৈনিক) এটা নিয়ে ‘সরি’ও বলেনি। আমরা তৃতীয় পক্ষ দিয়েও তদন্ত করিয়েছিলাম। তারা এটা নিয়ে ন্যূনতম দুঃখপ্রকাশও করেনি। ওই যে বললাম, স্বাধীনতা পেয়ে সাংবাদিকতা-কে যথেচ্ছ ব্যবহার!
নির্বাচন সামনে রেখে কতটুকু শক্তির দরকার হবে, ডিসিদের (জেলা প্রশাসক) বদলি করার দরকার হবে কি না— এটা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ই বুঝবে। তারা তাদের মতো করে সিদ্ধান্ত নেবে।
ঢাকা পোস্ট : জেলা প্রশাসক নিয়োগে অনেক কর্মকর্তার মধ্যে অসন্তোষ ছিল। এই অসন্তোষ এড়াতে সরকার তাহলে কী করছে?
শফিকুল আলম : হট্টগোল হয়েছে কি না, আমার জানা নেই। তবে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যথেষ্ট নিরপেক্ষতা বজায় রেখে তাদের কাজ করছে। এখন পর্যন্ত এমন কোনো বিতর্কিত কাউকে তারা মাঠে পাঠায়নি, যা নিয়ে বড় বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা পোস্ট : জাতীয় পার্টি ছাড়া সরকার গঠন করলে সে সরকার টিকবে না— মন্তব্য করেছেন জাপার একাংশের মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী। তার এই মন্তব্য কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শফিকুল আলম : শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে আমি তত ভালো চিনি না। গত ১৫ বছরে হাসিনার প্রতিটি নির্বাচনের বৈধতা দেওয়ার মূল কারিগর ছিল জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টির বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোই সিদ্ধান্ত নেবে। রাজনৈতিক দলগুলোই সিদ্ধান্ত নেবে তাদের কী করবে? তাদের ব্যাপারে যেটা সত্য, সেটা আমি বললাম। তারা আওয়ামী লীগের দোসর ছিল।
ঢাকা পোস্ট : আপনি বললেন, জাতীয় পার্টি ‘অবৈধ নির্বাচনের’ বৈধতা দিয়েছে। তাহলে তাদের নেতাকর্মীদের আইনের আওতায় আনতে সরকার কেন ব্যর্থ হচ্ছে?
শফিকুল আলম : যেহেতু তারা রাষ্ট্রের নাগরিক, সেহেতু তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না থাকলে তারা থাকবেন। কারও নামে যদি অভিযোগ থাকে, তিনি অন্যায় করেছেন, তাহলে তাকে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। তাদের (জাতীয় পার্টি) মূল দায় হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনের বৈধতা দেওয়া। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও মানুষ তাদের খারাপ বলছে। তাদের অপরাধের বিষয়গুলো পুলিশ দেখবে। দেশে জাতীয় পার্টির ভূমিকা কী হবে, সেটা অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলো ঠিক করবে।
ঢাকা পোস্ট : তাহলে জাতীয় পার্টিকে নিয়েই কি নির্বাচন হচ্ছে?
শফিকুল আলম : কেউ কি তাদের বাদ দিয়েছে?
ঢাকা পোস্ট : বাদ দেয়নি। কিন্তু জাপা মহাসচিব যেহেতু বলেছেন, ‘জাতীয় পার্টি ছাড়া সরকার গঠন করলে, সরকার টিকবে না’। এখানে তো তাদের ছাড়া নির্বাচন হতে পারে— সেই আশঙ্কার বিষয়টা স্পষ্ট।
শফিকুল আলম : তিনি একটা হাস্যকর কথা বলেছেন। তিনি যদি সবাইকে হাসাতে চান, তাহলে আর কী করার? আমরাও হাসলাম। ফেসবুকে দেখলাম এটা নিয়ে অনেকে ফটোকার্ড করেছে। আমিও সেটা শেয়ার দিয়েছিলাম। উনি আসলে সবাইকে হাসাতে চাচ্ছেন। জাতীয় পার্টিও একটা পার্টি..., ওরা তো দোসর ছিল।
ঢাকা পোস্ট : নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা বা অস্থিরতার ঝুঁকি সরকার দেখছে কি না?
