কোভিড তহবিল তছরুপ : যুক্তরাষ্ট্রে ৪৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন

করোনা লকডাউন চলার সময়ে দরিদ্র শিশুদের খাওয়ানো বাবদ যে তহবিল বরাদ্দ দিয়েছিল মার্কিন সরকার—অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ ডলার হাতিয়ে নেওয়া ও বিদেশে সেই ডলার পাচারের অভিযোগে ৪৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের আইন ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রণালয় (ডিওজে)।
তালিকায় এক নম্বর আসামী করা হয়েছে শিশু কল্যাণ ও অধিকার নিয়ে কাজ করা মার্কিন অলাভজনক সংস্থা ফিডিং আওয়ার ফিউচারেরর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট আইমি বোকের নাম। ডিওজের অভিযোগে বলা হয়েছে, জাল-জালিয়াতি, ঘুষ ও ভুয়া কাগজপত্র দেখানোর মাধ্যমে অভিযুক্ত এই ৪৭ জন সরকারের কোভিড তহবিল থেকে ২৫ কোটি ডলার সরিয়েছেন।
এবং সেই ডলার নিজেদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারার পর সেই ডলারের একাংশ তারা গাড়ি ও অন্যান্য বিলাসজাত পণ্যের পেছনে ব্যয় করেছেন, বাকি অংশ খরচ করেছেন দেশে বিদেশে সম্পত্তি ক্রয় করে। সেই দিক থেকে তাদের বিরুদ্ধে মুদ্রাপাচারের অভিযোগও রয়েছে।
২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি শুরুর পর অন্যান্য দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রের সব অঙ্গরাজ্যে দীর্ঘমেয়াদী লকডাউন শুরু হয়। লকডাউনে অতি জরুরি সেবা ব্যতীয় যাবতীয় অর্থনৈতিক কার্যক্রম দিনের পর দিন বন্ধ থাকায় সংকটে পড়েন দেশটির ক্ষুদ্র ও খুচরা ব্যবসায়ী ও সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ।
এই পরিস্থিতিতে মার্কিন কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়, যেসব খাবারের দোকান ও রেস্তোরাঁ দরিদ্র মার্কিন শিশুদের বিনামূল্যে খাওয়াবে, সেসব রেস্তোরাঁ ও দোকানমালিকদের সরকারের তরফ থেকে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হবে।
তবে এক্ষেত্রে শর্ত দেওয়া হয়, শিশুদের বিনামূল্য খাদ্য সরবরাহ কার্যক্রম অবশ্যই কোনো অলাভজনক ও সেবামূলক সংস্থার স্পন্সরশিপে হতে হবে। অর্থাৎ, ব্যবসায়ী ও সেবামূলক সংস্থার যৌথ প্রচেষ্টার ভিত্তিতে পরিচালিত হতে হবে এই কার্যক্রম।
যুক্তরাষ্ট্রের আইন ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অভিযোগ অনুযায়ী, লকডাউন চলার সময়ে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্য মিনোসেটাভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ফিডিং আওয়ার ফিউচারের স্পন্সরশিপ দেখিয়ে কয়েকটি রেস্তোরাঁ দাবি করে, লকডাউনের সময় দীর্ঘদিন তারা রাজ্যের বিভিন্ন শহরে দরিদ্র শিশুদের খাবার সরবরাহ করেছে। এ সংক্রান্ত একাধিক সাক্ষ্যপ্রমাণ ও নথিও সরকারের কাছে উপস্থাপন করে তারা।
প্রাথমিক যাচাই-বাছাই শেষে এসব রেস্তোরাঁ ও ফিডিং আওয়ার ফিউচার নামের সেই সংস্থাটিকে প্রতিশ্রুত আর্থিক প্রণোদনাও দেয় সরকার।
কিন্তু পরে বিভিন্ন সূত্র থেকে অনিয়মের তথ্য আসার পর বিষয়টির তদন্তে নামে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই)। তদন্তে নেমে এফবিআই জানতে পারে, ফিডিং আওয়ার ফিউচারের স্পন্সরশিপ নেওয়া এসব রেস্তোরাঁ প্রণোদনার জন্য যেসব নথি ও সাক্ষ্যপ্রমাণ সরকারের সামনে হাজির করেছিল, তার সবই ভুয়া। বাস্তবে এসব রেস্তোরাঁ দরিদ্র শিশুদের কখনও কোনো খাবার সরবরাহ করেনি।
স্পন্সরশিপ পেতে এসব রেস্তোরাঁর মালিকরা ফিডিং আওয়ার ফিউচারের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট আইমি বোক ও জেষ্ঠ্য কয়েকজন সদস্যকে ঘুষ দিয়েছিল বলে জানতে পারে এফবিআই। প্রণোদনা পাওয়ার পর তার একটি অংশও মালিকদের পক্ষ থেকে দেওয়া হয় আইমি বোক ও তার অনুগত সদস্যদের।
আরও জানা যায়, প্রণোদনার টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারার পর এই ৪৭ জনের কেউ দামি গাড়ি কিনেছেন; কেউবা যুক্তরাষ্ট্র, কেনিয়া ও তুরস্কে জমি-বাড়ি কিনেছেন। কয়েকজন দেশ বিদেশে ঘোরাঘুরি ও আমোদ-প্রমোদেও ব্যয় করেছেন এই টাকা।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের পরিচালক ক্রিস্টোফার ওয়ারে বিবিসিকে জানিয়েছেন, ‘আমি আমার এই দীর্ঘ পেশাজীবনে এত বড় জোচ্চুরি, জাল-জালিয়াতি দেখিনি।’
ডিওজে এই জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত ৪৭ জনের বিরুদ্ধে প্রতারণা, ঘুষ ও মুদ্রাপাচারের অভিযোগ এনেছে বলে জানিয়েছেন বিচার মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল মেরিক গারল্যান্ড বিবিসিকে বলেছেন, ‘কেবল এই ৪৭ জন নয়, নিজেদের লাভের জন্য সরকারের করোনা তহবিল তছরুপের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট, তাদের সবার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে অভিযান চলবে।’
তবে এই অভিযোগের প্রধান আসামি আইমি বোকের আইনজীবী বিবিসিকে বলেন, ‘আমার মক্কেল নির্দোষ। আর্থিক অনিয়মের যে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে তা ভিত্তিহীন। এই অভিযোগ ওঠার প্রথম দিন থেকেই আমরা সরকারের কাছে এই দাবি জানিয়ে আসছি।’
এসএমডব্লিউ