মোদির সঙ্গে টক্করে পেরে উঠবেন বাংলার নিজের মেয়ে?

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি দেশটির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতা শহর থেকে ১৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে নির্বাচনী জনসভায় সরাসরি মমতা ব্যানার্জির প্রতি ইঙ্গিত করে মানুষের কাছে ভোট চেয়েছেন। মোদির দাবি, ‘আপনারা তাকে ১০ বছর কাজের সুযোগ দিয়েছেন, এবার আমাদের সুযোগ দিন।’
এক দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আছে দৃপ্ত রাজনীতিক মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস। পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির আরেক পরিচয় ‘দিদি’ নামে। মোদি নির্বাচনী জনসভায় তার সেই পরিচয় তুলে ধরেই মমতা ব্যানার্জির দিকে তার অভিযোগের তীর ছুঁড়লেন।
সেখানে মোদি দাবি করেন, ‘দিদি, ও মমতা দিদি। আপনি বলছেন আমরা বহিরাগত। কিন্তু বাংলার মাটি তো কাউকে বাইরের মানুষ বলে মনে করে না। এখানে কেউই তো বহিরাগত নয়।’
মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) দিক থেকে চ্যালেঞ্জকে মমতা ব্যানার্জি তুলে ধরছেন সে রাজ্যের বাঙালিদের বিরুদ্ধে বহিরাগতদের (মূলত হিন্দি-ভাষী বিজেপি) লড়াই হিসাবে।
জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য বলছেন, মমতা ব্যানার্জিও পাল্টা বলার চেষ্টা করছেন যে মোদি কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা দলের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা তুলতে চাইছেন। মমতা আরও অভিযোগ করছেন যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ‘পশ্চিমবঙ্গে সঙ্কীর্ণমনা, বৈষম্যমূলক বিভেদের রাজনীতি’ ঢোকানোর চেষ্টা করছে।
শনিবার (২৭ মার্চ) থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে প্রথম দফার ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। চার সপ্তাহ ধরে আটটি ধাপে এই ভোটগ্রহণ চলবে। দুই দলের বাকযুদ্ধ যেমনই হোক না কেন, লড়াই যে হাড্ডাহাড্ডি হবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ফল ঘোষণা হবে আগামী মে মাসের ২ তারিখে। সেদিনই একই সঙ্গে আরও চারটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হবে, যার মধ্যে রয়েছে আসামও।

সাম্প্রতিক কয়েক বছরের মধ্যে এবারের বিধানসভা নির্বাচন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নয় কোটি ২০ লাখ মানুষের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে মোদির বিজেপি দল কখনও ক্ষমতায় আসেনি। পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা কম্যুনিস্ট সরকারকে হারিয়ে মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এসেছিলেন ২০১১ সালে। এরপর থেকে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে ক্ষমতায় আছেন। বিদায়ী রাজ্য বিধানসভার ২৯৫টির মধ্যে তার দলের হাতে ছিল ২১১টি আসন।
তৃণমূল কংগ্রেসকে খুব সুশৃঙ্খল দল বলা যাবে না। তাদের দলের কাঠমোও সুদৃঢ় নয় এবং দলটি কোনো আদর্শের ভিত্তিতে তৈরি হয়নি। একজন আকর্ষণীয় ও সহজাত নেত্রীর ব্যক্তিত্বের ওপর ভর করে গড়ে উঠেছে দলটি, যে দলের সমর্থকরা তাদের নেত্রীকে ডাকে ‘অগ্নি দেবী’ নামে।
পশ্চিমবঙ্গে গত বিধানসভা নির্বাচনে ২০১৬ সালে বিজেপি জয় পেয়েছিল মাত্র তিনটি আসনে। আর ২০১৯ সালে সংসদীয় নির্বাচনে রাজ্যের ৪২টি সংসদীয় আসনের মধ্যে বিজেপি জিতেছিল ১৮টি আসনে। জনগণের ভোটের ৪০ শতাংশ গিয়েছিল বিজেপির পক্ষে।
