সংসদ নির্বাচন ঘিরে সর্বোচ্চ সতর্কতা, বিশৃঙ্খলা দমনে কঠোর নির্দেশনা

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সম্ভাব্য বিশৃঙ্খলা, কেন্দ্র দখল বা সহিংসতা ঠেকাতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থান নিয়েছে সরকার। মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ-র্যাব-বিজিবি-সশস্ত্র বাহিনীকে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদরদপ্তরের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ভোটের মাঠে আইনের ব্যত্যয় ঘটালে যেই হোক কঠোর শাস্তিই অপেক্ষা করছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কোন পরিস্থিতিতে কী ব্যবস্থা নেবেন, সে বিষয়ে সরকারের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকবে।
সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনী এলাকায় যে কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ড ঘটলেই তাৎক্ষণিক আইন প্রয়োগ করতে হবে, এ নিয়ে কোনো শিথিলতা থাকবে না। এছাড়া নির্বাচনী শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ইসির পাশাপাশি মাঠের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, জেলা প্রশাসন, র্যাব, বিজিবি এবং প্রয়োজনে সশস্ত্র বাহিনী সমন্বিতভাবে কাজ করবে। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করা নির্বাহী কর্তৃপক্ষের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এবারের নির্বাচনে এই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা কঠোরভাবে বাস্তবায়নে নির্দেশনা থাকবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো আরও জানিয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নের শঙ্কা বাড়লে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো সর্বোচ্চ প্রস্তুতিতে থাকে। নির্বাচনী আচরণবিধি, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) এবং ফৌজদারি কার্যবিধিসহ বিভিন্ন আইনে নির্বাচনকেন্দ্রিক দায়িত্বে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসার সদস্যদের করণীয় স্পষ্টভাবে নির্ধারিত। আরপিও-১৯৭২-এর ধারা ৭৩, ৭৪, ৭৮, ৭৯, ৮০, ৮১ ও ৮২-তে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, অস্ত্র প্রদর্শন, ব্যালট দখল, ভোটারকে বাধা দেওয়া বা ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার মতো অপরাধে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব আইনের প্রয়োগে শিথিলতা দেখা দিলে পুরো নির্বাচনী পরিবেশই অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে।
আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন-২০০২-এর ধারা ২, ৪, ৫ ও ১৪ নির্বাচনকালীন অপরাধ দমনে ‘শেষ অস্ত্র’ হিসেবে বিবেচিত হয়। চাঁদাবাজি, দাপট দেখানো, যানবাহনে ভাঙচুর বা সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মতো অপরাধে অডিও–ভিডিও প্রমাণ আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে, এমন স্পষ্ট নির্দেশনাও রয়েছে আইনের ধারা ১৪-তে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জানান, নির্বাচনী এলাকায় নাশকতা দমন, অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তার, ব্যালট বাক্স দখল প্রতিরোধ এবং কেন্দ্রের ৪০০ গজের মধ্যে প্রচারণা নিষিদ্ধ, এসব নির্দেশনা অনুযায়ীই অভিযান পরিচালিত হয়। আরপিওর ধারা ৮১ অনুযায়ী ব্যালট পেপার বা ব্যালট বাক্স জোরপূর্বক দখলে অভিযুক্তকে সর্বোচ্চ ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান আছে।
ভোটকেন্দ্র ঘিরে আইন
নির্বাচনী আচরণবিধি–২০০৮ অনুযায়ী ভোটের দিনে কেন্দ্রের ভেতরে কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী বা বহিরাগত অবস্থান করতে পারবেন না। আরপিওর ধারা ৭৮ অনুযায়ী ভোটের আগে–পরে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কেউ অস্ত্র প্রদর্শন বা বিশৃঙ্খলামূলক আচরণ করলে ন্যূনতম ২ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে। অস্ত্র, লাউডস্পিকার এবং রাজনৈতিক কর্মীদের কার্যক্রমে কঠোর নিষেধাজ্ঞা থাকবে ভোটকেন্দ্রকে ঘিরে।

