হৃদরোগ-স্ট্রোক ‘উস্কে দিতে পারে’ ইফতারের ভাজাপোড়া

Tanvirul Islam

২৪ মার্চ ২০২৩, ১১:৪৭ এএম


হৃদরোগ-স্ট্রোক ‘উস্কে দিতে পারে’ ইফতারের ভাজাপোড়া

দিনভর রোজা শেষে কী দিয়ে ইফতার করবেন তা নিয়ে প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা চলছে জোরেশোরে। ব্যবসার উদ্দেশে পাড়া-মহল্লার হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোও তৈরি করছে ভাজাপোড়ার মচমচে আইটেম। তবে এসব খাবার খাওয়ার বিষয়ে হৃদরোগ-স্ট্রোকে আক্রান্ত এবং স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা মানুষদের সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অন্যান্য রোগের মতো হৃদরোগ-স্ট্রোক ‘উস্কে দিতে পারে’ ইফতারের এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার।
 
চিকিৎসকরা বলছেন, ভাজাপোড়া জাতীয় খাবার হৃদরোগ ও স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান কারণ। এসব খাবার হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই রোজার মাসে ইফতারিতে এসব খাবার পরিহার করে ফলমূল-শাকসবজিসহ সুষম খাবার খাওয়ার পরামর্শ তাদের।

আরো পড়ুন>>ইফতারে ভাজাপোড়ায় ফ্যাটি লিভারের ঝুঁকি
 
ইফতারে যা খাওয়া হয়, স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর
 
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোজার মাসে আমাদের এমনিতেই কম খাওয়াই উচিত। কারণ, ধর্মীয়ভাবে এ মাসে সংযমের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মাসটিতে ইফতার বা সাহরিতে যা খাওয়া হয়, সেটি স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। আমাদের দেশে ইফতার মানেই ভাজাপোড়া বেশি খাওয়া, তৈলাক্ত জিনিস বেশি খাওয়া। এটা বিশেষ করে যারা হার্টের রোগী, যারা ডায়াবেটিসের রোগী, তাদের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

চিকিৎসকরা বলছেন, ভাজাপোড়া জাতীয় খাবার হৃদরোগ ও স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান কারণ। এসব খাবার হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। তাই রোজার মাসে ইফতারিতে এসব খাবার পরিহার করে ফলমূল-শাকসবজিসহ সুষম খাবার খাওয়ার পরামর্শ তাদের

তিনি বলেন, এসব খাবারে হৃদরোগ না হলেও ঝুঁকিতে থাকা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এমন খাবার খেলে প্রথমত হজমের সমস্যা হয়, পরে কোলেস্টেরল লেভেল, ব্লাড সুগার লেভেলের কন্ট্রোল ঠিক মতো থাকে না। এজন্য আমি বলব, ভাজাপোড়া কম খেয়ে বরং শাকসবজি, চিড়ামুড়ি, দই— এ ধরনের খাবার বেশি খাওয়া। এগুলো হজমের জন্য ভালো, আবার কোলেস্টেরল, সুগার লেভেলও ভালো রাখে।

দেখে নিন আজকের সেহরি, ইফতার ও নামাজের সময়সূচি

 কম খাবেন, তবে যা খাবেন স্বাস্থ্যসম্মত খাবেন
 
ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ইফতারিতে যাই খান, পরিমিত খেতে হবে। যেকোনো কিছু বেশি খেলে বিপরীত প্রভাব পড়বে। কম খাবেন, তবে যা খাবেন স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাবেন। তাহলেই রোজার মাস সুস্থ থাকবেন এবং সুন্দরভাবে রোজাগুলো সম্পন্ন করতে পারবেন।

সারাদিন রোজা রেখে ইফতারে এত খাবার রক্তচাপে কোনো সমস্যা হয় কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইফতারে খাওয়ার পর আবার তারাবির নামাজের পর ডিনার, এরপর আবার সাহরি। সবমিলিয়ে এ খাওয়া-দাওয়া রক্তচাপে হয়তো সরাসরি কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না, তবে হজমে সমস্যা হয়। এক্ষেত্রে ইফতারের পর হাল্কা খেয়ে কিছুক্ষণ পর একবারে ডিনার কমপ্লিট করে ফেলা উচিত। এরপর লম্বা গ্যাপ দিয়ে সাহরি খাওয়া উচিত।
 
ডাবের পানি-তরমুজ হতে পারে ইফতারের নিত্যসঙ্গী
 
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, যারা হৃদরোগী না, তবে হৃদরোগের রিচ ফ্যাক্টর আছে, যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ— এ ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে আমরা বলি ইফতারের খাবারটা সুষম খেতে। কিন্তু অধিকাংশ সময় দেখা যায় তারা ভাজাপোড়া বেশি খান। একজন হৃদরোগ চিকিৎসক হিসেবে আমরা সবসময় বলি ইফতারিতে ভাজাপোড়া না খেয়ে ফল জাতীয় খাবার ও শাকসবজি খেতে পারেন। বিশেষ করে সারাদিন তৃষ্ণা শেষে ডাবের পানি খেতে পারেন, তরমুজ খেতে পারেন। এছাড়া পেঁপেসহ দেশীয় ফলগুলোও খেতে পারেন।

