বিমানবন্দর বন্ধ, দেশ ছাড়তে মরিয়া আফগানরা ছুটছে সীমান্তে

তালেবানের ক্ষমতাগ্রহণের পর প্রশাসনিক শূন্যতা তৈরি হওয়ায় বিদেশি দাতাদের মানবিক সংকট মোকাবিলা নিয়ে তীব্র অনিশ্চয়তা, দুই দশকের যুদ্ধ শেষে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সৈন্যদের চলে যাওয়ার পর কাবুলের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অচলাবস্থার কারণে তালেবানের শাসনে ভীত দেশ ছাড়তে মরিয়া হাজার হাজার আফগান এখন সীমান্তের দিকে ছুটছেন।
পাশাপাশি দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বিশৃঙ্খলার পর বুধবার শত শত মানুষের ভিড় দেখা গেছে ব্যাংক এবং বিভিন্ন খাবারের দোকানে। ২০ বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে লাখো মানুষকে কাবুল থেকে সরিয়ে সোমবার মধ্যরাতে মার্কিন বাহিনীর চূড়ান্ত বিদায়ের পর দেশটির ব্যাংক, হাসপাতাল এবং সরকারি প্রশাসন সচল রাখার দিকে মনোনিবেশ করেছে ইসলামি সশস্ত্র গোষ্ঠী তালেবান।
কাবুল বিমানবন্দর অকার্যকর থাকায় তালেবানের প্রতিশোধের ভয়ে ইরান, পাকিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সীমান্তের দিকে আফগানরা ভিড় করছেন। খাইবার পাসের পূর্ব দিকে পাকিস্তানের সাথে আগানিস্তানের অন্যতম প্রধান সীমান্ত ক্রসিং তোরখামে পাক একজন কর্মকর্তা বলেছেন, আফগানিস্তানের বিপুল সংখ্যক মানুষ সীমান্ত খুলে দেওয়ার অপেক্ষা করছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, ইরানের সঙ্গে সীমান্তের ইসলাম কালা চৌকির কাছে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হয়েছেন। সীমান্ত পেরিয়ে ইরানে ঢুকে পড়া আফগানিস্তানের ৮ জনের একটি দলের এক সদস্য বলেন, আমার মনে হয়েছে, অতীতের তুলনায় বর্তমানে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনী সীমান্তে আফগানদের ঢুকতে দেওয়ার জন্য এক ধরনের শিথিলতা এনেছে।
গত ১৪ আগস্ট আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতা তালেবানের দখলে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক বাহিনী এক লাখ ২৩ হাজারের বেশি মানুষকে কাবুল থেকে সরিয়ে নেয়। কিন্তু দেশটিতে এখনও লাখ লাখ আফগান তালেবানের ঝুঁকিতে আছেন।
জার্মানি বলেছে, জার্মানির বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থায় এখনও ১০ থেকে ৪০ হাজার আফগান কাজ করছেন। যদি তারা নিজেদের ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন, তাহলে তাদের উদ্ধারের অধিকার আছে জার্মানির।
ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন-ইভেস লি ডারিনের তথ্য অনুযায়ী, কাবুল বিমানবন্দর পরিচালনার জন্য কাতার এবং তুরস্কের সঙ্গে কথা বলছে তালেবান। কিন্তু তাদের এই সমঝোতা চূড়ান্ত হতে কয়েকদিন অথবা কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে।
আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে উজবেকিস্তানের স্থল সীমান্ত এখনও বন্ধ আছে। দেশটির সরকার বলেছে, বিমানের ফ্লাইট পুনরায় শুরু হলে আকাশপথে জার্মানিতে আফগানদের পরিবহনে সহায়তা করবে তারা।
সোমবার এক প্রস্তাবনায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ আফগান ছাড়তে চাওয়া লোকজনকে নিরাপদ যাত্রার অনুমতি দিতে তালেবানের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে ফ্রান্স এবং অন্যান্য কয়েকটি সদস্য দেশের একটি নিরাপদ এলাকা তৈরির বিষয়ে প্রস্তাবনায় কিছুই উল্লেখ করা হয়নি।
২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে জঙ্গিগোষ্ঠী আল-কায়েদার হামলায় তিন হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এরপর আল-কায়েদার পলাতক প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তরের দাবি জানায় ওয়াশিংটন।
কিন্তু সেই দাবি তৎকালীন আফগান শাসকগোষ্ঠী তালেবান প্রত্যাখ্যান করায় যুক্তরাষ্ট্র-নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক বাহিনী আফগানিস্তানে অভিযান চালায়। এই অভিযানে দেশটিতে তালেবানের সরকারের পতন ঘটে; যুদ্ধ চলে দুই দশক।
দুই দশকের এই যুদ্ধের সময় বিদেশিদের সঙ্গে কাজ করা আফগানদের ইতোমধ্যে তালেবান ক্ষমার ঘোষণা দিলেও প্রতিশোধের ভয়ে অনেকেই দেশ ছাড়তে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তালেবানরা অবশ্য দেশ ছাড়ার চেষ্টাকারীদের বাড়িতে ফেরা এবং দেশ গঠনে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছে।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালের কট্টর ইসলামি শাসনের তুলনায় এবারে কিছুটা মধ্যপন্থা অবলম্বনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তালেবান। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা দখলের পর একই ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তালেবান। সেই সময় তারা সাবেক একজন প্রেসিডেন্টকে প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, নারীদের শিক্ষাগ্রহণ এবং চাকরি নিষিদ্ধ, কঠোর পোশাক বিধি-নিষেধ আরোপ করে।
দেশটির একজন তরুণী বলেছেন, মঙ্গলবার তিনি কাবুলে একটি ব্যাংকের বাইরে লাঠি দিয়ে নারীদের মারধর করতে দেখেছেন তালেবান যোদ্ধাদের। নিরাপত্তার আশঙ্কায় নাম প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়ে ২২ বছর বয়সী এই তরুণী বলেন, এই প্রথম আমি এ রকম কিছু দেখেছি এবং এটি সত্যিই আমাকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলেছে।
সূত্র: রয়টার্স।
এসএস