শফিকুল আলম : আমরা দেখছি না। আমরা মনে করি, দেশে একটা সুন্দর নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশন ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেটা উপহার দেবে। সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও মিটিং হচ্ছে। প্রস্তুতিমূলক সভা হচ্ছে। পাশাপাশি রিটার্নিং অফিসার, পোলিং অফিসার, প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগের জন্য কাজ যথেষ্ট এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবারও দেখলেন যে, আরপিওতেও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ) বেশকিছু পরিবর্তন এসেছে। এসব পরিবর্তন বেশিরভাগ দল স্বাগত জানিয়েছে। সুতরাং, আমরা আশা করছি আমরা একটা ভালো নির্বাচন দেখব।
ঢাকা পোস্ট : গুম-খুনের ঘটনায় বিচারপ্রার্থী নাগরিকদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ কী? অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কি না?
শফিকুল আলম : আমরা গুম-খুনের বিচার করছি। হাসিনার আমলে বিচারহীনতা ছিল। এত গুম-খুন হয়েছে; কেউ কি বিচারের সম্মুখীন হয়েছিল? বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে কেউ কি বিচারের সম্মুখীন হয়েছিল? যারা বা যেসব সংস্থা এসবের সঙ্গে জড়িত, আমরা তো তাদের সবাইকে বিচারের সম্মুখীন করছি। এক্ষেত্রে আস্থা বাড়ার কথা, বাড়ছেও। আদালত ও দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছেই।
ঢাকা পোস্ট : প্রশাসনিক সংস্কার নিয়ে সরকার অনেক কথা বলছে। এখন পর্যন্ত কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে বলে মনে করেন?
শফিকুল আলম : অনেক কিছুই তো আমরা করছি। অনেক বিষয় আছে, আপনি টেরও পাননি, কিন্তু কাজগুলো হয়ে গেছে। আরেকটি হচ্ছে— আমরা আমলাতান্ত্রিক যে পরিবর্তন এনেছি, সেটা সবাইকে জানিয়েছি। আমরা দেখেছি, এগুলো যথেষ্ট প্রশংসিত হয়েছে। আমরা চাই, দেশের আমলাতন্ত্র নিরপেক্ষ থাকবে। তাদের দিয়ে যেন অন্যায়-অবিচারের কাজ করানো না হয়। আগে হাসিনার আমলে প্রশাসনকে দিয়েই নির্বাচন হয়েছে। অনেক অপরাধের বৈধতা দিয়েছে। অনেক চুরি-চামারি করিয়েছে।
আমরা চাই, প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকবে। রাজনৈতিক দলগুলো আসবে-যাবে, কিন্তু প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকবে। এক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রে যেসব সংশোধনী আনা দরকার, সেগুলো আনা হয়েছে।
ঢাকা পোস্ট : অন্তর্বর্তী সরকার অনেকগুলো সংস্কার কমিশন করেছে। কিন্তু অনেক কমিশনের কাজ এখনও দৃশ্যমান নয়। পুলিশ সংস্কার কমিশনেরও অনেক ভালো উদ্যোগ আলোর মুখ দেখছে না। অনেক সুপারিশ দীর্ঘসূত্রিতায় ঝুলে গেছে। এর কারণ কী বলে মনে করেন?
শফিকুল আলম : অনেকগুলো পরিবর্তন ইতোমধ্যে এসেছে। ক্রাউড ম্যানেজমেন্টে (জনসমাগম ব্যবস্থাপনা) দেখবেন কোনো লেথাল উইপেন (প্রাণঘাতী অস্ত্র) ব্যবহার করা হচ্ছে না। ৩০০ দিনে ১৬০০-এর বেশি প্রতিবাদ সভা হয়েছে। অনেকে প্রচুর জনবল নিয়ে এসে যমুনার সামনে হাজির হয়েছে। সারা শহরে তারা ট্রাফিক জ্যাম সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আমরা তো এটা নিয়মতান্ত্রিকভাবে সামলিয়েছি। পুলিশ এগুলো সুন্দরভাবে সুরাহা করেছে। এটা একটা ভাইটাল চেঞ্জ (গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন)। বাংলাদেশে স্ট্রিট ক্রাউড ম্যানেজমেন্টে এটা একটা বড় সংস্কার হয়েছে। এমন আরও অনেক সংস্কার হয়েছে। আমরা অনেক কিছু সবাইকে জানিয়েছি, সামনের দিনগুলোতেও আরও অনেক কিছু জানতে পারবেন।
ঢাকা পোস্ট : নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ও পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এ বিষয় সরকার কোন কৌশলে এগোচ্ছে?
