মিয়ানমারে অভ্যুত্থানে জয় কার?
মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের ধুলা যখন উড়ছে তখন একটি বিষয় পরিষ্কার, দেশটিতে গণতন্ত্র স্থগিত হয়ে যাওয়ায় এর প্রধান বিদেশি সুবিধাভোগী শক্তি হতে যাচ্ছে চীন। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতোমধ্যে দেশটির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। তবে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মন্তব্য করার আগে একটু সময় নিলেও দেশটির সরকারি গণমাধ্যম মিয়ানমারের অভ্যুত্থানকে মন্ত্রিসভায় বড় ধরনের রদবদল বলেছে।
গত ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকারের সদস্যদের আটকের ঘণ্টা খানেকের মধ্যে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন সংবাদ সম্মেলনে আসেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারে কী ঘটছে তা বেইজিং গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
ওয়েনবিন বলেন, রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য আইনি এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে থেকে মিয়ানমারের সব পক্ষকে তাদের মতভেদ যথাযথভাবে দূর করা উচিত। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের কড়া ভাষায় নিন্দা জানায় এবং জনগণের ইচ্ছা প্রত্যাখ্যান করায় দেশটির সামরিক কর্মকর্তাদের সমালোচনা করে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র বলেন, অভ্যুত্থান পরবর্তী ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণের পর মিয়ানমারের নতুন সরকারের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে। তার এই মন্তব্যের কয়েকদিন পর ১০ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার অনুমোদন দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে গণতন্ত্র প্রসারের নীতি বাস্তবায়নের ঘোষণা দেওয়া জো বাইডেন সরাসরি মিয়ানমারের অভ্যুত্থানের হোতাদের বেশি চাপ প্রয়োগ করলে তাতে চীন রাজনীতির মূল মঞ্চ পেতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারকে সাড়ে ১৩ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা দেয়; নিষেধাজ্ঞা আরোপের করলেও এই অর্থের ওপর তেমন কোনও প্রভাব পড়বে না। কারণ এই অর্থের বেশিরভাগই ইতোমধ্যে মিয়ানমারের বেসরকারি এবং সুশীল সমাজের সংগঠনগুলোর কাছে চলে গেছে।
অতীতে রোহিঙ্গা সঙ্কটসহ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্ব তীব্র নিন্দা জানালেও চীন পাশে থেকে বরং সাহস জুগিয়েছে। যে কারণে এটি স্পষ্ট— মিয়ানমারের নতুন সামরিক সরকারের সমালোচনাও করবে না চীন এবং হয়েছেও তাই। মিয়ানমারে চীনের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিশাল বিশাল উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে; সামরিক সরকারের বিরুদ্ধাচারণ করলে সেটিও বেইজিংয়ের জন্য হীতে বিপরীত হতে পারে।
অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এনএলডি) সরকারের সঙ্গে যে অঙ্গীকার এবং চুক্তি করেছিলেন সেসবের ভবিষ্যৎ নিয়ে চীনের ব্যবসায়ীরা এখন অনেক বেশি উদ্বিগ্ন। অভ্যুত্থানের আগে অং সান সু চি এবং তার দলের সঙ্গে বেইজিংয়ের দহরম-মহরম সম্পর্ক ছিল। কারণ মিয়ানমারের কট্টর জাতীয়তাবাদী সামরিক বাহিনীর তুলনায় বেসামরিক সরকারের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করা অনেক সহজ।
২০১০ সালের নির্বাচনের পর ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে চীন নির্ভরতা হ্রাস ও পশ্চিমা বিনিয়োগ টানার লক্ষ্যে পূর্বের সামরিক শাসনব্যবস্থা আরও উন্মুক্ত এবং নির্দিষ্ট কিছু সংস্কার শুরু হয়েছিল মিয়ানমারে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কটের পর পশ্চিমা বিশ্ব মিয়ানমারের সরকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে বিদেশি সহায়তা এবং বিনিয়োগ দরকার; কিন্তু পশ্চিমারা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকে যাওয়া ছাড়া অং সান সু চির কাছে বিকল্প খুব কমই ছিল।
