আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর, নেপথ্যে কী?

আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ভারত সফর করছেন। আট দিনের সফরে বৃহস্পতিবার ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে পৌঁছেছেন তিনি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নিষিদ্ধ সন্ত্রাসীদের তালিকায় রয়েছেন মুত্তাকি। তাই ভারত সফরের জন্য তার বিশেষ ছাড়ের প্রয়োজন হয়।
এই প্রসঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আমির খান মুত্তাকিকে এই সফরের অনুমতি দিয়েছে। তার এই আটদিনব্যপী সফরের সূচনা হয়েছে বৃহস্পতিবার।
মুত্তাকির সফর এমন এক সময় হচ্ছে যখন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারও ভারতে রয়েছেন। তার সঙ্গে রয়েছে প্রতিনিধিদের একটি বড় দল। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এটাই স্টারমারের প্রথম ভারত সফর।
গত জুলাইয়ে ভারত ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়, সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই সফরের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। মুম্বাইয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার ইতোমধ্যে সাক্ষাৎ ও যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনও হয়েছে।
দুই দেশের মধ্যে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, প্রযুক্তি, ইনভেস্টমেন্ট, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানসহ একাধিক বিষয়। গ্লোবাল ফিনটেক ফেস্ট-এ অংশগ্রহণ করবেন স্টারমার।
অন্যদিকে, আফগানিস্তানে ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর আমির খান মুত্তাকির প্রথম ভারত সফর। তবে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে তার বৈঠক হবে কি না সে বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করের সঙ্গে তার বৈঠক হওয়ার কথা। পাশাপাশি কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে তার বৈঠক হতে চলেছে।
আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে এখনও স্বীকৃতি দেয়নি ভারত। ঐতিহাসিকভাবে, ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও ২০২১ সালে তালেবানদের ক্ষমতায় ফেরার পর কাবুলে নিজেদের দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দিল্লি।
এর এক বছর পর বাণিজ্য, চিকিৎসা সহায়তা এবং মানবিক সহায়তার মতো বিষয়গুলোকে সহজতর করার জন্য সেখানে ছোট মিশন খোলা হয়। তালেবানকে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেবে কি না সে বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালকে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনও জবাব দেননি।
তবে স্বীকৃতি না দিলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠক হয়েছে। সম্প্রতি রাশিয়ায় আয়োজিত মস্কো ফরম্যাট কনসালটেন্সে আফগানিস্তানের বাগরাম বিমান ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যে মন্তব্য করেছিলেন, তার বিরোধিতা করা হয়। যে কয়েকটি দেশ মিলে ওই যৌথ বিবৃতি জারি করেছে, সেই তালিকায় ভারতও রয়েছে। যদিও ওই বিমান ঘাঁটির নাম সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি।
এসব বিষয়কে মাথায় রেখে মুত্তাকির এই ভারত সফরের দিকে সবার নজর রয়েছে। দুই দেশের কী স্বার্থ রয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
• সফরের কারণ সম্পর্কে কী বলছে গণমাধ্যম?
