অনলাইনে মেয়ে সেজে প্রবাসীদের অর্থ হাতিয়ে নিত চক্রটি

মেয়ে সেজে প্রবাসীদের ইমো আইডি হ্যাক করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া চক্রের মূলহোতাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিবি)।
সোমবার (২২ ফেব্রুয়ারি) নাটোরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করেছে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগ।
গ্রেপ্তাররা হলেন— মো. সোহাগ আহমেদ (২০), মো. রিপন ইসলাম (৩৩), মো. সোহেল রানা (৩১) ও মো. লিটন আলী (৩০)। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে দুইটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে।
ডিবি সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালের ২৬ অক্টোবর রাজধানীর হাজারীবাগের বাসিন্দা সুরাইয়া আক্তারের কাছে তার ইরাক প্রবাসী ভাই মো. সামছুল হকের (৩৪) ইমো নম্বর থেকে একটি ভয়েস ম্যাসেজ আসে। ভয়েস ম্যাসেজটি হুবহু সামছুল হকের কণ্ঠের মতো ছিল। ভয়েস ম্যাসেজে বলা হয়, সামছুল হক ইরাকের কোনো হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন, তিনি অসুস্থ। তার চিকিৎসার জন্য দেশ থেকে টাকা পাঠাতে হবে।
ভয়েস ম্যাসেজটি শোনার পর সুরাইয়া দ্রুত তার মা শামসুন্নাহারকে বিষয়টি জানায়। পরে ছেলের অসুস্থতার কথা জানতে পেরে ভয়েস ম্যাসেজে দেওয়া নম্বরে বিকাশ ও নগদে পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার টাকা পাঠান শামসুন্নাহার। টাকা পাঠানোর দুই দিন পর অর্থাৎ ৩০ অক্টোবর ছেলের সঙ্গে কথা বলে মা জানতে পারেন, সামছুল হকের ইমো আইডি হ্যাক হয়েছে। আর তিনি অসুস্থও না এমনকি হাসপাতালেও ভর্তি ছিলেন না। পরে তারা বুঝতে পারেন ইমো আইডি হ্যাক করে প্রতারণার মাধ্যমে প্রতারকরা তাদের টাকাগুলো আত্মসাৎ করেছে।
এ ঘটনার দীর্ঘদিন পর গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ডিএমপির হাজারীবাগ থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা দায়ের করেন প্রবাসী সামছুল হকের মা শামসুন্নাহার। পরে এই মামলার ছায়া তদন্ত করতে গিয়ে চক্রটির মূলহোতা মো. সোহাগ আহমেদসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগ।
বুধবার (১ মার্চ) ঢাকা পোস্টকে এসব তথ্য জানান ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (দক্ষিণ) বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) সাইফুর রহমান আজাদ।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে মামলা হওয়ার পর আমরা ছায়া তদন্ত শুরু করি। পরে প্রযুক্তির সহায়তায় সোমবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) নাটোরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়। আসামিদের গ্রেপ্তারের পর দুইদিনের রিমান্ডে এনে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। শুধু এই ঘটনা নয়, এমন আরও অনেক প্রতারণার ঘটনা ঘটিয়েছে চক্রটি।
যেভাবে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে চক্রটি
ডিবি সূত্রে জানা যায়, গ্রেপ্তাররা সঙ্গবদ্ধভাবে প্রতারণা করে থাকে। প্রতারণা করার জন্য তারা মূলত মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানকারী প্রবাসীদের টার্গেট করে। প্রথমে প্রতারকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সুন্দরী মেয়েদের ছবি দিয়ে ফেক আইডি খোলে। পরে এসব আইডি থেকে প্রবাসীদের আইডিগুলোতে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায়।
প্রবাসীরা রিকুয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করলে বা ম্যাসেজে রিপ্লাই দিলে প্রতারকরা তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে। এমনকি পুরুষ প্রতারকরা ম্যাসেঞ্জারে নারী কণ্ঠে কথা বলে প্রবাসীদের সঙ্গে বিভিন্ন অন্তরঙ্গ আলাপচারিতা করে বিশ্বাস স্থাপন করে। এর একপর্যায়ে প্রতারকরা ভিডিও কলের প্রলোভন দেখিয়ে ভিকটিমদের ইমো নম্বর নেয়।
