ব্যারিস্টার আইভী এখন কানাডার ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট
সিলেটের মেয়ে জাফরিন চৌধুরী আইভী। বাবা অধ্যক্ষ আব্দুল আহাদ চৌধুরী মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চেয়ারম্যান ছিলেন। রাজধানীর ম্যাপললিফ স্কুলে পড়ালেখার হাতেখড়ি। ঢাকায় ‘ও’ লেভেল, ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের অধীনে এলসিএলএস থেকে এলএলবি অনার্স পাস করেন।
এরপর ব্যারিস্টারি পড়তে পাড়ি জমান লন্ডনে। ২০১০ সালে ব্যারিস্টারি পাস করে দেশে ফিরে আসেন। ভালোবেসে বিয়ে করেন আরেক ব্যারিস্টার ফাইয়ায হাসানকে। ২০১৮ সালে ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। একই বছর স্বামী-সন্তানসহ কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সেখানে কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন এবং শরণার্থী আইনে ডিপ্লোমা শেষ করেন। স্বামী ব্যারিস্টার ফাইয়ায হাসানকে নিয়ে কানাডায় গড়ে তুলেছেন ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট ফার্ম। যারা কানাডায় স্থায়ী নাগরিক হতে চান, স্টুডেন্ট ভিসায় যেতে চান; তাদের স্বপ্ন পূরণে কাজ করছে আইভি ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ভিসা সার্ভিসেস।
ঢাকায় একটি ইমিগ্রেশন কনসালটেশন ফার্মের শাখা খোলার ইচ্ছা আছে। যেন আগ্রহী অভিবাসীদের প্রকৃত এবং নির্ভরযোগ্য পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেবা দিতে পারি
এ বছর হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়া এই ব্যারিস্টার আইনজীবী বাংলাদেশেও আইনপেশায় অবদান রাখতে চান। তিনি তার জীবনের গল্প ঢাকা পোস্টের কাছে তুলে ধরেছেন। তার সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেদী হাসান ডালিম।
ছোটবেলার দিনগুলো
আমার জন্ম ঢাকায়। যদিও আমি সিলেটের মৌলভীবাজারের মেয়ে। বাবা আব্দুল আহাদ চৌধুরী বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। ম্যাপললিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়ালেখার হাতেখড়ি। ক্লাস ফাইভে পড়া অবস্থায় প্রথম ফ্যামিলিসহ কানাডা চলে যাই। সেটা ১৯৯৪ সালের কথা। সেখানে গিয়ে স্কুলিং করলাম। স্কুলিং করে দেশে ফিরে এলাম। দেশে এসে ধানমন্ডির সিবিএসে প্রাইভেটে ‘ও’ লেভেল করলাম ২০০৩ সালে।
সিবিএসে ‘ও’ লেভেল পড়া অবস্থায় ফাইয়াযের সঙ্গে পরিচয়। সেখানে আমাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক হয়ে যায়
‘ও’ লেভেল করা অবস্থায় ফাইয়াযের সঙ্গে পরিচয়। তিনি সেখানে ‘এ’ লেভেল করতেন। ‘এ’ লেভেল করে ফাইয়ায নিউক্যাসেল ল’ অ্যাকাডেমিতে চলে গেলেন। পরে আমি ‘ও’ লেভেল করেই নিউক্যাসেল ল’ অ্যাকাডেমিতে ডিপ্লোমা ভর্তি হলাম। ২০০৫ সালে নিউক্যাসেল থেকে ডিপ্লোমা শেষ করি। ২০০৮ সালের ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব নর্থাম্বিয়া থেকে এলএলবি অনার্স পাস করি। ২০১০ সালে ব্যারিস্টারি ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরে আসি। ২০১৮ সালে জজ কোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হই এবং ২০২৩ সালে হাইকোর্টের আইনজীবী প্র্যাকটিসের অনুমতি পাই। আমাদের ভাই-বোনরা সবাই কানাডায় থাকে। ২০১৮ সালে একেবারে কানাডায় চলে যাই। সেই থেকে যাওয়া আসার মধ্যে আছি। এখন আমরা কানাডারও স্থায়ী নাগরিক।
ফাইয়াযের সঙ্গে একসঙ্গে থাকা যাবে, প্রতিদিন দেখা হবে; এই কারণে ল’ ভর্তি হলাম। বলতে পারেন ফাইয়াযকে ভালোবাসার কারণেই ল’ তে ভর্তি হওয়া। এটাই প্রধান কারণ
কেন আইন পড়লেন?
