ওয়াজের টাকা নিয়ে উধাও হতেন মাওলানা শরিফুল

নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার বাইতুল মামুর জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা এ বি এম শরিফুল ইসলাম (৩০) বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে নিজের পরিচয় দিতেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে। প্রায়ই তিনি ভারত, দুবাই ও সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে আমন্ত্রণ পান বলেও দাবি করতেন। এছাড়া বাইতুল মামুর জামে মসজিদের ইমাম হলেও ভিজিটিং কার্ডে নিজের পরিচয় লিখেছেন নারায়ণগঞ্জ জামে মসজিদের খতিব হিসেবে।
তবে এসবের আড়ালে মাওলানা এ বি এম শরিফুল ইসলামের মূল পরিচয় তিনি একজন প্রতারক। বিশিষ্ট বক্তা মীর হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদীর ছাত্র ও পিএস হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ওয়াজ মাহফিল কমিটির কাছ থেকে নিতেন মোটা অংকের টাকা। কমিটির লোকজনকে আশ্বাস দিতেন তাদের ওয়াজ মাহফিলে প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মীর হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদী।
ওয়াজের দিন কমিটির লোকজন তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে ‘হুজুরকে নিয়ে বের হচ্ছি, রাস্তায় আছি, আর ৩০ মিনিট লাগবে’- এসব মিথ্যা আশ্বাস দিতে দিতে এক পর্যায়ে মোবাইল নম্বর বন্ধ করে ফেলতেন। এরপর কোনোভাবেই হদিস পাওয়া যেত না তার। কমিটির কাছ থেকে যুক্তিবাদী হুজুরের নাম করে টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যেতেন মাওলানা শরিফুল।
শুক্রবার (১২ মার্চ) সকালে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার হোসেনপুর গ্রামের বাসিন্দা আল রাসেল (৩২) নামে এক ব্যক্তি মাওলানা শরিফুলের বিরুদ্ধে মৌখিক অভিযোগ করেন। এ অভিযোগের ভিত্তিতে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানা পুলিশের একটি টিম তাকে রাতেই বন্দর থানাধীন নমুনা বাজার এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। শনিবার (১৩ মার্চ) সকালে মাওলানা শরিফুলের বিরুদ্ধে বাদী হয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একটি মামলা করেন আল রাসেল ।
মামলার অভিযোগে রাসেল বলেছেন, আমাদের গ্রামের ওয়াজ মাহফিলের প্রধান বক্তা হিসেবে মীর হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদীকে দাওয়াত করার জন্য আমি ও আমার গ্রামের আরেক বাসিন্দা কাজী মোহাম্মদ নইম উদ্দিন (৪৫) ১৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাধীন আকিজ স্টেশনের সামনে আমরা মাওলানা নাজমুল (এ বি এম শরিফুল ইসলাম) নামক একজনের সঙ্গে দেখা করি। তিনি নিজেকে মাওলানা পীর হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদীর পিএস হিসাবে পরিচয় দেন আমাদের। পরে যুক্তিবাদী হুজুরকে আমাদের মাহফিলে আনতে তার সঙ্গে ৫০ হাজার টাকার চুক্তি করি। কাছে নগদ টাকা না থাকায় বিকাশ নম্বর থেকে নাজমুলকে আমরা তার বিকাশ নম্বরে নয় হাজার টাকা বুকিং মানি বাবদ দিই। পরবর্তীতে নাজমুলের সঙ্গে কাজী মোহাম্মদ নইম উদ্দিনের যোগাযোগ হয় এবং তার আশ্বাস পেয়ে মাওলানা মীর হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদী হুজুরকে প্রধান বক্তা হিসেবে উল্লেখ করে গত ৫ মার্চ আমাদের গ্রামে ঈদগা মাঠে মাহফিলের আয়োজন করি।
আমরা অনেক টাকা পয়সা খরচ করে মাহফিল এর জন্য ব্যানার, পোস্টার, প্রচার-প্রচারণা ও প্যান্ডেল করি। পরবর্তীতে মাহফিলের দিন ৫ মার্চ তারিখ সকালে নাজমুলকে বিকাশে আবারও দ্বিতীয় দফায় ২০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। মাহফিলের দিন তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে সে আমাদের বলে, ‘হুজুরকে নিয়ে বের হচ্ছি, বের হয়েছি রাস্তায় আছি, আর ৩০ মিনিট সময় লাগবে’ ইত্যাদি কথা বলে মিথ্যা সান্ত্বনা দিতে থাকেন। কিন্তু রাত ১২টা পর্যন্ত যুক্তিবাদী হুজুরের অপেক্ষা করে মাহফিলে আসা লোকজন আমাদের অপমান অপদস্থ করে সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে চলে যায়। তখন তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তার মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে আমরা বিভিন্নভাবে জানতে পারি মাওলানা নাজমুলের আসল নাম মাওলানা এ বি এম শরিফুল ইসলাম। তিনি নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা।
রাসেল আরও উল্লেখ করেন, আমাদের মনে হয়েছে মাওলানা শরিফুল ইসলাম মাওলানা মীর হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদী হুজুরকে আমাদের মাহফিল সম্পর্কে জানানো সত্ত্বেও তিনি অধিক অর্থের প্রলোভনে পড়ে আমাদের মাহফিলে না এসে একই দিনে অন্য কোনো মাহফিলে যোগদান করেন। অথবা মাওলানা শরিফুল ইসলাম টাকা আত্মসাৎ করার জন্য আমাদেরকে মিথ্যা পরিচয় ও মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছেন।
এ বিষয়ে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হাফিজ আল ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাওলানা এ বি এম শরিফুল ইসলামকে গ্রেফতারের পর থেকে তার বিরুদ্ধে আমরা এখন পর্যন্ত এ ধরনের ৩০-৪০টি অভিযোগ পেয়েছি। তিনি নিজেকে মাওলানা মীর হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদীর ছাত্র পরিচয় দিয়ে নিজের নামের শেষে যুক্তিবাদী উপাধি লাগাতেন। এছাড়া নিজেকে তার পিএস পরিচয় দিয়ে ওয়াজের তারিখ দিয়ে মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
তিনি বলেন, তাকে গ্রেফতার করার পর থেকেই মাওলানা মীর হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদী নিজে মোবাইল ফোনে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে পুলিশ ও অভিযোগকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন যাতে অভিযুক্ত এ বি এম শরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ না করা হয়। এজন্য মাওলানা মীর হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদী বিনা টাকায় মাহফিল করে দিতে চেয়েছেন। এমনকি আজ তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুনুর রশীদের কাছে অনুরোধ জানিয়ে মাওলানা আজাদী নামের একজন প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন তিনি, যাতে আসামিকে (শরিফুল) ক্ষমা করা হয়। তবে এ বিষয়ে আমাদের আইনি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। প্রয়োজন হলে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আমরা মাওলানা মীর হাবিবুর রহমান যুক্তিবাদীর কাছে যাব।
এমএসি/আরএইচ