শফিকুল আলম : রাজনৈতিক দল থাকলে মতভেদ থাকবে। এটা না হলে তো আমরা সবাই একটি দলই করতাম। সবাই কমিউনিস্ট পার্টি অব সোভিয়েত ইউনিয়নই করতেন। রাজনৈতিক দল থাকলে বিভিন্ন মত ও পথের অবস্থান থাকবে। রাজনৈতিক দলগুলোর এই মতভেদ বড় কোনো ইস্যু না। কিছু জায়গায় মতভেদ দূর করার চেষ্টা হচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় এটা এভাবেই থাকছে; কিছুই করার নেই। সবাই তো নির্বাচনমুখী। যারা যেভাবে নির্বাচন করে আসতে পারে, তারা তাদের মতকে সেভাবে প্রাধান্য দেবে। জনগণ সেভাবেই বেছে নেবে।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যারা বেশি ভোট পাবেন, তারা তাদের মতকে এখানে প্রাধান্য দেবেন। এগুলোর মধ্যে দোষের কিছু দেখছি না। এ কারণে যে আলোচনাগুলো হচ্ছে, সেগুলো নির্বাচন বিলম্ব করার আলোচনা নয়। নির্বাচন বানচালের আলোচনা নয়। এগুলো হেলদি ডিবেট (সুস্থ বিতর্ক)। ন্যাশনাল কনসেন্সাস কমিশন (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন) সবার সঙ্গে বসেছেও। সেখানে জুলাই সনদ কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, সেসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এটা নিয়েও দেখবেন অনেক মতভেদ আসছে। একেক পার্টি একেক কথা বলছে। এগুলো কতটা কমানো যায় এবং সবাইকে একই জায়গায় রেখে নির্বাচনটা করা যায়, সেটাই দেখছি আমরা। নির্বাচন ঠিক সময়ে হবে, সবাই সেটাই চাচ্ছে।
ঢাকা পোস্ট : মিশর, থাইল্যান্ড, ইথিওপিয়ার মতো দেশগুলো বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের ভিসা দিতে চাচ্ছে না। এর কারণ কী বলে মনে করেন?
শফিকুল আলম : এটা কি শুধু এই সরকারের সময়ে হয়েছে? এটা নিয়ে যদি অনুসন্ধান করে দেখেন, কোন সময়ের ঘটনা? যদি এই সময়ের হয়, তাহলে এটা কি শুধু বাংলাদেশের জন্য, নাকি পৃথিবীর সব দেশের জন্য? সেই খবরটা দেখতে হবে। কিছুদিন আগে শ্রীলঙ্কাতে এমনটা হয়েছে। অনেকে বলেছে, তারা আমাদের অন-অ্যারাইভাল ভিসা বাদ দিয়েছে। কিন্তু দেখেন, তারা আশপাশের সব দেশের জন্য এটা করেছে। বাংলাদেশকে ‘সিঙ্গেল আউট’ করছেন কীভাবে? শেখ হাসিনার যারা দোসর, তারা এই কাজগুলো করছে।
ঢাকা পোস্ট : সরকার কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কি না?
শফিকুল আলম : এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য যে পরিমাণ কূটনৈতিক ইফোর্ট (কূটনৈতিক প্রচেষ্টা) দরকার, সেটা দেওয়া হচ্ছে। আমরা আমাদের চেষ্টাটা করছি। পাশাপাশি সেখানে আমাদের যে দূতাবাসগুলো আছে, তারাও প্রো-অ্যাকটিভ রোল (সক্রিয় ভূমিকা) নিচ্ছে। আশা করা যায়, সামনে আমরা একটা ভালো ফলাফল পাব।
ঢাকা পোস্ট : দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও নাজুক— মনে করছেন জনগণ। এমন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিপূর্ণ সংস্কার (বিশেষ করে পুলিশ) প্রয়োজন বলে মনে করেন কি না? যদি না হয়, তাহলে এই বাহিনী দিয়ে জাতীয় নির্বাচন আরও ঝুঁকিপূর্ণ হবে কি না?
শফিকুল আলম : আমি মনে করি, পুলিশ খুব ভালো অবস্থায় আছে। পরিসংখ্যান দেখলে বুঝবেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক স্থিতিশীল ও ভালো আছে। এটা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নাই। গত ১৫ মাসের ক্রাইমের পরিসংখ্যান আমরা সবার সঙ্গে শেয়ার করেছি। এখানে দেখা যাচ্ছে, গত বছরগুলোর মতোই ক্রাইমের ধরনগুলো আছে। পুলিশ তার কাজটা খুব ভালোভাবেই করছে। পুলিশের কাজটা আরও ভালো কীভাবে করা যায়, প্রায় প্রতিদিনই সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তারা তাদের কাজের দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তারাও আত্মবিশ্বাসী যে, দেশ ও জাতিকে একটা সুন্দর নির্বাচন উপহার দিতে পারবে। বর্তমান সরকার বলেন, পুলিশ প্রশাসন বলেন, বিভিন্ন এজেন্সি বলেন, নির্বাচন কমিশন বলেন— সবাই এটা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী।
ঢাকা পোস্ট : জাতীয় নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন পরাশক্তি ও নানা এজেন্সির প্রভাব বিস্তারের কথা প্রায়ই শোনা যায়। আসন্ন নির্বাচনে এমন প্রভাবের শঙ্কা রয়েছে কি না?