২০১৭ সালের মে মাসে বেইজিংয়ে আন্তর্জাতিক একটি ফোরামের বৈঠকে অংশ নেন অং সান সু চি। ওই বৈঠক থেকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেয় মিয়ানমার। পরের বছর বিআরআইয়ের কাঠামোর মধ্যে থেকে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে চীন-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডর নির্মাণের জন্য উভয় দেশ একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে।
অভ্যুত্থানের আগে পর্যন্ত মিয়ানমারে বেইজিংয়ের যেসব প্রকল্প চলমান, তারমধ্যে চীনের সীমান্ত শহর রুইলির সঙ্গে মিয়ানমারের মান্দালয়ের মধ্যে সংযোগকারী রেলসড়ক, চীনের অর্থায়নে বঙ্গোপসাগরের পাশে কিয়াওকপিয়ুতে গভীর সমুদ্র বন্দর স্থাপন প্রকল্প অন্যতম। এই গভীর সমুদ্র বন্দর ইতোমধ্যে তেল এবং গ্যাস পাইপলাইনের টার্মিনাল হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে; যা মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চল হয়ে চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশে তেল-গ্যাস সরবরাহ করছে।
মিয়ানমারের সঙ্গে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে চীন কোনোভাবেই সামান্যতম ঝুঁকি নেবে না। কারণ মিয়ানমারই একমাত্র প্রতিবেশী; যাদের পাশ ঘেঁষে ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যের জন্য প্রস্তুত চায়না মেশিনারি ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি পরিবহনের জন্য একটি বিকল্প সরবরাহব্যবস্থা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মালাক্কা প্রণালী দিয়ে চলে গেছে।
সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লেইং বর্তমানে জরুরি শাসনের অধীনে দেশটির জাতীয় নেতা বনে গেছেন।
এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের আধিপত্যের ব্যাপারে আগে থেকেই তিনি সতর্ক। চীন নির্ভরতা কমিয়ে আনতে সম্প্রতি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের অস্ত্র সংগ্রহের উৎস চতুর্মুখী করেছে। ১৯৯০ এর দশক এবং ২০০০ দশকের শুরুর দিকে মিয়ারমারের অস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জামের প্রধান সরবরাহকারী ছিল চীন; সেই অস্ত্রেই এখনও দেশটির জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর লড়াই চলমান আছে।
গত মাসের শেষের দিকে রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু মিয়ানমার সফর করেন। সেই সময় মস্কোর তৈরি বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র প্যান্টসির-এস১, বন্দুক ব্যবস্থাপনা, অরল্যান-১০ই নজরদারি ড্রোন এবং রাডার সরবরাহের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন তিনি। এর আগে, রাশিয়ার তৈরি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার, ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী ব্যবস্থা, রাডার এবং সামরিক গোলাবারুদ কেনে মিয়ানমার।
দেশটির বেশ কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠী চীনের তৈরি অস্ত্র ও গোলাবারুদ এনে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যবহার করছে বলে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অভিযোগ তোলার পর রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কেনার চুক্তি হয়। মিয়ানমারের বিষয়ে চীন সব সময় ‘ক্যারট অ্যান্ড স্টিক’ নীতি অবলম্বন করে। ক্যারট নীতি অনুযায়ী, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ মিয়ানমার সম্পর্কিত যেকোনও ইস্যু জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তোলার সব ধরনের আন্তর্জাতিক চেষ্টা ধারাবাহিকভাবে আটকে দেয় রাশিয়ার পাশাপাশি চীন। নিরাপত্তা পরিষদে এই দুই দেশের ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।
যদিও জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থনের কারণে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লেইং স্বাভাবিকভাবেই চীনকে অবিশ্বাস করতে পারেন এবং বর্তমানে রাশিয়ার সঙ্গে তার চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে।