ওই নির্বাচনে বড়রকমের ধাক্কা খায় তৃণমূল কংগ্রেস। তারা জেতে মাত্র ২২টি আসন, ২০১৪র নির্বাচনের জেতা প্রায় ১২টি আসন তারা হারায়।
রাজনৈতিক ভাষ্যকার রজত রায় বলছেন, ‘মমতা ব্যানার্জির জন্য সেটা ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। বিজেপিকে যে হেলাফেলা করা যাবে না, সেটা তখনই বোঝা গিয়েছিল। আর ২০২১ সালের এই নির্বাচন এখন তার টিকে থাকার লড়াই।’
বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে জয়লাভ করলে সেটা দলকে ব্যাপকভাবে উজ্জীবিত করবে। মোদি এখনও ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেও রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনগুলোতে তার দলকে এখনও জেতার ব্যাপারে বেগ পেতে হচ্ছে। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গে যেখানে ভোটারদের এক তৃতীয়াংশ মুসলিম, সেখানে বিজেপি জিততে পারলে এটা তাদের জন্য বড়ধরনের প্রতীকী গুরুত্ব বহন করবে।
আর তৃণমূলকে পশ্চিমবঙ্গে ধরাশায়ী করতে পারলে ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মোদির অর্থ তহবিল সমৃদ্ধ ও জোরালো সমর্থনপুষ্ট দলের সাথে টক্কর দেওয়ার জন্য বিরোধীদের সব আশা নির্মূল করা সম্ভব হবে।
রাজনৈতিক কৌশলবিদ প্রশান্ত কিশোর বলছেন, ‘এই নির্বাচন ভারতে গণতন্ত্রের জন্য একটা বড় লড়াই। হিন্দুত্বের রাজনীতিকে শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে কায়েম করতে পারলে বিজেপি শেষ প্রতিবন্ধকটা সরাতে সফল হবে।’ প্রশান্ত কিশোর বর্তমানে মমতা ব্যানার্জির নির্বাচনী প্রচারণায় সহায়তা করছেন।
আর মমতা ব্যানার্জি যদি জিততে সক্ষম হন, তিনি একজন জাতীয় নেতা হিসাবে উঠে আসবেন। ক্ষমতাসীন শক্তিধর জাতীয় দলকে তার দল হারাতে পারলে বিজেপির বিরুদ্ধে সাধারণ নির্বাচনে লড়ার জন্য একটা বিরোধী জোটের সম্ভাব্য নেত্রী হিসাবে মমতার নাম উঠে আসতে পারে।

অন্য কোনো বিরোধী নেতা মোদির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জিততে এখনও সক্ষম হননি। তাই তৃণমূল কংগ্রেসের এই শীর্ষ নেত্রী জিততে পারলে তিনি বিরোধী মহলে একটা জায়গা করে নিতে পারবেন বলে বলছেন দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের ঊর্ধ্বতন ভিজিটিং ফেলো নীলাঞ্জন সরকার।
তবে কাজটা সহজ হবে না। আপনি পশ্চিমবঙ্গে যেখানেই যাবেন, শুনবেন মানুষের অভিযোগ যে জনকল্যাণ প্রকল্পের আওতায় কোনোরকম সাহায্য পেতে হলে তৃণমূলের নেতা ও কর্মীদের ঘুষ দিতে হয়। একজন এমন অভিযোগও করেছেন যে সমাজ কল্যাণ প্রকল্পের অর্থ তোলার সময় লোকেদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার জন্য দলের কর্মীরা ব্যাংকের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। যেটাকে একজন বিশ্লেষক ‘সরকারের রাজনীতিকরণ’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন।
মানুষ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তৃণমূল কর্মীদের সহিংসতার কথাও বলেছেন। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অর্থনৈতিক সেলের প্রধান ধানপাত রাম আগরওয়াল বলছেন, ‘রাজনীতিতে অপরাধীরা ঢুকে গেছে, যার কারণে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা ও নির্যাতন চলছে।’
কিন্তু এরপরেও মানুষ মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেন না, কারণ ব্যক্তিগত মানুষ হিসাবে তাকে একজন সৎ ও দরদী নেত্রী মনে করা হয়। তার দশ বছরের শাসনমালের পর তাকে নিয়ে যে উচ্ছ্বাস ছিল তাতে হয়তো ভাঁটা পড়েছে, কিন্তু মানুষের কাছে তার মানবিক একটা ভাবমূর্তি এখনও অটুট রয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ কিন্তু কম।
