ড্রোন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় গড়ে উঠেছে ২৫০০০ গাছ নিয়ে আধুনিক আমবাগান

ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুর একটি কৃষিজমিতে প্রযুক্তি আর ঐতিহ্যের অসাধারণ মিলনে তৈরি হয়েছে এক নতুনধারার আমবাগান। যার নাম—‘ম্যাঙ্গোমেইজ’।
এখানে ২৫ হাজার আমগাছ চাষ হচ্ছে ড্রোন, সেন্সর আর অত্যাধুনিক সেচব্যবস্থার মাধ্যমে। গত বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম দ্য বেটার ইন্ডিয়া।
সংবাদমাধ্যমটি বলছে, বেঙ্গালুরুর এই বাগানে গাছের স্বাস্থ্য আর পোকামাকড়ের উপস্থিতি নিয়ে ডেটা সংগ্রহ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই চালিত ড্রোন। সেই তথ্য সরাসরি পাঠানো হয় একটি মনিটরিং সেন্টারে, যেখানে প্রতিটি গাছের যত্ন নেওয়া হয় নিখুঁতভাবে।

এখানে ব্যবহৃত ড্রিপ ইরিগেশন বা নির্দিষ্ট বিন্দুতে পানির সাপ্লাই ব্যবস্থা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত পানি বাঁচায়। প্রতিটি গাছ ঠিক যতটুকু পানি দরকার ততটুকুই পায়, আর এতে করে বাড়ে ফলন ও মান। আর সবচেয়ে বড় চমক— এখানে প্রতি একরে ১ হাজার ৪৫০টি গাছ লাগানো হয়েছে, যেখানে সাধারণত ৫০-৮০টি গাছ হয়। অর্থাৎ প্রচলিত চাষের তুলনায় ১৫ গুণ বেশি ঘনত্বে আমগাছ।
এই “কোয়ান্টাম ডেনসিটি ফার্মিং” পদ্ধতির উদ্যোক্তা সুরজ পাণিগ্রাহী। তিনি কখনো কৃষক ছিলেন না। তিনি ছিলেন কর্পোরেট দুনিয়ার মানুষ— কাজ করেছেন উইপ্রো, মেকমাইট্রিপ, এমনকি ইউরোপে একাধিক অ্যাগ্রিটেক স্টার্টআপে।

ইউরোপে কাটানো সময়েই সুরজ দেখেন কিভাবে আঙুরক্ষেতে ডেটা আর প্রযুক্তির সহায়তায় ফলন বাড়ে ও মান উন্নত হয়। তখনই তার মনে প্রশ্ন আসে— “আমরাও কি এমনভাবে আম চাষ করতে পারি না?”
সেই ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় ‘ম্যাঙ্গোমেইজ’। ২০১৮ সালে বেঙ্গালুরুতে ১৫ একর পরিত্যক্ত জমি কিনে শুরু করেন এই উদ্যোগ। ২০২১ সালে তা পুরোপুরি চালু হয়।
সুরজ জানান, প্রতি গাছ তিন ফুট দূরত্বে লাগানো হয়েছে, সারির মাঝে সাত ফুট ফাঁকা রাখা হয়েছে। এই ঘন চাষপদ্ধতিতে এবার তারা ৪০ টন আম উৎপাদনের আশা করছেন। ইতোমধ্যেই ২০২৫ সালে ৫০ হাজার বক্স আলফানসো আম বিক্রি করেছেন তারা।

এই বিশাল প্রকল্পের প্রযুক্তিগত দিক সামলান প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা প্রশান্ত পাটালায়। তার নেতৃত্বে ব্যবহৃত হচ্ছে উপগ্রহ চিত্র, সেন্সর, এআই ড্যাশবোর্ড, মাইক্রোক্লাইমেট স্টেশন, ফলন পূর্বাভাস সিস্টেমসহ অত্যাধুনিক সব সরঞ্জাম।
এই সবকিছু মিলেই নিশ্চিত করা হয় প্রতিটি গাছ যেন ঠিকমতো পানি, পুষ্টি ও সুরক্ষা পায়। ড্রোন দিয়ে নজরদারি করে বোঝা যায় কোন গাছে সমস্যা, আর সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই চাষে রাসায়নিক ব্যবহারের বদলে প্রাকৃতিক পদ্ধতি যেমন নিম তেল, মৌমাছির মাধ্যমে পরাগায়ন ইত্যাদি প্রয়োগ করা হয়। এতে উৎপাদন বাড়ে ২৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত।

সুরজের লক্ষ্য শুধু চাষ নয়— তিনি চান ভারতীয় আমকে বিশ্বমানের এক পণ্যে রূপ দিতে। তিনি প্রশ্ন করেন, “যেমন ইউরোপের ওয়াইন বিশ্বে পরিচিত, তেমনি কেন ভারতীয় আলফানসো আম সারা বিশ্বে পরিচিত হবে না?”
প্রসঙ্গত, ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় আম উৎপাদনকারী দেশ হলেও দেশটি থেকে মাত্র ১০-১২ শতাংশ আম রপ্তানি হয়। যথাযথ মানের অভাব, অনিয়মিত ফলন ও বাজার উপযোগী চাষের অভাবেই এতো কম আম রপ্তানি করতে পারে দেশটি। এই ঘাটতি পূরণেই সুরজ পাণিগ্রাহী এনেছেন এই “কোয়ান্টাম ডেনসিটি” চাষপদ্ধতি।
এই বাগানে প্রযুক্তি ও প্রথার সম্মিলন ঘটিয়ে সুরজ দেখিয়েছেন ভবিষ্যতের কৃষি নির্ধারিত হবে শুধু কী চাষ করছি তা দিয়ে নয়, বরং কিভাবে চাষ করছি তা দিয়েই।
টিএম