নির্বাচনী ‘প্ল্যাটফর্মে’ কার সঙ্গে যাবে এনসিপি?

আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে পূর্ণোদ্যমে প্রস্তুতিতে নেমেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ইতোমধ্যে দলটি কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করেছে। সব আসনে উপযুক্ত প্রার্থী খুঁজে বের করার কাজও শুরু হয়েছে। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে সম্ভাব্য প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে নিয়মিতভাবে। তবে, আসন সমঝোতা কার সঙ্গে হবে, তা এখনও ঠিক করেনি এনসিপি।
আবার ‘গণভোট কবে হবে’— সে প্রশ্নে এনসিপির তেমন মাথাব্যথা নেই বলে দলের একাধিক নেতা জানিয়েছেন। তাদের ভাষ্যমতে, গণভোট নির্বাচনের দিনও হতে পারে, নির্বাচনের আগেও হতে পারে। তবে, এটিই মূল বিষয় নয়। চলতি মাসেই (নভেম্বর) দলীয় প্রতীকে প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করবে দলটি। ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে সম্ভাব্য নির্বাচনকে সামনে রেখে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে শক্তভাবে নির্বাচনী প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানোই দলটির মূল লক্ষ্য— ঢাকা পোস্টের কাছে এমন মতামত ব্যক্ত করেছেন একাধিক সিনিয়র নেতা।
এনসিপি’র যুগ্ম সদস্য সচিব ও মিডিয়া সেলের সম্পাদক মুশফিক উস সালেহীন বলেন, ‘নির্বাচনে চূড়ান্ত প্রার্থী কবে ঘোষণা করা হবে, সেটা এখন বলতে পারছি না। আমাদের কাজ চলছে। শেষ হলে ঘোষণা করা হব। তবে, ৩০০ আসনেই প্রার্থী নির্বাচনের কাজ জোরেশোরে চলছে। আমরা ধাপে ধাপে হয়তো এটা ঘোষণা করব। চলতি মাস (নভেম্বর) থেকেই শুরু করব।’
সারাদেশে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাইয়ে এনসিপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে সফর করছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীদের সরাসরি সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন এবং তাদের যোগ্যতা, জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক অবস্থান যাচাই করছেন। দলের সিনিয়র নেতাদের ভাষ্যমতে, প্রতিটি আসনে এমন প্রার্থী মনোনয়নের চেষ্টা চলছে যিনি স্থানীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য, সৎ, ত্যাগী এবং জনগণের পাশে থাকা রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত
এদিকে, গতকাল মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় জাতীয় নাগরিক পার্টিকে (এনসিপি) ‘শাপলা কলি’ প্রতীক দিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একইসঙ্গে নিবন্ধনের বিষয়ে দাবি-আপত্তি আহ্বান করে বুধবার (৫ নভেম্বর) পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পাশাপাশি কারও দাবি-আপত্তি থাকলে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত জানাতে বলেছে কমিশন। দাবি-আপত্তি নিষ্পত্তি হওয়ার পর চূড়ান্তভাবে নিবন্ধনের সনদ দেওয়া হবে।
ওই দিনই (মঙ্গলবার) এক ভিডিও বার্তায় দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। শাপলা কলি মার্কায় ইনশাআল্লাহ আমরা ৩০০ আসনে প্রার্থী দেব। আমরা প্রত্যেকটি জেলায়, প্রত্যেকটি আসনে সৎ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব দিচ্ছি। সারাদেশে জাতীয় নাগরিক পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে। এ মাসের মধ্যে (নভেম্বর) আমরা আমাদের প্রার্থীদের তালিকাও চূড়ান্ত করব।’
‘অল্প সময়ের মধ্যে আমরা মানুষের কাছ থেকে যে সাড়া ও সমর্থন পেয়েছি, আগামী নির্বাচনেও সেই প্রতিফলন পাব বলে প্রত্যাশা করি’— বলেন তিনি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০২৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) একটি ‘কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি’ গঠন করেছে। সেই কমিটি দলটির সার্বিক প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা, প্রার্থী বাছাই, মাঠ পর্যায়ের সমন্বয়, আইন ও প্রশাসনিক কার্যক্রম, মিডিয়া ও প্রচার কার্যক্রম তদারকির দায়িত্বে থাকবে। কমিটিতে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীকে প্রধান এবং ডা. তাসনিম জারাকে সেক্রেটারি করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন— আরিফুল ইসলাম আদীব, মাহবুব আলম মাহির, খালেদ সাইফুল্লাহ, এহতেশাম হক, অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আল আমিন, আলাউদ্দীন মোহাম্মদ, অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম মুন্না, অ্যাডভোকেট হুমায়রা নূর, সাইফুল্লাহ হায়দার ও অ্যাডভোকেট মো. তারিকুল ইসলাম।