শফিকুল আলম : না। আমরা এমন কিছুই দেখছি না।
ঢাকা পোস্ট : যেহেতু অনেক রাজনৈতিক দল অনেক উপদেষ্টার কার্যক্রম নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছে। সেহেতু নির্বাচনকালীন সরকারে কি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারাই থাকবেন, নাকি সংযোজন-বিয়োজনের সম্ভাবনা আছে?
শফিকুল আলম : সংযোজন-বিয়োজনের কথা আমি জানি না। আমি যেটা জানি, নির্বাচনে এই উপদেষ্টা পরিষদই থাকবেন। যদি সামনে সংযোজন-বিয়োজন হয়, তখন আপনারা জানবেন। এখন পর্যন্ত আমি এতটুকুই জানি যে, তারাই থাকবেন এবং একটা ভালো নির্বাচন উপহার দেবেন।
ঢাকা পোস্ট : সম্প্রতি বিজিএমইএ’র এক সাবেক পরিচালক বলেছেন, ‘বিদেশে ক্রেতারা মূলত আগামী নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। এই ১৪ মাসে তেমন নতুন কোনো বিনিয়োগ আসেনি, বরং অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে এবং চাকরি হারিয়েছেন বহু শ্রমিক।’ তার এই মন্তব্যকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
শফিকুল আলম : উনার পড়ালেখা যে খুব কম, সেটা তিনি প্রমাণ করেছেন। নতুন বিনিয়োগ আসেনি, তিনি কোথা থেকে এই পরিসংখ্যান পেয়েছেন? তার কোনো রাজনৈতিক অ্যাম্বিশন (রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা) আছে কি না, আমি জানি না। তিনি কি বিডার কোনো পরিসংখ্যান দেখাতে পারেন? আমরা তো দেখাচ্ছি যে, প্রথম ছয় মাসের তুলনায় গত ছয় মাসে ৬১ শতাংশ বেশি বিনিয়োগ এসেছে। এটা কি এমনি এমনি এসেছে? আমরা কি তাহলে মিথ্যা কথা বলছি? একটি সরকার কি মিথ্যা কথা বলতে পারে? আপনি এসে তো যাচাই করবেন। আমরা তো সারাজীবন থাকব না। তখন এসে তো বলবেন, প্রেস সচিব বা বিডা থেকে মিথ্যা কথা বলা হয়েছে। উনি যে মন্তব্য করেছেন, সেটা মুখরোচক। একজন এসে একটা কথা বলল, আর অমনি মুখরোচক কিছু বলে দিলাম...।
লাখ লাখ লোক চাকরি হারাচ্ছেন, বলেছেন। সেটার নমুনাটা কোথায়? আমরা তো মনে করি, গত ১৪ মাসে আরও বেশি লোক চাকরি পেয়েছে। বেশি যদি না পাবে, তাহলে রপ্তানি কীভাবে বাড়ল? গত অর্থবছরে ৯ শতাংশের মতো রপ্তানি বেড়েছে। এই ৯ শতাংশ বাড়াতে কি মেশিন এসে কাজ করেছে? অতিরিক্ত লোক লাগেনি? এসব এমপ্লয়মেন্টটা (কর্মসংস্থান) কোথা থেকে হয়েছে? বাংলাদেশের এখান থেকেই তো হয়েছে। উনি যেটা বলেছেন, এটা হাস্যকর একটা বিষয়। আমি এটা পড়েছি। এটা হাস্যকর। উনি তো একটা দায়িত্বশীল জায়গায় ছিলেন। এটা বুঝেন যে, বিজিএমইএ-তে কী ধরনের নেতৃত্ব ছিল আগে!
ঢাকা পোস্ট : জনগণ যে নতুন রাষ্ট্রের আশা করেছে, অন্তর্বর্তী সরকার সেটা কতটা করতে পেরেছে?
