৯ বছরেও প্রতিকার পাননি জ্যেষ্ঠতাবঞ্চিত দুদকের ২৬ কর্মকর্তা

নয় বছর ধরে ঊর্ধ্বতনদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও প্রতিকার পাচ্ছে না দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ২৬ সহকারী পরিদর্শক (এআই)। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে ২০১৮ সালে পদোন্নতি পেলেও মেলেনি জ্যেষ্ঠতা। ফলে দিনের পর দিন বঞ্চিত হলেও সুরাহা পাচ্ছেন না তারা।
অথচ জটিলতা নিরসনে একটার পর একটা কমিটি গঠন করে রিপোর্ট নেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত গঠিত একাধিক কমিটি তাদের পক্ষে রিপোর্ট জমা দিলেও অদৃশ্য কারণে জ্যেষ্ঠতা বঞ্চিত হয়েছেন এসব কর্মকর্তা।
সর্বশেষ গত ২২ মার্চ গঠিত দুদকের মহাপরিচালক সাঈদ মাহবুব খানের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের কমিটি সিদ্ধান্ত না দিলেও বঞ্চিতদের পক্ষে মতামত দিয়েছেন বলে জানা গেছে। এই মতামতও বাস্তবায়ন হওয়া নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে তাদের জ্যেষ্ঠতার বিষয়টি সুরাহা না করেই সহকারী পরিদর্শকসহ সমমানের অন্যান্য পদের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া জন্য কমিটি গঠিত হয়েছে। দুদক মহাপরিচালকের (প্রশাসন) নেতৃত্বে গঠিত কমিটি আগামী ৩০ জুন একই ফিডারভুক্ত সাঁটলিপিকারদের পদোন্নতির জন্য সভা ডেকেছে। ফলে জ্যেষ্ঠতা বঞ্চিত সহকারী পরিদর্শকরা অনেকটা শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পদোন্নতি-বঞ্চিত এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাইকোর্টের রায় থাকা সত্ত্বেও ২০১৩ সালে আমাদের পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়। ২০১৮ সালে পদোন্নতি হলেও জ্যেষ্ঠতা দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে জ্যেষ্ঠতা পাওয়ার আবেদন করলে গঠিত কমিটির প্রতিবেদন আমাদের পক্ষে যায়। সেখানে জ্যেষ্ঠতা দেওয়ার সুপারিশসহ দায়ীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়। ২০১৯ সালের ১৯ জুন সচিব অনুমোদন দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এরপর দুদকের আইন বিভাগের মতামত চাওয়া হয়েছে। সেখানেও আমাদের পক্ষে মতামত দেওয়া হয়। তারপর আমাদের বিষয়টি দুইবার কমিশন সভায় আলোচনা হয়। সেখানে নতুন আরেকটি কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটি গতকাল (সোমবার) রিপোর্ট জমা দিয়েছে বলে জেনেছি। ওই কমিটিও আমাদের বঞ্চিত হওয়ার বিষয়ে একমত পোষণ করে কমিশনকে সিদ্ধান্ত দেওয়ার বিষয়ে লিখেছে শুনেছি।
তিনি বলেন, গত ৯ বছর ধরে দুদকের চেয়ারম্যান, কমিশনার, সচিব, মহাপরিচালক ও পরিচালক স্যারদের সঙ্গে দেখা করে আমাদের কষ্টের কথা বারবার জানিয়েছি। লিখিত আবেদন দিয়ে যাচ্ছি, তারা আমাদের আশ্বস্ত করলেও এখনও প্রতিকার পাইনি। একটি পক্ষ আমাদের বিপক্ষে কাজ করছে। ওই পক্ষ কেন আমাদের বিপক্ষে কাজ করছে সেটাই আমার বোধগম্য নয়। এটা আমার ন্যায্য পাওনা। আমরা জ্যেষ্ঠতা পেলে কি তাদের কম পড়ে যাবে, এটাই আমার প্রশ্ন।
বঞ্চিতদের দাবির বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, জ্যেষ্ঠতাবঞ্চিতরা ইতোমধ্যে লিখিত আবেদন করেছেন। আমার সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছেন। তাদের দাবি পর্যালোচনা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে একটি কমিটিও কাজ করছে। সার্বিক পর্যালোচনা শেষে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে দুদকের মহাপরিচালক ও কমিটি প্রধান সাঈদ মাহবুব খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি সম্পূর্ণ কমিশনের এখতিয়ার। আমরা কেবল আমাদের মতামত দিতে পারি। কমিশনই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
বর্তমানে কর্মরত জ্যেষ্ঠতাবঞ্চিত ২৬ সহকারী পরিদর্শক হলেন— মো. আব্দুল মোত্তালিব সরকার, মো. নুরুল ইসলাম, মো. মোফাজ্জল হায়দার, মো. মিজানুর রহমান, মো. হুমায়ুন করিব, আব্দুল লতিফ, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. সিদ্দিকুর রহমান, মো. ওবায়দুল্লাহ ইবনে খালেক, মো. জোনাব আলী বেপারী, অধীর চন্দ্র নাথ, কাজী মাহমুদ হোসেন, আবদুল আউয়াল মোহাম্মাদ জুলফিকার, মোহাম্মদ সায়েদুর রহমান, মো. মাহবুবুর রহমান, মো. রেজাউল করিম, মারুফা হাসান, কৃষ্ণপদ বিশ্বাস, মো. বাসেদ আলী, মো. আব্দুল্লাহ-আল-মামুন, মো. মোস্তাফিজুর রহমান, আবু মোহাম্মদ আনোয়ারুল মাসুদ, মো. মনিরুজ্জামান, মো. জাকির হোসেন ও মোহাম্মদ শাহজালাল।