ভারত ও আফগানিস্তান দুই দেশের গণমাধ্যমেই এই সফর নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারতের ইংরেজি পত্রিকা দ্য হিন্দুর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুত্তাকিকে পূর্ণ প্রোটোকল দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্মান দেওয়া হবে। তার আতিথেয়তার জন্য উপস্থিত থাকবেন সরকারি কর্মকর্তারা।
দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে ১০ অক্টোবর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করের সঙ্গে তার বৈঠকের কথা রয়েছে। মুত্তাকির এই সফর নিয়ে আফগান গণমাধ্যমেও ব্যাপক আলোচনা চলছে।
আমু টিভি পশতু ভাষার একটি শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তালেবানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি তাদের নেতা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার কাছ থেকে ভারত ও রাশিয়া সফরের বিশেষ নির্দেশ পেয়েছেন। এই দুই সফরের আগে মুত্তাকিকে আখুন্দজাদা কান্দাহারে ডেকে পাঠান। তবে এই বৈঠকের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ মুত্তাকিকে ভারত সফরের অনুমতি দিলেও রাশিয়ার কথা উল্লেখ করা হয়নি।
‘‘গত শুক্রবার কান্দাহারে আখুন্দজাদার সঙ্গে দেখা করেন মুত্তাকি। আখুন্দজাদা কান্দাহারে বাস করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন। ভারত সফর এমন সময়ে হচ্ছে যখন সম্প্রতি মুত্তাকির পাকিস্তান সফরের বেশ কয়েকটি পরিকল্পিত বাতিল করা হয়েছে। আখুন্দজাদার আপত্তির কারণে বা যৌক্তিক কারণেই এমনটা ঘটেছে।’’
আমু টিভির ওই প্রতিবেদনে দুই দেশের সম্পর্কের বিষয়ে উল্লেখ করে তালেবান সরকারের প্রতি ভারতের সাম্প্রতিক আগ্রহের সম্ভাব্য কারণও খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত গণতান্ত্রিক আফগানিস্তানের পক্ষে এবং তালেবানের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে খুব সতর্ক ছিল। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নিরাপত্তাজনিত কারণে এবং পাকিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘদিনের শত্রুতার কারণে তালেবানের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে ভারত।
আমু টিভির অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মে মাসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে মুত্তাকির কথা হয়। এ ছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারিতে মুত্তাকির সঙ্গে বৈঠক করেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বেশ কয়েকজন তালেবান কর্মকর্তা ভারত সফর করেছেন।
তালেবানের ওষুধ ও খাদ্যমন্ত্রী হামদুল্লাহ জাহিদ সেপ্টেম্বর মাসে ভারতে এসেছিলেন। সেই প্রসঙ্গে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি আন্তর্জাতিক ফার্মাসিউটিক্যাল ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছিলেন। সেপ্টেম্বর মাসে আফগানিস্তানে ভূমিকম্পের পর ভারত ত্রাণ সামগ্রী পাঠিয়েছিল। পরে ইরানের চাবাহার বন্দর দিয়েও আফগানিস্তানে সহায়তা পৌঁছানো হয়েছিল।
• পাকিস্তানই কি আগ্রহের আসল কারণ?
অনেকেই মনে করছেন, তালেবানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক স্থাপনের কারণগুলোর মধ্যে প্রধান হলো পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানের সাম্প্রতিক সমীকরণ। অন্যদিকে, তালেবান সরকারের অ্যাজেন্ডার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে তাদের স্বীকৃতি, যা ভারত দেয়নি।
গত ৪ অক্টোবর আফগানিস্তানের ইংরেজি সংবাদমাধ্যম তোলো নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়, মুত্তাকির ভারত সফরের শীর্ষ অ্যাজেন্ডায় রয়েছে তালেবানদের স্বীকৃতি।
তোলো নিউজের রাজনৈতিক বিশ্লেষক সৈয়দ আকবর শিয়াল ওয়ারদাকের কথায়, আমি মনে করি না যে ভারত এখনই তালেবানকে স্বীকৃতি দেবে। এই জাতীয় কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে ভারত অন্যান্য বিষয়গুলোকে বোঝার চেষ্টা করবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বহু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করেন যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একাধিক ইতিবাচক ঘটনা ঘটেছে। ধারণা করা হচ্ছে যে এই সফর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের পরিধিকে প্রসারিত করতে সাহায্য করবে।
বিশ্লেষক ওয়াহিদ ফাকিরি বলেন, এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে এবং তা উল্লেখযোগ্যভাবে ত্বরান্বিত হবে। এর একটা বড় কারণ হলো আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি। ভারত এই পরিস্থিতিকে নিজেদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করছে।
আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর পর চার বছর হয়ে গেছে এবং রাশিয়া বিশ্বের প্রথম দেশ যারা তালেবানকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা ছাড়া কোনো দেশই আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবানকে গ্রহণ করেনি। এমনকি পাকিস্তানও তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। বিবিসি বাংলা।
এসএস