‘আমাদের মনে রাখতে হবে, ইফতার থেকে সাহরি পর্যন্ত যেসব খাবার আমরা খাব, এর ফলে দেহে যে ক্যালরি জমা হবে, তার মেজারমেন্ট (পরিমাপ) ঠিক রাখতে হবে। অনেকেই শুধু ভাজাপোড়া খান, অন্যান্য খাবার খান না। এজন্য আমরা বলি ইফতারে সুষম খাবারটা খেতে হবে। শরীরের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

আরো পড়ুন>>রোজায় ঝুঁকিতে পড়তে পারেন ডায়াবেটিক রোগী
 
তার মতে, ভাজাপোড়ায় আপনি যে তেলটা খাচ্ছেন, সেটি কিন্তু আপনার দেহের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য মানসম্পন্ন তেল দিয়ে যেন ইফতারিগুলো ভাজা হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু রাস্তার পাশে বিভিন্ন দোকানে যেসব ইফতারি তৈরি হয়, সেগুলোতে মানহীন তেল ব্যবহার করা হয়। এমনকি অসংখ্য দোকানে ইফতারিগুলো মচমচে করতে যানবাহনে ব্যবহৃত মোবিলও ব্যবহার করা হয়। সুতরাং এ জায়গায় আমাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য ভালো হয় বাসায় এগুলো বানিয়ে খাওয়া।
 
হৃদরোগে আক্রান্তরা কি রোজা রাখতে পারবেন
 
ডা. প্রদীপ কুমার কর্মকার বলেন, যারা এরই মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন, আর যারা এখনও হৃদরোগে আক্রান্ত হননি, কিন্তু ঝুঁকিতে আছেন; প্রত্যেককেই রোজায় খাবার-দাবারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

আরো পড়ুন>>মহানবী সা. কী দিয়ে ইফতার করতেন
 
তিনি বলেন, যাদের অতি সম্প্রতি হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, অথবা হার্ট ফেইলিওর হয়েছে, যাদের অনেক বেশি শ্বাসকষ্ট হয়— এমন রোগীদের আমরা সাধারণত রোজা রাখতে বলি না। কারণ, তাদের নিয়মিত এবং সময় মতো ওষুধ খাওয়া খুবই জরুরি।

খুব কম পরিমাণে ভাজাপোড়া খাবার খান এবং যারা খুব বেশি খেয়ে থাকেন— দুই ধরনের ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যগত বিষয় বিশ্লেষণ করেন। সেখানে দেখা যায়, সপ্তাহে এসব খাবার যারা কম খান তাদের চেয়ে যারা বেশি খান তাদের হৃদরোগজনিত ঝুঁকি ২৮ শতাংশ, শুধু হৃদরোগের ঝুঁকি ২২ শতাংশ এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি ৩৭ শতাংশ বেশি

বিশিষ্ট এ হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, আমাদের কিছু রোগী আছেন যাদের আমরা সারাদিনে এক লিটার পানি পানের জন্য নির্ধারণ করে দেই। এসব রোগী যদি রোজা রাখেন, তাহলে সারাদিন তাদের কোনো পানি খাওয়ার সুযোগ থাকে না। এটা তাদের শরীরের ওপর অনেকটা বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং এমনকি দ্রুত হার্ট ফেইলিওরে চলে যায়। এজন্য আমরা তাদের অসুস্থতার সময় রোজা রাখতে নিষেধ করি।

আরো পড়ুন>>ইফতারের দোয়া
 
ভাজাপোড়া খাবার নিয়ে যা বলছে আন্তর্জাতিক গবেষণা
 
একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ভাজাপোড়া জাতীয় খাবার না খেয়ে, বরং খরচের ওই অর্থ সংরক্ষণ করতে পারলে হৃদরোগ-স্ট্রোকের ঝুঁকি এড়িয়ে চলা সম্ভব। চীনের গুয়াংডংয়ের শেনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলথ সায়েন্স সেন্টারের ওই গবেষণায় গবেষক দল স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কিত অতীতের অন্তত ১৯টি প্রকাশিত গবেষণাকর্ম নিয়ে অনুসন্ধান করে। সেখানে অন্তত ৩৭ হাজার হৃদরোগ ও স্ট্রোক সংশ্লিষ্ট তথ্য মেলে।

সাড়ে সাত লাখ মানুষের অংশগ্রহণে করা গবেষণাকর্মের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাদের মধ্যে প্রায় ৮৬ হাজার মানুষ মারা যান। এমন অসংখ্য কেস স্টাডি করে গবেষকরা হৃদরোগের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা চালান। অনুসন্ধানে যারা পুরো সপ্তাহে খুব কম পরিমাণে ভাজাপোড়া খাবার খান এবং যারা খুব বেশি খেয়ে থাকেন— দুই ধরনের ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যগত বিষয় বিশ্লেষণ করেন। সেখানে দেখা যায়, সপ্তাহে এসব খাবার যারা কম খান তাদের চেয়ে যারা বেশি খান তাদের হৃদরোগজনিত ঝুঁকি ২৮ শতাংশ, শুধু হৃদরোগের ঝুঁকি ২২ শতাংশ এবং হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি ৩৭ শতাংশ বেশি।
 
গবেষকরা জানান, ফাস্ট ফুড শপ বা রেস্টুরেন্টের ফ্রায়েড চিকেন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও চিনিযুক্ত পানীয়তে উচ্চমাত্রায় লবণ ও ক্ষতিকর এসিড থাকে, যা সত্যিই শরীরের জন্য ক্ষতিকর। তাই ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
 
টিআই/জেডএস

Link copied