বঞ্চিতদের আবেদন ও বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত নথিপত্র থেকে জানা যায়, প্রতিযোগিতামূলক নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ১৯৯৭ সালে ২৪ জন এবং ২০০৪ সালে ১১ জনসহ মোট ৩৫ জন বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোতে ‘সহকারী পরিদর্শক’ পদে যোগদান করেন। কমিশন গঠিত হওয়ায় তাদের গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ‘কোর্ট সহকারী’ বা ‘সহকারী পরিদর্শক’ হিসেবে বহাল রাখা হয়। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা ২০০৮-এ সহকারী পরিদর্শকদের বাদ দিয়ে শুধুমাত্র সাঁট মুদ্রাক্ষরিক/উচ্চমান সহকারী/সহকারীদের মধ্য থেকে সহকারী পরিদর্শক পদে পদোন্নতির বিধান যোগ করা হয়। এছাড়া সহকারী পরিদর্শকদের সম-স্কেল ও সমমর্যাদার উচ্চমান সহকারী পদে পদোন্নতির বিধানও যোগ করা হয় বিধিমালায়। সংশ্লিষ্টদের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, সম-স্কেল ও সমমর্যাদা পদে পদোন্নতির বিধান কীভাবে যুক্ত করা হলো। এরপর শুরু হয় আইনি লড়াই।
জ্যেষ্ঠতাবঞ্চিত ওই ৩৫ সহকারী পরিদর্শক (এআই) ২০০৯ সালে হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন (পিটিশন নং-৬৯০৮/২০০৯) দায়ের করেন। রিট পিটিশন মামলায় ২০১০ সালের ৩১ অক্টোবর হাইকোর্ট দুর্নীতি দমন কমিশনে কর্মরত কোর্ট সহকারীদের (এএসআই) সহকারী/উচ্চমান সহকারী/সাঁট মুদ্রাক্ষরিকদের সঙ্গে একই পদভুক্ত করে জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী সহকারী পরিদর্শক পদে পদোন্নতির নির্দেশনা প্রদান করে রায় দেন হাইকোর্ট। পরবর্তীতে ২০১১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয় হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের নির্দেশনা অনুসরণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশ প্রদান করে। যদিও পরবর্তীতে আর কোনো কার্যক্রম গ্রহণ হয়নি বলে অভিযোগ উঠে। এমনকি হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের আলোকে ২০১৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি অন্যান্য পদের সঙ্গে কোর্ট সহকারীদের (এএসআই) সহকারী পরিদর্শক পদে পদোন্নতি দেওয়ার জন্য ‘কাগজপত্র প্রস্তুতপূর্বক ডিপিসিতে উপস্থাপন করুন’ এমন নির্দেশ দিলেও কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি।
একটি পক্ষ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে নথিটি গোপন করে এএসআইদের পদোন্নতি বঞ্চিত করেছে বলে অভিযোগ উঠে। পরবর্তীতে অনুমোদিত নথি গোপন করে নতুন স্মারকে নতুন নথি খুলে হাইকোর্ট বিভাগের রিট পিটিশনের আদেশ অবমাননা করে ২০১৩ সালের ১৫ মে কোর্ট সহকারীদের (এএসআই) বাদ দিয়ে সহকারী/উচ্চমান সহকারী/সাঁট মুদ্রাক্ষরিক থেকে ৩১ জনকে সহকারী পরিদর্শক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে কোর্ট সহকারীদের পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে পদোন্নতি-বঞ্চিত কোর্ট সহকারীদের (এসআই) ২০১৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তুলনামূলক অনেক জুনিয়র সহকারী/উচ্চমান সহকারী/সাঁট মুদ্রাক্ষরিকদের সঙ্গে সহকারী পরিদর্শক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। পদোন্নতি দেওয়া হলেও ১০ বছরের জুনিয়রদের সঙ্গেই তাদের জ্যেষ্ঠতার হিসাব করা হয়।
বিভিন্ন সূত্রে আরও জানা যায়, বঞ্চিতদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জ্যেষ্ঠতা প্রদানের বিষয়ে মতামত প্রদানের জন্য ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে দুদক। কমিটির আহ্বায়ক করা হয় দুদকের তৎকালীন পরিচালক এস এম মাসুদুল হককে। সদস্য করা হয় উপ-পরিচালক কামরুজ্জামান ও সহকারী পরিচালক আজিজুল হককে। ওই কমিটি ২ এপ্রিল প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে দায়ী কর্মচারীদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। এছাড়া প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য কমিশনের তৎকালীন সচিব মুহাম্মদ দিলওয়ার বখত ২০১৯ সালের ১৯ জুন অনুমোদন প্রদান করেন এবং জ্যেষ্ঠতা প্রদানের জন্য প্রশাসন শাখা হতে প্রজ্ঞাপন জারির নির্দেশনা দেন। কিন্তু প্রশাসন শাখা থেকে কোনো প্রজ্ঞাপন জারি বা কার্যক্রম গ্রহণ না করেই পুনরায় কমিটির কাছে নথিটি প্রেরণ করা হয়। এরপর ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি বিষয়টি সুরাহার জন্য আইন বিভাগের মতামত চেয়ে নথি প্রেরণ করে। দুদকের আইন বিভাগ থেকেও বঞ্চিতদের পক্ষে মতামত দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
আরএম/এসএসএইচ