দ্বিগুণ লাভের প্রলোভনে ২২শ গ্রাহকের ৫৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ

নগদ টাকা নিয়ে দুই বছরে দ্বিগুণ টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রলোভনে দুই হাজার ২০৯ গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় ৫৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে ‘সেবা আইডিয়াস অ্যান্ড লিভিং লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় জমি দেওয়ার নামে এমএলএম (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং) ব্যবসার আদলে ওই টাকা আত্মসাৎ করেছে।
এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে চক্রটির ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গ্রেপ্তাররা হলেন- আশিক ঘোষ অসিত (৪২), কাজী নুরুল ইসলাম (৪৮), শাহ নেওয়াজ শামীম (৪৩), জহিরুল ইসলাম (৪০), মীর নুরুল ইসলাম (৫৩) ও মামুন মিয়া (৩৫)।
রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানায় দায়ের করা মামলায় সোমবার (৮ ফেব্রুয়ারি) রাতে তাদের গ্রেপ্তার করে সিআইডির ঢাকা মেট্রো উত্তরের একটি দল। এসময় তাদের কাছ থেকে দুই হাজার ২০৯ জন গ্রাহকের নাম, গৃহীত অর্থের পরিমাণ, কিস্তির টাকার পরিমাণ ও লভ্যাংশের পরিমাণসহ অফিসিয়াল ফাইল জব্দ করা হয়। এছাড়াও ২৫০টি মানি রিসিট ও ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের অর্থ ফেরত চেয়ে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর দেওয়া ৪৩টি আবেদনের কপি জব্দ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ঢাকা মেট্রোর অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক। তিনি বলেন, সেবা আইডিয়াস অ্যান্ড লিভিং লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠানটি মূলত ‘সিল সিটি’ নামের রিয়েল এস্টেট ব্যবসার প্রচার-প্রচারণা চালায়।
তিনি বলেন, গ্রাহকরা ব্যবসা ও জমি কেনার আগ্রহ নিয়ে তাদের কার্যালয়ে আসেন। তখন চক্রের সদস্যরা এমএলএম পদ্ধতিতে টাকা দিলে মাত্র দুই বছরে টাকা দ্বিগুণের প্রলোভন দেখায়। পাশাপাশি ব্যবসার একটা লভ্যাংশ ও আরো গ্রাহক এনে দিলে সেটার উপরে নির্দিষ্ট পরিমাণ পার্সেন্টেজ দেওয়ার প্রলোভন দেখায়। লাখে প্রতি মাসে আট থেকে সাড়ে আট হাজার টাকা ও দুই বছরে দ্বিগুণ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
‘এভাবে তারা দুই হাজার ২০৯ গ্রাহকের কাছ থেকে বিভিন্ন পরিমাণ টাকা জমা নেয়। কারোর থেকে এক লাখ, কারোর থেকে ১০ লাখ টাকা ক্যাশ নিয়ে নামে মাত্র একটি মানি রিসিট দেয়। টাকা নেওয়ার পর কিছু গ্রাহক ৩/৪ মাস টাকা পেয়েছেন। পরে সেটাও বন্ধ করে দেওয়া হয়। মূল টাকা ফেরত চাইলেও কোম্পানির লোকজন গ্রাহকদের হয়রানি করতে থাকেন’ বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।
অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, সেবা আইডিয়াস অ্যান্ড লিভিং লিমিটেড নামের ওই প্রতিষ্ঠানটি রিয়েল এস্টেট ব্যবসার কথা বললেও তাদের কোনো জমিই নেই, নেই জমি কেন্দ্রিক ব্যবসাও নেই। সবচেয়ে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নামমাত্র মানি রিসিট ছাড়া টাকা লেনদেনের আর কোনো ডকুমেন্ট নেই। চেকে টাকা লেনদেন না করে সব গ্রাহকের টাকা তারা নগদে নিয়েছে।
‘কোনো প্রতিষ্ঠান লাখে আট হাজার কিংবা দুই বছরে আসলসহ দ্বিগুণ লভ্যাংশ দেবে তা বিশ্বাসযোগ্য না। এ ধরনের প্রচার-প্রচারণা বা প্রলোভনে বিশ্বাস করা মানে হচ্ছে প্রতারণার শিকার হওয়া। গ্রাহকদের এক্ষেত্রে সচেতন হওয়া উচিত। একইসঙ্গে পুলিশকে জানানো।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ভুক্তভোগী স্কুল শিক্ষক নাসিম উদ্দিন মাস্টার ঢাকা পোস্টকে জানান, ‘আড়াই লাখ টাকা দিয়েছিলাম। লাখ প্রতি তারা আট হাজার করে টাকা দেওয়ার কথা। কথা মতো লভ্যাংশ হিসেবে কয়েক মাসে ৬৯ হাজার টাকা দিয়েছিল। আর দুই বছর পর গিয়ে জমি নিবো কিনা সেই সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু তারা টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে ঘুরেও আর টাকা পাইনি।’
গত ২০ জানুয়ারি তিনি ওই কার্যালয়ে গিয়ে বলেন, অন্তত ২০ হাজার টাকা এখন না দিলে আমি এই অফিসে সুইসাইড করব। এরপর আমাকে জোর করে ঘাড় ধরে বের করে দেয়।
ওই স্কুল শিক্ষক বলেন, আমি জাতির উদ্দেশ্যে বলব কেউ যেন এ ধরনের প্রলোভনে বিশ্বাস না করেন। এ ধরনের কার্যালয় বা প্রতারণামূলক তৎপরতা ঢাকায় অনেক আছে। প্রশাসনকে অনুরোধ করব তাদের বিরুদ্ধে যেন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
আরেক প্রতারিত গ্রাহক নারায়ণগঞ্জের ইছাপুড়ার ফল ব্যবসায়ী রুস্তম মিয়া। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এক নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে ওই প্রতিষ্ঠানের সাথে পরিচয়। আমার টাকা ব্যাংকে ছিল। ১০ লাখ টাকা তুলে দেই। কথা ছিল দুই বছর পর আমাকে ২০ লাখ টাকা দেবে। কিন্তু সোমবার রাতে হঠাৎ আমার সেই আত্মীয় ফোন করে জানায়, সিআইডি সবাইকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে। ওই তথ্যের ভিত্তিতে এখানে আসা।’
তিনি বলেন, ফলের ব্যবসার পাশাপাশি আমার জমি-জমা রয়েছে। বেশি লাভের আশায় ১০ লাখ টাকা দিয়েছিলাম। এখন লাভ তো দূরে থাক, আসল টাকা পাব কিনা সেই সংশয়ে আছি।
জেইউ/এসএসএইচ/ওএফ