বেতন বকেয়া, ৩ ঘণ্টা ডায়ালাইসিস বন্ধ : কাল থেকে ফের কর্মবিরতির হুমকি

রাজধানীর জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটে তিন মাস ধরে বেতন না পেয়ে ৩ ঘণ্টার জন্য ডায়ালাইসিস সেবা বন্ধ রেখে কর্মবিরতি পালন করেছেন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান স্যানডোর কর্মীরা। ‘মানবিক বিবেচনায়’ আপাতত সেবা কার্যক্রম চালু করলেও যদি বকেয়া বেতনের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি না হয় তাহলে আগামীকাল (মঙ্গলবার) থেকে ফের কর্মবিরতিতে যাবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্যানডোরে কর্মরত চিকিৎসক-নার্সসহ অন্যান্য সেবাকর্মীরা। এদিকে সাময়িক এই কর্মবিরতিতে চিকিৎসা না পেয়ে দুর্ভোগে পড়েন শত শত কিডনি রোগী।
সোমবার (২৬ মে) দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করেনতারা। এরপর বিকেল তিনটা থেকে তারা শর্তসাপেক্ষে কাজে ফেরেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্পের মাধ্যমে রোগীদের ডায়ালাইসিস কার্যক্রমে নিয়োজিত রয়েছে ভারতীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্যানডোর। কোম্পানিটি বকেয়া টাকার জন্য সেবা বন্ধ করে দেয়।
আরও পড়ুন
স্যানডোর কর্মীরা জানান, গত তিন মাস ধরে বেতনহীন। আসন্ন ঈদের আগে যদি বকেয়া বিলের জট না কাটে, তাহলে যেকোনো সময় স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে গুরুত্বপূর্ণ এই চিকিৎসাসেবা, যা সাধারণ মানুষের জন্য আর্থিকভাবে একমাত্র ভরসা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
সরকারের কাছে ৭ কোটি টাকা পাওনা
সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান স্যানডোরের কনসালটেন্ট ডা. শামসুন্নাহার জানান, সরকার তাদের প্রায় ৭ কোটি টাকা বকেয়া পরিশোধ করেনি। গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর— ছয় মাসের বিল আটকে ছিল। জানুয়ারিতে সেটি দেওয়ার কথা থাকলেও তা মেলেনি। এরপর থেকে কোম্পানি মালামাল কিনতেও হিমশিম খাচ্ছে।
তিনি বলেন, “গত ঈদের আগেও আমাদের কর্মীরা বেতন পাননি, কেবল সামান্য অগ্রিম পেয়েছেন। এখন আরেক ঈদ চলে এসে এসেছে। টাকা পয়সা ছাড়া তারা কীভাবে ঈদ পালন করবে? টানা তিন মাস ধরে বেতন নেই, ফলে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন নার্স, টেকনিশিয়ান ও অন্য কর্মীরা।”
ডা. শামসুন্নাহার আরও বলেন, “আমরা বহুবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু কেউ আর রাজি না। আমি নিজেও কর্মবিরতিতে। বেতন ছাড়া আর কত দিন চলা যায়? যারা মাঠে কাজ করছে, তারা তো আরও বেশি কষ্টে।”
কাল আবারও বন্ধ হতে পারে সেবা
স্যানডোরের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মী জানিয়েছেন, যদি আজ বা আগামীকাল অর্থ ছাড় না হয়, তাহলে আবারও অনির্দিষ্টকালের জন্য সেবা বন্ধ হতে পারে। অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে এখনো কোনো আশ্বাস মেলেনি।
ডা. শামসুন্নাহার বলেন, “কোনো নিশ্চয়তা না পেলে আবারও সবাই কাজ বন্ধ করে দেবে। রোগীদের কষ্ট দেখে যতই বোঝাই, ওরা বলছে—‘আমাদের ঘরে চাল নেই, আমরা কেমন করে হাসপাতালে থাকি?’”
ডায়ালাইসিস বন্ধ হতেই ছটফট রোগীরা
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করান আল আমিন বারী নামের এক রোগী। সোমবার দুপুরে হঠাৎ ডায়ালাইসিস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি চরম উদ্বেগে পড়ে যান। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরই হুইলচেয়ারে বসে পড়েন তিনি। অসহায়ত্বের সুরে তিনি বলেন, “ডায়ালাইসিস নিতে দেরি হলেই শরীরে পানি জমে যায়, শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। একবার এমন হয়েছিল—ঠিকমতো ডায়ালাইসিস না হওয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল। এই চিকিৎসাটা একদিন বাদ গেলেই জীবন-মরণ পরিস্থিতি তৈরি হয়। বাইরে করাতে গেলে অনেক খরচ, আমার পক্ষে সম্ভব না। এ হাসপাতালে কিছুটা স্বল্প খরচে সেবা পাওয়া যায় বলে এতদিন ধরে এখানেই আসছি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, প্রায়ই কোনো না কোনো অজুহাতে রোগীদের ঝামেলায় ফেলে। আজকে যেমন বসিয়ে রাখল, আবার কালকে নাকি বন্ধ থাকবে। এই অনিশ্চয়তা নিয়ে তো কেউ বাঁচতে পারে না।”
জসিম উদ্দিন লিটন নামের আরেক রোগী বলেন, “এই সেবা নিয়ে টানাপোড়েন আমাদের জন্য এক রকম আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুদিন পরপরই টাকার জন্য তারা ডায়ালাইসিস বন্ধ রাখে। প্রতিবারই আমরা এসে এমন অবস্থায় পড়ি। তখন না পারি বাড়ি ফিরতে, না পারি চিকিৎসা নিতে। শরীর তো আর অপেক্ষা করে না—সময়মতো সেবা না পেলে সেটা শরীরের উপরেই আঘাত করে। অথচ আমরা তো কিছু করিনি, গাফিলতি করেছে তারা, আর ভোগান্তি হচ্ছে আমাদের।”
তিনি আরও বলেন, “সরকার, হাসপাতাল কিংবা স্যানডোর—কে দায়ী সেটা আমরা বুঝি না। আমরা শুধু চাই নিয়মিত সেবা চালু থাকুক। অন্তত বাঁচার জন্য দরকারি এই চিকিৎসাটা যেন বন্ধ না হয়।”
‘বিষয়টি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই’—হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ
জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটের উপপরিচালক ডা. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, “স্যানডোরের কর্মীরা হঠাৎ করে দুপুর ১২টা থেকে কর্মবিরতি শুরু করে। এতে ডায়ালাইসিস সেবা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। যদিও পরে রোগীদের দুর্ভোগ বিবেচনায় তারা আজকের মতো আবার কাজ শুরু করেছে।”
তিনি জানান, এই আর্থিক সংকটের দায় হাসপাতালের নয়। স্যানডোর সরকারের কাছে টাকা পায়, আর কর্মীরা তাদের কাছে। বিষয়টি পুরোপুরি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে, অর্থ বিভাগের মাধ্যমে বরাদ্দ ছাড়ের বিষয়। “আমরা জেনেছি, ফাইল অর্থ শাখায় গিয়েছিল, কিন্তু অডিট আপত্তির কারণে তা আটকে গেছে। আজ আবার তা অর্থ বিভাগে যাওয়ার কথা।”
টিআই/এআইএস