আরও জানা গেছে, এনসিপি চলতি মাসেই নিজ দলের প্রার্থীদের নামের তালিকা ঘোষণা করবে। দেশজুড়ে যোগ্য প্রার্থীদের খোঁজ করছে দলটি। প্রাথমিকভাবে ১০০ থেকে ১৫০টি আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হতে পারে। তবে, দলটি ৩০০ আসনেই প্রার্থী ঘোষণা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ঢাকা-১১ ও দলের সদস্য সচিব আখতার হোসেন রংপুর-৪ আসন থেকে নির্বাচনে লড়বেন। দলের মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ঢাকা-১৮, সারজিস আলম পঞ্চগড়-১, হাসনাত আব্দুল্লাহ কুমিল্লা-৪, সারোয়ার তুষার নরসিংদী-২, আব্দুল হান্নান মাসুদ নোয়াখালী-৬, আরিফুল ইসলাম আদীব ঢাকা-১৪ আসন থেকে লড়বেন। ঢাকা-৯ আসন থেকে লড়তে পারেন ডা. তাসনিম জারা।
এছাড়া, কক্সবাজার-২ আসন থেকে এ এস এম সুজা উদ্দিন, কুমিল্লা-১০ থেকে জয়নাল আবেদীন শিশির, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ থেকে আতাউল্লাহ, গাজীপুর-৬ থেকে ইঞ্জিনিয়ার ফরহাদ সোহেল, ময়মনসিংহ-৪ থেকে ডা. জাহেদুল ইসলাম, ময়মনসিংহ-৯ থেকে আশেকীন আলম, নাটোর-৩ থেকে এস এম জার্জিস কাদের, সিরাজগঞ্জ-৬ থেকে এস এম সাইফ মোস্তাফিজ, কুড়িগ্রাম-৩ থেকে ডা. আতিউর রহমান মুজাহিদ নির্বাচনে লড়তে যাচ্ছেন।
এর আগে, ২৩৭টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। তারও আগে জামায়াতে ইসলামী আঞ্চলিকভাবে প্রার্থীদের তালিকা ঘোষণা করে। যদিও দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) ভোরে বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা প্রায় এক বছর আগেই এই তালিকা বিভিন্নভাবে আঞ্চলিকভাবে জানিয়ে দিয়েছি। চূড়ান্ত তালিকাটা সময়মতো ইনশাআল্লাহ কেন্দ্রের পক্ষ থেকে ঘোষণা করব। যেহেতু আমরা একা নির্বাচন করব না, আরও অনেককে ধারণ করব, দেশ ও জাতির স্বার্থে সবদিক বিবেচনা করেই চূড়ান্তভাবে যথাসময়ে আমরা চূড়ান্ত তালিকা ঘোষণা করব।’
এনসিপি সূত্রে জানা গেছে, অধিকাংশ আসনে বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীদের সঙ্গে লড়তে হবে তাদের প্রার্থীদের। জোরেশোরে সেই প্রস্তুতির পাশাপাশি ‘আসন সমঝোতা’ করার বিষয়টি নিয়েও আলোচনা চলছে।
সারাদেশে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাইয়ে এনসিপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে সফর করছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীদের সরাসরি সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন এবং তাদের যোগ্যতা, জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক অবস্থান যাচাই করছেন। দলের সিনিয়র নেতাদের ভাষ্যমতে, প্রতিটি আসনে এমন প্রার্থী মনোনয়নের চেষ্টা চলছে যিনি স্থানীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য, সৎ, ত্যাগী এবং জনগণের পাশে থাকা রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত। সাক্ষাৎকার পর্বে সম্ভাব্য প্রার্থীর ব্যক্তিগত সক্ষমতা, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, সংগঠনের প্রতি আনুগত্য এবং নির্বাচনী এলাকায় তাদের জনসম্পৃক্ততার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হচ্ছে।
তারা আরও বলেন, ভোটারদের আস্থা অর্জনে যোগ্য ও জনমুখী নেতৃত্বের প্রয়োজন। মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগত প্রভাব বা আর্থিক সামর্থ্যের চেয়ে যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
কক্সবাজার-২ আসনের প্রার্থী, চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব এ এস এম সুজা উদ্দিন এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দল যদি মনোনয়ন দেয়, তাহলে আমি আশাবাদী। কারণ, মহেশখালী-কুতুবদিয়ার মানুষ আমাকে ভালোবাসেন। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ জনপদ গড়ে তুলতে আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে।’
জোট কিংবা আসন বিন্যাস নিয়ে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি আসলে দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। তবে, এখন পর্যন্ত এমন কিছু হয়নি।’
খালেদা জিয়ার আসনে প্রার্থী দেবে না এনসিপি
এদিকে, বুধবার (৫ নভেম্বর) নারায়ণগঞ্জে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত হয়ে মৃত্যুবরণকারী শহীদ গাজী সালাউদ্দিনের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, তাদের সম্মানে হয়তো আমরা সেসব এলাকায় প্রার্থী দেব না। এছাড়া, সর্বাধিক আসনে আমরা প্রার্থী ঘোষণা করব।’
৩০০ আসনে এনসিপির প্রার্থী দেওয়া বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। তবে, আমাদের সংস্কার আর জুলাই সনদের দাবির সঙ্গে কোনো দল সংহতি প্রকাশ করলে জোটের ব্যাপারটা বিবেচনা করব।’ কবে প্রার্থীদের তালিকা ঘোষণা করা হবে— এ বিষয়ে দলটির আহ্বায়ক বলেন, ‘১৫ নভেম্বরের মধ্যে তালিকা ঘোষণা করা হবে।’
এর আগে, মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিপক্ষে প্রার্থী ঘোষণা দেওয়া বিষয়ে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী জানান, বেগম খালেদা জিয়ার বিপক্ষে প্রার্থী দেবে না জাতীয় নাগরিক পার্টি।
এমএসআই/এমএআর
