করোনার প্রকোপকে ‘দুঃখ সইবার পরীক্ষা’ বলছেন মোদি

ভারতে আজ নিয়ে টানা চারদিন ধরে দৈনিক কোভিড সংক্রমণের বিশ্বরেকর্ড ক্রমাগত ভেঙেই চলেছে। আজ সকালে সে দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘন্টায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। একই সময়সীমার মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন আরও ২ হাজার ৭৬৭ জন, সেটিও ভারতে করোনার প্রাণহানির নতুন রেকর্ড।
দেশটির রাজধানী দিল্লি এই মুহুর্তে সবচেয়ে দুর্গত এলাকাগুলোর একটি, সেখানে শয্যা নেই বলে বহু হাসপাতাল রোগীদের ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে এবং শহরটিতে রোজ অজস্র রোগী শুধুমাত্র অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছেন।
এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আজ দেশবাসীদের উদ্দেশে তার নিয়মিত রেডিও ভাষণে মন্তব্য করেছেন, ভারতীয়দের ‘দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতা কতটা’ করোনা এখন তারই পরীক্ষা নিচ্ছে।
বস্তুত সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে রাজধানী দিল্লির স্বাস্থ্য অবকাঠামো যে অন্তত বাকি দেশের তুলনায় অনেকগুণ ভালো, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু হাজার হাজার কোভিড রোগীর চাপ এবং পর্যাপ্ত অক্সিজেনের অভাব মাত্র দিন সাতেকের মধ্যে সেই পরিষেবাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে।
শত শত রোগীর পরিজনরা একটা কোভিড বেডের জন্য উদভ্রান্ত হয়ে ছোটাছুটি করছেন, অথচ হাসপাতালগুলো নতুন রোগী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
রোববার সকালে সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে ফোর্টিস এসকর্টস হার্টস ইনস্টিটিউটের নাম, এই নামী বেসরকারি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছেন, আর একজন রোগী ভর্তি নেওয়ার মতো অক্সিজেনও তাদের স্টকে নেই।
এর আগে গতকাল জয়পুর গোল্ডেন নামে দিল্লির আর একটি হাসপাতালে অন্তত বিশজন রোগী অক্সিজেনের অভাবে মারা গেছেন। রাজধানীর যখন এই হাল তখন বাকি দেশের অবস্থা খুব সহজেই অনুমেয়।
নাগপুরের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইলিয়াস বলছেন, ‘আমি নিজের জামাতাকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে গিয়ে শুনি ভেন্টিলেটর নেই, ভর্তি হবে না। তখন পরিচিত একজন ফোন করে জানায়, দেড়শো কিলোমিটার দূরে অমরাবতীতে একটা অক্সিজেন-ওয়ালা শয্যা পাওয়া যাচ্ছে, তখন শ্বাসকষ্টে ভোগা মরণাপন্ন জামাতাকে অনেক কষ্ট করে অত দূরেই নিয়ে যাই।’
ফ্রন্টলাইন স্বাস্থ্যকর্মীরাও এই পরিস্থিতির সঙ্গে লড়তে গিয়ে যথারীতি হাঁফিয়ে উঠছেন। ক্রিটিকাল কেয়ার স্পেশালিস্ট ড. শাশ্বতী সিনহা যেমন বিবিসিকে বলছিলেন, ‘আমাদের সব হাসপাতালে একেবারে শোচনীয় অবস্থা। রোগীদের অকিসেজেন স্যাচুরেশন হু হু করে কমছে, তাদের ভেন্টিলেটরে দিতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘ভয়ার্ত জুনিয়র ডাক্তাররা আমাদের সারাক্ষণ আইসিইউ-তে ডাকাডাকি করছেন। কোভিড আইসিইউ’র অবস্থা এক কথায় মর্মান্তিক। প্রতিদিন এত বিপুল সংখ্যায় রোগীকে ভর্তি করতে হচ্ছে, গত বছর কিন্তু এ জিনিস আমরা দেখিইনি।’
কিন্তু মাত্র দুই-তিন সপ্তাহের মধ্যেই মোটামুটি স্থিতিশীল থেকে ভারতের কোভিড পরিস্থিতি এরকম বিপজ্জনক হয়ে উঠলো কীভাবে? ভারতের নামী ভাইরোলজিস্ট শাহিদ জামিলের মতে, যেভাবে ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে, তা আসলেই চমকে দেওয়ার মতো।
— Narendra Modi (@narendramodi) April 25, 2021
বিবিসিকে তিনি বলছিলেন, ‘ভারতে ১০-১১ মিলিয়ন সংক্রমণ হতে সময় নিয়েছিল ৬৬ দিন। অথচ ১১ থেকে ১২ মিলিয়ন হয়েছে ৩৪ দিনে, আর পরের এক মিলিয়ন বেড়েছে মাত্র পনেরো দিনের ভেতর। অথচ গত ডিসেম্বর-জানুয়ারিতেই আমরা বলছিলাম যথেষ্ঠসংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হয়ে গেছেন এবং গ্রাফ এখন নিম্নমুখী হতে বাধ্য।’
তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তা হলে হঠাৎ কী এমন হল যে এত মানুষ আবার আক্রান্ত হচ্ছেন? এর একটাই সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে। তা হলো ভাইরাসটা পরিবর্তিত হয়েছে, নিজেকে মিউটেট করেছে।’
এই পটভূমিতেই ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আজ তার ‘মন কি বাত’ শীর্ষক মাসিক বেতার ভাষণে কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন যে, মহামারির প্রথম ধাক্কা সামলানোর পর দেশের যে মনোবল ছিল তা এখন ভেঙে পড়ার মুখে।
তিনি আজ দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘করোনা এখন সকলের ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে, শোক-দুঃখ সইবার ক্ষমতা কতটা, তার পরীক্ষা নিচ্ছে। বহু প্রিয়জন অসময়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।’
তিনি বলেন, ‘করোনার প্রথম ঢেউ সাফল্যের সঙ্গে সামলানোর পর আমাদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস ছিল তুঙ্গে। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় ভাইরাসটির এই ঝড় আমাদের দেশকে এখন কাঁপিয়ে দিচ্ছে।’
রাজ্য সরকারগুলোকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে কেন্দ্র এই বিপর্যয় সামাল দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাবে বলেও মোদি ঘোষণা দিয়েছেন।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের জনসংখ্যার মোটামুটি চল্লিশ শতাংশকে টিকা দেওয়া না-পর্যন্ত ভারতে মহামারির এই প্রকোপ স্তিমিত হওয়ার আশা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে ভারতের এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।
সূত্র: বিবিসি
এএস