সত্যি বলতে আইন পড়ব, আইনজীবী হবো— এটা আগে কখনও ভাবিনি। সিবিএসে ‘ও’ লেভেল পড়া অবস্থায় ফাইয়াযের সঙ্গে পরিচয়। সেখানে আমাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক হয়ে যায়। ফাইয়ায ‘এ’ লেভেল শেষ করে নিউক্যাসেল ল’ অ্যাকাডেমিতে আইনে ভর্তি হলেন। আমি একা হয়ে গেলাম। আমিও সে কারণে নিউক্যাসেলে ডিপ্লোমা ভর্তি হই। যেন প্রতিদিন ওর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়। কারণ তখন ক্লাস কোচিং ছাড়া তো দেখা করা সম্ভব ছিল না। ফাইয়াযের সঙ্গে একসঙ্গে থাকা যাবে, প্রতিদিন দেখা হবে; এই কারণে ল’ ভর্তি হলাম। বলতে পারেন ফাইয়াযকে ভালোবাসার কারণেই ল’ তে ভর্তি হওয়া। এটাই প্রধান কারণ। বাবাকে যখন আইন পড়ার কথা বললাম বাবা তো মহাখুশি। আইন পড়তে পড়তে বুঝতে পারি এটা অনেক মর্যাদাপূর্ণ পেশা। পরে আমি নিজেই আইন পড়ার প্রতি আকৃষ্ট হই। বাবার অনুপ্রেরণা আর স্বামীর ভালোবাসার নিয়তি আমাকে আইন পেশায় নিয়ে এসেছে।
ব্যারিস্টারি পড়ার দিনগুলো
এলএলবি অনার্সের সময় ইংল্যান্ডে চলে যাই। বিয়ের পর বার এট ল’ সম্পন্ন করা একটু চ্যালেঞ্জিং ছিল। ইংল্যান্ডের আমি শুধু পড়াশোনাই করিনি, ব্যারিস্টারি পড়াকালীন প্রথমবার রান্নাও শিখেছি। ওই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ হয়েছে।
বিয়ে ও সংসার
আমার হাজবেন্ড ব্যারিস্টার ফাইয়ায হাসান, তিনি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। ২০০৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আমাদের বিয়ে হয়। আমার হাজবেন্ড প্রখ্যাত আইনজীবী ড. এম এ জহিরের জুনিয়র ছিলেন। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের হেড অব লজ ছিলেন। এখন আমরা দুজনই কানাডাতে ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করি। কানাডা সরকার আমাদের লাইসেন্স দিয়েছে। আমাদের একমাত্র কন্যার নাম জাহরা হাসান। তার বয়স এখন ১২ বছর।
বোনের সঙ্গে মজা করে ফটোশুট করেছিলাম। ফটোশুট করার সময় একটি পণ্যের জন্য মডেল হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলাম। তখন আমি মডেলিংয়ে কিছুটা আগ্রহী হয়েছিলাম। কিন্তু...
ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট হিসেবে আপনার ব্যস্ততা নিয়ে বলুন
বাংলাদেশের অনেক লোকের স্বপ্ন কানাডায় বাস করা, কানাডার স্থায়ী নাগরিক হওয়া। আবার স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে অনেকে কানাডায় যেতে চায়। আমরা সেই স্বপ্ন পূরণে কাজ করছি। বাংলাদেশে কানাডিয়ান সরকারের লাইসেন্সপ্রাপ্ত পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান কমই আছে। এই কারণেই লাইসেন্স পাওয়ার জন্য, আমি কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন এবং শরণার্থী আইনে একটি ডিপ্লোমা সম্পন্ন করে লাইসেন্সিং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। জাফরিন আইভি ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ভিসা সার্ভিসেস কনসালটেন্ট ফার্মের মাধ্যমে ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করছি। এখানে এক্সপ্রেস এন্ট্রি, স্টুডেন্ট অ্যাডমিশন এবং ভিসা, স্টার্ট আপ ভিসা, ইত্যাদির অধীনে স্থায়ী বাসিন্দার আবেদনসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করা হয়। নিজের ব্যবসা পরিচালনার জন্য বেশিরভাগ সময় কানাডায় থাকি।
যারা আইন পড়তে চান তাদের জন্য পরামর্শ
আইন পেশায় উন্নতির জন্য খুব ধৈর্যশীল এবং দৃঢ় হতে হবে। আমি তরুণ আইনজীবীদের তাদের স্বপ্ন অনুসরণ করার পরামর্শ দেব। চাপ ও কঠিন পরিস্থিতিতে হাল ছেড়ে দেবেন না। আইন পেশা হলো একটি মর্যাদাপূর্ণ পেশা, এই পেশায় টিকে থাকা খুবই চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, তাই অধ্যবসায় এবং কঠোর পরিশ্রম শুধুমাত্র এই পেশায় সাফল্য এনে দিতে পারে।
নারীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন
নারীরা তাদের পেশাগত জীবনে কিছু প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয় এবং তাদের কর্মজীবনের পাশাপাশি পারিবারিক দায়িত্বের ভারসাম্য বজায় রাখতে হয় ও সন্তান জন্মদান এবং সন্তান লালন-পালনের কারণে পেশায় বিরতি নিতে হয়। এ কারণে ক্যারিয়ারে পিছিয়ে পড়েন তারা। এটি হতাশার কারণ হওয়া উচিত নয়। কারণ আইন পেশায় অবসর গ্রহণের বয়স নেই এবং একজন ব্যক্তি দেরিতে যোগদান বা বিরতি নিয়েও এই পেশায় উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়তে পারেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
কানাডায় ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট ফার্ম চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের হাইকোর্টে আইন প্র্যাকটিস করব। ঢাকায় একটি ইমিগ্রেশন কনসালটেশন ফার্মের শাখা খোলার ইচ্ছা আছে। যেন আগ্রহী অভিবাসীদের প্রকৃত এবং নির্ভরযোগ্য পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেবা দিতে পারি।
না বলা কথা
আমার এলএলবি চলাকালীন, আমার বোনের সঙ্গে মজা করে ফটোশুট করেছিলাম। ফটোশুট করার সময় একটি পণ্যের জন্য মডেল হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলাম। তখন আমি মডেলিংয়ে কিছুটা আগ্রহী হয়েছিলাম। কিন্তু বাবা মডেলিং পছন্দ করতেন না। এ কারণে আর সেদিকে আগাতে পারিনি। সেই কথা এখনও মনে পড়ে।
এমএইচডি/এসএম