ধোঁয়া উড়িয়ে চলে যায় সিটি কর্পোরেশন, কমে না মশা

Abu Saleh Saadat

০৮ অক্টোবর ২০২২, ০৩:৪১ পিএম


ধোঁয়া উড়িয়ে চলে যায় সিটি কর্পোরেশন, কমে না মশা

মশকনিধনে সিটি করপোরেশনের ফগিং কার্যক্রম

‘প্রতিদিনই খবরে শুনি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনের অভিযান। কোথায় এ অভিযান? মশকনিধন কর্মীদের দেখাই তো মেলে না। বর্তমান অবস্থা এমন হয়েছে যে প্রতি ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগী। তাহলে সিটি কর্পোরেশনের মশকনিধন কার্যক্রম কি শুধু লোক দেখানো’— এমন প্রশ্ন রেখেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অধীন যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা ফরহাদ হোসেন।

শুধু ফরহাদ হোসেন নন, এমন অভিযোগ ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের অধীন বেশির ভাগ বাসিন্দার। তারা বলছেন, সিটি কর্পোরেশনের কোনো মশকনিধন কর্মীকে নিয়মিত দেখা যায় না। ফলে প্রতিটি এলাকায় যেমন মশা বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা।

আরও পড়ুন : ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা ব্যর্থ কেন? 

প্রতিদিন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এ অবস্থায় বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নানা পদক্ষেপ নিয়ে মাঠে নামলেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

dhakapost
সিটি করপোরেশনের অভিযান

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৬২ নম্বর ওয়ার্ডের অধীন দক্ষিণ কাজলার বাসিন্দা বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘আমাদের আশপাশের সব এলাকায় বলতে গেলে ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগী। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে আমরা কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখছি না। ডেঙ্গু ছাড়াও মশার উৎপাত রয়েছে দিন-রাত সবসময়। বাসায় ছোট বাচ্চা আছে। যে কারণে দিনের বেলাতেও মশারি টাঙিয়ে থাকতে হয়।’

আরও পড়ুন : শিশুরা কেন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়? 

‘নানা জায়গায় আবর্জনা উন্মুক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। সেগুলোতে পানি জমছে আর সেই পানিতে মশা জন্ম নিচ্ছে। কিন্তু মশকনিধনে সিটি কর্পোরেশনের নিয়মিত কোনো কার্যক্রম আমাদের চোখে পড়ছে না। মাঝে এক বা দুইদিন অভিযানের নামে তারা আসে। ঘুরে ঘুরে জরিমানা করে চলে যায়। এরপর আর তাদের খোঁজ থাকে না।’

শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা হাফিজুল ইসলাম ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, বর্তমানে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। ঘরে ঘরে ডেঙ্গু রোগী। সিটি কর্পোরেশন মশক নিধনের নামে কী করে, তা আমরা বুঝতে পারি না। তাদের অভিযান শুধু মিডিয়াতে দেখা যায়।

dhakapost
সিটি করপোরেশনের অভিযান

‘আমাদের এলাকার বাসিন্দারা বলতে পারবেন না যে কবে তারা মশকনিধন কর্মীদের কাজ করতে দেখেছেন। মাঝে মাঝে দুই-একদিন দেখা যায়। তারা এসে শুধু ধোঁয়া উড়িয়ে চলে যান। সিটি কর্পোরেশন যেসব অভিযানের কথা বলে, সেগুলো শুধুই লোক দেখানো। কাজের কাজ কিছুই হয় না। তারা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।’

মশকনিধন কার্যক্রম সম্পর্কে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এনামুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অনেক বড় এলাকা ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। ডেঙ্গু রোগী এ সময়ে এসে বেড়েছে। আমাদের কার্যক্রমও থেমে নেই। মশকনিধনে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে যাচ্ছি।’

dhakapost
সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নির্মাণাধীন স্থাপনা চিহ্নিত করে দেওয়া হচ্ছে

‘যেসব এলাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি, আমরা সেসব এলাকা টার্গেট করে অভিযান চালাচ্ছি। যেসব বাড়িতে ছাদবাগান আছে, যেসব স্থানে পানি জমে থাকে, আমরা সেই স্থানগুলোতে গিয়ে মশকনিধন কর্মীদের দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছি। তাদের সর্তক করছি। মাঝে মাঝে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হচ্ছে।’