আরপিওর ধারা ৭৯ অনুযায়ী কেন্দ্রের ৪০০ গজ ব্যাসার্ধের মধ্যে কোনো ধরনের প্রচারণা চালালে ৬ মাস থেকে ৩ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
ধারা ৮০-তে ভোটের দিন কেন্দ্রের আশপাশে লাউডস্পিকার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে; এ অপরাধেও সমপরিমাণ শাস্তির কথা বলা হয়েছে। ভোটের সময় কোনো রাজনৈতিক কর্মী বা বহিরাগত গোলযোগ সৃষ্টি করলে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। নির্বাচনী আচরণবিধির ধারা ১১-তে ভোটের দিনে অস্ত্র বহন একেবারেই নিষিদ্ধ বলেও স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন–২০০২-এর ধারা ১৪ অনুযায়ী, ভিডিও, অডিও ও স্থিরচিত্র আদালতে সরাসরি গ্রহণযোগ্য প্রমাণ হিসেবে গণ্য হবে। ফলে নির্বাচনী অপরাধ প্রমাণে এখন আর জবানবন্দি বা মৌখিক সাক্ষ্যের ওপর এককভাবে নির্ভর করতে হবে না
পরিস্থিতি গুরুতর হলে সশস্ত্র বাহিনীর হস্তক্ষেপ
ফৌজদারি কার্যবিধি (সিআরপিসি)-১৮৯৮-এর ধারা ১২৭ থেকে ১৩২ নির্বাচনী নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধারা ১২৭ অনুযায়ী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা থানার ওসি অবৈধ সমাবেশ ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন। ধারা ১৩১–এ বলা হয়েছে, জরুরি পরিস্থিতিতে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি ছাড়াই সেনাবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সমাবেশ ছত্রভঙ্গ, গ্রেপ্তার এবং আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারবেন।
এ ছাড়া ধারা ১৩২ নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে মামলা বা আইনি ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা দেয়। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাহিনীর অভিযান আরও কার্যকর হয়।

বিশেষ ক্ষমতা আইনে সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশে ৩ বছরের জেল
বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৭৪ নির্বাচনকেন্দ্রিক নাশকতা, সাম্প্রদায়িক উসকানি ও সহিংসতা ঠেকাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা। আইনের ধারা ২৩ অনুযায়ী, সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত এলাকায় অনুমতি ছাড়া কেউ প্রবেশ করলে সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। ধারা ২০-তে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোনো সাম্প্রদায়িক বা ধর্মীয় সংগঠন গঠন করা নিষিদ্ধ; এ অপরাধেও রয়েছে ৩ বছরের কারাদণ্ডের বিধান। ধারা ১৯ অনুযায়ী, কোনো সংগঠন জনশৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারে বলে মনে করলে সরকার তার কার্যক্রম সর্বোচ্চ ৬ মাস পর্যন্ত স্থগিত করতে পারে।
বাধা দিলেই গ্রেপ্তার, অডিও-ভিডিও প্রমাণ গ্রহণযোগ্য
ভোট চলাকালে কেউ যদি ভোটারকে কেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়, ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বা ব্যালট দখলের চেষ্টা করে- আরপিওর ধারা ৭৩ ও ৮২ অনুযায়ী এগুলো গুরুতর অপরাধ। এসব অপরাধে সর্বনিম্ন ১ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে।
আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন-২০০২ এর ধারা ১৪ অনুযায়ী, ভিডিও, অডিও ও স্থিরচিত্র আদালতে সরাসরি গ্রহণযোগ্য প্রমাণ হিসেবে গণ্য হবে। ফলে নির্বাচনী অপরাধ প্রমাণে এখন আর জবানবন্দি বা মৌখিক সাক্ষ্যের ওপর এককভাবে নির্ভর করতে হবে না।

বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট ও ভুয়া ভিডিও ছড়ালে ব্যবস্থা
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৫-এর ধারা ২৩-এ নির্বাচনকে লক্ষ্য করে এআই–ভিত্তিক বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট, ভুয়া তথ্য বা ডিজিটাল অপপ্রচার ছড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া ভিডিও, বিকৃত তথ্য বা অপপ্রচার ছড়িয়ে নির্বাচনের পরিবেশ প্রভাবিত করার অভিযোগ পাওয়া গেলে সাইবার মনিটরিং টিম তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবে।
ঘুষ ও ভুয়া পরিচয়ে ভোট- সবই দণ্ডবিধিতে কঠোর অপরাধ
বাংলাদেশ দণ্ডবিধি-১৮৬০-এর বিভিন্ন ধারা নির্বাচনী অপরাধকে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। দণ্ডবিধির ধারা ১৭১(খ) অনুযায়ী, ভোটের বিনিময়ে ঘুষ দেওয়া বা নেওয়া অপরাধ; এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। ধারা ১৭১(ঘ) ভুয়া পরিচয়ে ভোট প্রদানকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যার শাস্তিও ১ বছরের কারাদণ্ড। একইভাবে ধারা ১৭১(ছ)–এ মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর প্রচারণা ছড়ানোকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার জাহিদ রহমান বলেন, এবারের নির্বাচনে আইন প্রয়োগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বিধিনিষেধের ধারাবাহিক ও কঠোর বাস্তবায়ন। আইন তো আগেও ছিল, কিন্তু প্রয়োগে শিথিলতা থাকায় অনেক নির্বাচনী অপরাধ বিচারের মুখ দেখেনি। যদি আরপিও, দ্রুত বিচার আইন, দণ্ডবিধি ও বিশেষ ক্ষমতা আইন সমন্বিতভাবে মাঠে প্রয়োগ করা যায়, তাহলে কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই বা সন্ত্রাস–সৃষ্টির মতো অপরাধ কার্যত শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে।
এমএম/এমএসএ