এ বিষয়ে এডিসি সাইফুর রহমান আজাদ বলেন, প্রতারকরা ভিকটিমের নম্বর দিয়ে তাদের ডিভাইসে একটি ইমো অ্যাকাউন্ট খোলার চেষ্টা করে ও ভিকটিমের কাছে যাওয়া ওটিপি নম্বর বিভিন্ন কৌশলে নিয়ে নেয়। ওটিপি পাওয়ার পর তারা প্রবাসীর ইমো অ্যাকাউন্টটি আয়ত্বে নিয়ে প্রথমে পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করে ফেলে। পরবর্তীতে ইমো-বেটা ব্যবহার করে প্রবাসীর অ্যাকাউন্টের নম্বর পরিবর্তন করে।
এর ফলে ওই প্রবাসী আর তার অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করতে পারে না। এরপর চক্রটি অ্যাকাউন্টের প্রিভিয়াস হিস্টোরিতে গিয়ে পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের নম্বর সংগ্রহ করে। পরে নানা কারণ ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে চক্রটি প্রবাসীদের পরিবারের কাছ থেকে টাকা আত্মসাৎ করে। এভাবে প্রতারণার ফাঁদ পেতে তারা ভিকটিমদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।
তিনি বলেন, চক্রটি বিভিন্ন ফেক ফেসবুক ও মেসেঞ্জার অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে বিভিন্ন নারীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে। পরবর্তীতে ভিকটিমদের প্রলুব্ধ করে ভিডিও কলে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তোলে। ভিকটিমকে বিভিন্ন পর্ন সাইটের ছবি/ভিডিও পাঠিয়ে স্ক্রিনশট ব্ল্যাকমেইলের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা টাকা আত্মসাৎ করে।
তারা যেভাবে প্রতারক হয়ে ওঠে
ডিবি সূত্রে জানায়, গ্রেপ্তার সোহাগ এই চক্রের মূলহোতা। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে সে মোবাইল হার্ডওয়্যার অ্যান্ড সফ্টওয়্যার ফিক্সিংয়ের কাজগুলো খুব ভালোভাবে রপ্ত করে। এর সঙ্গে মেয়েলি কণ্ঠে সুরেলাভাবে কথা বলার একটি গুণ তার আগে থেকেই ছিল। পরবর্তীতে এই দুই দক্ষতা ব্যবহার করে প্রতারণার ফাঁদ পেতে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার লোভ তাকে পেয়ে বসে। এই প্রতারণার টার্গেট হিসেবে সে বেছে নেয় অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম ইমো ব্যবহারকারী মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের।
প্রতারণায় সহযোগী হিসেবে সে প্রথমে তার আপন ভাই মো. রিপন ইসলামকে নেয়। রিপন প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ করা টাকা ক্যাশ-আউটের কাজ করত। এই প্রতারণা চক্রের আরও দুই সক্রিয় সহযোগী মো. সোহেল রানা ও মো. লিটন আলী। এই প্রতারক চক্রটি প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত টাকা দিয়ে জায়গা-জমি কিনে ও বিলাসবহুল বাড়ি তৈরির মাধ্যমে উন্নত জীবনযাপন করে।
ডিবির পরামর্শ
সোহাগ আহমদের মতো প্রতারকদের হাত থেকে বাঁচার জন্য জনসাধারণের উদ্দেশ্যে কিছু পরামর্শ দিয়েছে ডিবি। ডিবির পরামর্শগুলো হলো:
১। ইমো অ্যাপ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা।
২। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কারো সঙ্গে আলাপচারিতায় সাবধানতা অবলম্বন করা।
৩। যাচাই-বাছাই না করে বিকাশ কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে কাউকে টাকা না দেওয়া।
৪। ইমো বা অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো আত্মীয়-স্বজনের আইডি থেকে টাকা চাওয়া হলে আগে তা যাচাই-বাছাই করে নেওয়া।
৫। মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত প্রবাসীদের ইমো ব্যবহার ও ইমো হ্যাকের ব্যাপারে সচেতন হওয়া।
৬। ই-ট্রানজেকশনের ক্ষেত্রে কাকে টাকা দিচ্ছেন তার সম্পর্কে সু-স্পষ্টভাবে ধারণা নেওয়া।
৭। ইমো/ম্যাসেঞ্জারে অপরিচিত গ্রুপ কলে যুক্ত না হওয়া।
৮। কখনো অপরিচিত/স্বল্প পরিচিত কারো সঙ্গে ব্যক্তিগত ইমো নম্বর অথবা ওটিপি শেয়ার না করা।
৯। অশ্লীল গ্রুপে নিজেকে যুক্ত না করা।
এমএসি/কেএ