আরও পড়ুন : ডেঙ্গু : নাগরিক ও দায়িত্বশীলদের দায় 

নিয়মিত মাইকিং করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে করণীয় বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করছি। যারা বলছেন সিটি কর্পোরেশনের অভিযান লোক দেখানো, এটা কিন্তু ভুল। কারণ, আমরা প্রতিটি ওয়ার্ডে কাজ করছি। আমরা জানি কীভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হবে— বলেন কাউন্সিলর এনামুল হক।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাকির হোসেন বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সবার ছুটি বাতিল করে নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মশকনিধনে সকালে এক ধরনের ওষুধ দেওয়া হয়। বিকেলে ফগিং কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এছাড়া যখন যে এলাকায় ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে, সে এলাকায় আমাদের বিশেষ অভিযান ও কার্যক্রম চলমান আছে। আমরা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। এ বিষয়ে সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। সিটি কর্পোরেশনের একার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়।’

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল মো. গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম ও অভিযান চলমান আছে। আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সব এলাকায় কাজ করে যাচ্ছি। মশকনিধন অভিযানে আমাদের কর্মীরা তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। সেগুলো মনিটরিংও করা হচ্ছে।’

dhakapost
মশকনিধনে সিটি করপোরেশনের ফগিং কার্যক্রম

‘ছাদবাগান বা নির্মাণাধীন ভবন মশার উৎপত্তিস্থল হিসেবে চিহ্নিত হলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করে জরিমানাও করা হচ্ছে। আমরা রিহ্যাবসহ ভবন মালিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বসছি। নির্মাণাধীন ভবনে যেন পানি জমতে না পারে, তা নিয়ে করণীয় বিষয়ে আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। এমনকি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মশক নিয়ন্ত্রণের কাজ আরও গতিশীল করতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের ছুটিও বাতিল করা হয়েছে।’

সার্বিক বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন ব্যর্থ। রাজধানী ঢাকার প্রায় সব ঘরে এখন ডেঙ্গু রোগী। মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করতে পারেনি সিটি কর্পোরেশন। তাই ডেঙ্গুর এমন বিস্তার।

আরও পড়ুন : স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নে করণীয় কী?  

‘মশকনিধন কার্যক্রমে সিটি কর্পোরেশন নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে— এমন দাবির সঙ্গে বাস্তব প্রেক্ষাপট কিন্তু ভিন্ন। আমরা যারা এলাকাবাসী, আমরা কিন্তু সিটি কর্পোরেশনকে সেই অর্থে অভিযান পরিচালনা করতে দেখতে পাই না। এটা সিটি কর্পোরেশনের ব্যর্থতা। তাদের অভিযান শুধু মিডিয়াতে দেখা যায়। এ বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনকে আরও জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।’

dhakapost
 মশার লার্ভা দেখা হচ্ছে

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে করণীয় বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আধুনিক জীবনযাপনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের খাবারের প্যাকেট, পানির জারসহ বিভিন্ন ধরনের পাত্র। এসব পাত্রই ডেকে আনছে ডেঙ্গু। নগরের বিভিন্ন স্থানে আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা বিভিন্ন ধরনের পাত্র এডিস মশা প্রজননের জন্য উপযুক্ত স্থান। এগুলো নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি কাজ করতে হবে সিটি কর্পোরেশনকে।

আরও পড়ুন : মশার উৎপাত : রোগ বিস্তারের আশঙ্কা কতখানি? 

‘হুট করে অভিযান চালিয়ে ডেঙ্গুর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। ওয়ার্ড কাউন্সিলরের নেতৃত্বে প্রতিটি ওয়ার্ড ১০টি ব্লকে ভাগ করে ১০টি টিম গঠনের মাধ্যমে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের চিরুনি অভিযান চালানো প্রয়োজন। পুরস্কারের ব্যবস্থা করে তাদের উৎসাহিত করা যেতে পারে। স্বল্প সময়ের অভিযান বা কার্যক্রম চালিয়ে ডেঙ্গুর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এটি নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে পাঁচ থেকে ১০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম বছরব্যাপী চালাতে হবে।’

ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বছরভেদে কম-বেশি হয়। তবে, প্রতি বছরই ডেঙ্গু রোগী মেলে। বর্ষার সময় রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। সরকারি পরিসংখ্যানে রোগীর যে সংখ্যা দেখানো হয় তা ঢাকার মাত্র ৪৭টি হাসপাতাল এবং অন্যান্য জেলার অল্পকিছু হাসপাতালের তথ্য। প্রকৃত রোগীর সংখ্যা এর চেয়ে প্রায় ১০গুণ। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নগরপিতাদের সজাগ দৃষ্টি এবং নিয়মিত মশকনিধন কার্যক্রম চালাতে হবে। সঠিক সময়ে বিজ্ঞানভিত্তিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি প্রয়োগ করতে পারলে এটি রোধ করা সম্ভব। এজন্য সিটি কর্পোরেশন ও নগরবাসীর সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন— বলেন ড. কবিরুল বাশার।

এএসএস/আরএইচ/এমএআর/

Link copied