কয়েকদিন আগে নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়ে ব্রিটেনের তোলা একটি প্রস্তাবে ভেটো দেয় চীন। মিয়ানমারের নতুন সামরিক শাসকদের সঙ্গে বেইজিং যে সুসম্পর্ক রক্ষার মনোভাব নিয়েছে; তা এই ভেটোর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো পরিষ্কার হয়েছে।
মিয়ানমারের সূত্রগুলো বলছে, অভ্যুত্থানের পর একমাত্র যে দেশটির ওপর মিন অং হ্লেইং নির্ভর করতে পারেন, সেটি হলো চীন। আর এই বিষয়টি সেনাপ্রধান ইতোমধ্যে স্বীকারও করেছেন। সেনাপ্রধান যে আরও বেশি চীন ঘনিষ্ঠ হতে চান তার স্পষ্ট একটি ইঙ্গিত মিলেছে সেনাসমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী উন্না মং লুইনকে নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের মাধ্যমে।
জাতিগত কারেন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নেওয়া দেশটির সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য, যিনি ১৯৯৫ সালে সেনাবাহিনীর ম্যানারপ্ল সদরদফতরের তদারকি করেছিলেন; সেই উন্না মং লুইন ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তৎকালীন প্রেসিডেন্ট, সাবেক সেনা জেনারেল থিয়েন সেইনের আমলে মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মিয়ানমারের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল; তিনি সেই যাত্রার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
সেই সময় বেশ কয়েকবার চীন সফর করেন এবং মিয়ানমারজুড়ে চীনের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক করিডর স্থাপনে তিনিই প্রথম সম্মতি জানান। ২০১৫ সালের আগস্টে চীন সফরের সময় তিনি চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতির কথা উল্লেখ করে বলেন, মানবিক সহায়তার জন্য চীনকে ধন্যবাদ জানিয়েছে মিয়ানমার এবং বিপদের বন্ধু হিসেবে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক লালন করবে তার দেশ।
দেশটির জাতিগত বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর লড়াইয়ের মধ্যস্থতায় চীনের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন তিনি।
অতীতে মিয়ানমারের জাতিগত গোষ্ঠীগুলোকে বেইজিংয়ের অস্ত্র সরবরাহের পাশাপাশি আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ থাকলেও চীনের নজিরবিহীন প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন তৎকালীন প্রেসিডেন্টও।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এসব বিবৃতিকে কূটনীতির চমৎকার উদাহরণ হিসেবে শ্রেণিভূক্ত করা যেতে পারে। আর উন্না মং লুইং সম্ভবত সেটিই করতে চেয়েছিলেন। যদিও মিয়ানমারের সাবেক এই মন্ত্রী দেশটিতে পশ্চিমাবিরোধী এবং চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত। এমনকি মিয়ানমারের এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেশটির প্রেসিডেন্ট থিয়েন সেইনকে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে স্বাক্ষাৎ না করারও পরামর্শ দিয়েছিলেন।
কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে থিয়েন সেইন বারাক ওবামার সঙ্গে স্বাক্ষাৎ করেন। উন্না মং লুইন
ওই সময় জেনেভায় জাতিসংঘের অধিবেশনে দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের ব্যাপারে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করছিলেন।
সেই উন্না মং লুইন এখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ফিরেছেন এবং মিয়ানমারের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের নতুন নিষেধাজ্ঞা ও অভ্যুত্থানের হোতাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কারণে চীনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক আবারও দেখা যেতে পারে। চীনের সামরিক বাহিনীর সঙ্কটের সময় সর্বদা ‘বিপদের বন্ধু’ হিসেবে হাজির হওয়া চীন আবারও মিয়ানমারের পাশে দাঁড়াতে যাচ্ছে, তা মোটামুটি পরিষ্কার।
এসএস