শফিকুল আলম : আমি মনে করি, এই সরকারের বড় একটি সাফল্য হচ্ছে বিপ্লব-পরবর্তী একটি দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ঠিক রাখা। এটা খুবই প্রয়োজনীয় ছিল। যে কোনো বিপ্লবের পরে অনেকেই অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা করে। সেই জায়গায় দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রয়েছে। আমি মনে করি, বাংলাদেশে এই সরকার যা করেছে, সামনের দিনগুলোতে সেটার আরও ভালো মূল্যায়ন হবে।
এই সরকারের আরেকটি বড় সফলতা হচ্ছে— ভূমিকম্পের মতো বিধ্বস্ত একটি দেশের অর্থনীতিকে ঠিক করা। একটি লাইনচ্যুত অর্থনীতির ট্রেনকে লাইনে নিয়ে আসা। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছর পর্যন্ত দেশের দারিদ্র্যের অবস্থা খারাপ ছিল। কিন্তু এখন সেটা ভালো হচ্ছে। তাদের প্রতিবেদনেই বোঝা যাচ্ছে, আমরা সঠিক পথেই আছি। ব্যাংকগুলোর মুনাফা দেখেন। তারা ভালো মুনাফা পাচ্ছে। শেয়ার বাজারে এক্সচেঞ্জ রেটে স্থিতিশীলতা এসেছে। যে স্থিতিশীলতাটা ছিল না। ডলার রেটটা ১২১-১২২ টাকার মধ্যে আছে। এর হেরফের হচ্ছে না। আমাদের রিজার্ভ বাড়ছে। অর্থনীতি অনেকটা রিকভারি-তে (পুনরুদ্ধার) আছে। এরপর দেখেন, এ সরকার একটা সুন্দর ফরেন পলিসি উপহার দিয়েছে। আমরা আগে অন্য দেশের কাছে ফরেন পলিসি বর্গা দিয়েছিলাম। আমরা সেই জায়গায় নেই এখন।
গত ১৫ বছরে গুম-খুন ও অপশাসনের যে সংস্কৃতি ছিল, সেটার একটা বিচার ও জবাবদিহিতার জায়গা তৈরি করেছি। কোর্ট (আদালত) এগুলো নিয়ে সিরিয়াসলি তদন্ত করে দেখছে। চার্জ হচ্ছে। ট্রায়াল হচ্ছে। মানবাধিকার পরিস্থিতির অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। কেউ গুম হয়নি। কোনো এক্সট্রা জুডিশিয়াল মার্ডার (বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড) হয়নি। আমরা তো দেখছি, দ্রুত উন্নয়ন হয়েছে। দেশে এখন গণতন্ত্র ফিরে এসেছে। এখন আমরা গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত।
ঢাকা পোস্ট : আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এটা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি লিখেছে সিপিজেসহ ছয়টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। তাদের এই আহ্বানকে কীভাবে মূল্যায়ন করছে সরকার?
শফিকুল আলম : তারা তাদের অবজারভেশন (পর্যবেক্ষণ) দিয়েছে। আমরা সেটা দেখেছি। যারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন, এটা তাদের একটা রুটিনওয়ার্ক। তারা এগুলো করে যান। স্থানীয় পর্যায়ের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দিকে তাকালে দেখবেন, রুটিন কিছু স্টেটমেন্ট দিতে হয় এবং দেয়। এটা নিয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই। তারা বলেছেন, আর আমরা শুনেছি— এটাই।
ঢাকা পোস্ট : ভবিষ্যতে বাংলাদেশে কেমন রাষ্ট্রব্যবস্থা দেখতে চান? তার কোনো নকশা কি এই সরকার করেছে?
শফিকুল আলম : অবশ্যই আমরা নতুন যে বাংলাদেশ দেখতে চাই, তার একটা ভিত্তিপ্রস্তর গত ১৫ মাসে তৈরি করেছি। দেশের মানবাধিকার অবস্থার উন্নয়ন করেছি। দেশে খুন-গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নেই। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো তাদের আইনি সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে কাজ করছে। দেশে নতুন একটা রাজনৈতিক সমঝোতা কাজ করছে। গণতন্ত্র কেন বিকশিত হতে ব্যর্থ হয়েছে, কেন দেশে হাসিনার মতো একটা মনস্টার (রাক্ষস) তৈরি হলো— সেসব উপলব্ধি জাগানোর জন্য আমরা জুলাই সনদ করেছি।
জুলাই আন্দোলনের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল, সেটাকে ধারণ করেই জুলাই ঘোষণাপত্র করা হয়েছে। প্রতিটি বিষয়ে দেখবেন বিল্ডিং ব্লক (সিস্টেম তৈরির মৌলিক উপাদান) তৈরি হয়েছে। সামনের সরকার এই কাজটা আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা মনে করি, এটা সামনে আরও বিস্তৃত হবে।
ঢাকা পোস্ট : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
শফিকুল আলম : আপনাকেও ধন্যবাদ।