প্রশান্ত কিশোরও স্বীকার করেছেন যে, স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে এবং দলের বিরুদ্ধে মানুষ ক্ষুব্ধ। কিন্তু তার মতে, ‘মমতা ব্যানার্জি এখনও পাশের বাড়ির মেয়ে, তার দিদির ভাবমূর্তিটা ধরে রাখতে পেরেছেন। তার এই ভাবমূর্তি হয়তো তাকে সাহায্য করতে পারে, লোকে তাকে ব্যক্তিগতভাবে ঘৃণা করে না।’
মমতা ব্যানার্জি গত ১৮ মাসে দলের বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগের পর কিছু ব্যবস্থা নিয়েছেন। মানুষের অভিযোগ শোনার জন্য যে হেল্প লাইন চালু করা হয়েছে সেখানে ৭০ লাখের বেশি মানুষ কল করেছেন বলে খবরে জানা গেছে। এক ডজনের মতো জনকল্যাণ প্রকল্পের সহায়তা মানুষের কাছে সহজে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ‘সরকার আপনার দরজায়’ নামে যে উদ্যোগ গত ডিসেম্বর মাসের পর থেকে চালু করা হয়েছে, তার সুবিধা নিয়েছেন প্রায় ৩ কোটি মানুষ।
সরকার দাবি করেছে, সরকারি একটি কর্মসূচির মাধ্যমে ১০ হাজার কমিউনিটি প্রকল্প নিয়ে মানুষের অভিযোগ মোকাবিলা করা হয়েছে। যুদ্ধকালীন দ্রুততায় গ্রামের রাস্তাঘাট মেরামত করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের জন্য বাইসাইকেল ও বৃত্তির প্রকল্প, মেয়েদের লেখাপড়া চালু রাখার ও স্বাস্থ্য বীমার জন্য নগদ অর্থ প্রকল্পসহ নানা সরকারি উদ্যোগের কারণে মমতা ব্যানার্জি এখনও অনেকের কাছে তার জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন। নারী ভোটারদের কাছে তিনি জনপ্রিয়। এবারের নির্বাচনে তার দলের ১৭ শতাংশ নারী প্রার্থী রয়েছে।
অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিও তাদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে মরিয়া। তাদের ২৮২ জন প্রার্থীর মধ্যে ৪৫ জনের বেশি অন্য দলত্যাগী। এদের মধ্যে ৩৪ জন মমতা ব্যানার্জির দল ত্যাগ করে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই বিক্ষুব্ধ স্থানীয় নেতা এবং যারা তৃণমূলের টিকিট পাননি।
অনেক বিশ্লেষক বলছেন, তৃণমূলের সঙ্গে লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসাবে বিজেপি উপজীব্য করেছে তৃণমূলের সমালোচনা এবং ‘সোনার বাংলা’ গড়ার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু তাদের গঠনমূলক দলীয় নীতি তারা সামনে আনেনি। তারা তৃণমূলের প্রতি ক্ষুব্ধ ভোটারদের এবং নিম্ন বর্ণের মানুষকে টার্গেট করে ভোটে লড়ছে।
রাজ্যে ভগ্নদশা কমিউনিস্ট পার্টি মুসলিম একজন ধর্মীয় নেতার সঙ্গে জোট বাঁধার চেষ্টা করার পাশাপাশি কংগ্রেসের প্রধান প্রার্থীদের ভোট কাটার কিছু প্রয়াস নিয়েছে। ফলে পশ্চিমবঙ্গে লড়াইয়ে রয়েছে মূলত দুটি দল- তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি। জিততে হলে একটা দলকে ৪৫ শতাংশ মানুষের ভোট পেতে হবে।
বেশিরভাগ মানুষই বলছেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে হাড্ডাহাড্ডি। এমনকি ‘দিদি’ও তার ভাবমূর্তি বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। কলকাতা জুড়ে বড় বড় বিলবোর্ড আর হোর্ডিংয়ে দেখা যাচ্ছে মমতা ব্যানার্জির হাসিমুখের নিচে লেখা ‘বাংলার নিজের মেয়ে’।

এখানে আবেদনের মূল সুরটা হল বাংলার ঘরের মেয়ের ওপর এখন চড়াও বহিরাগতরা। প্রশান্ত কিশোর বলছেন, ‘ভোটারদের কাছে আবেদন হল এই সঙ্কটময় লড়াইয়ে তিনি আপনার সমর্থনের মুখাপেক্ষী।’
সূত্র: বিবিসি বাংলা
টিএম