এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সম্প্রসারণ

হাতিরঝিল ভরাট-পান্থকুঞ্জ পার্ক ‘ধ্বংস’ বন্ধের আহ্বান

Dhaka Post Desk

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

১৩ মে ২০২৩, ০৬:২৫ পিএম


হাতিরঝিল ভরাট-পান্থকুঞ্জ পার্ক ‘ধ্বংস’ বন্ধের আহ্বান

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সম্প্রসারণের নামে হাতিরঝিল ভরাট ও পান্থকুঞ্জ পার্ক ধ্বংসের অপরিণামদর্শী আয়োজন অনতিবিলম্বে বন্ধ করতে আহ্বান জানিয়েছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)।

শনিবার (১৩ মে) অনলাইনে আয়োজিত ‘হাতিরঝিল, পান্থকুঞ্জ পার্ক ও সংলগ্ন এলাকার ওপর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পরিকল্পনাগত প্রভাব-আইপিডির পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানানো হয়।

বক্তারা বলেন, রাজধানীর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প শুরু থেকেই অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতার মধ্য দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে, যা জনদুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের আইন, পরিকল্পনা ও যথাযথ পদ্ধতির তোয়াক্কা না করে হাতিরঝিলের জলাধার ভরাটের মাধ্যমে পরিবেশ ধ্বংস করা হয়েছে। কোনো ধরনের পরিকল্পনাগত প্রভাব বিশ্লেষণ ছাড়াই নতুন করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য পলাশী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা হাতিরঝিল প্রকল্পের সার্বিক লক্ষ্য ও উপযোগিতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করবে।

তারা বলেন, এই প্রক্রিয়া থামানো না গেলে পান্থকুঞ্জ পার্ক নষ্ট কবার পাশাপাশি পলাশী পর্যন্ত বিদ্যমান রাস্তার উপযোগিতাও নষ্ট হবে। এতে এসব এলাকার মানুষজনের জীবনযাত্রা ব্যাহত হবে। মেগা প্রজেক্টের বিনিয়োগ ফেরত আনা ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের সুযোগ করে দেওয়ার এই আয়োজনের মাধ্যমে শহর ধ্বংস করার যাবতীয় আয়োজন করা হয়েছে, যা অনতিবিলম্বে বন্ধ করা উচিত।

অনুষ্ঠানের মূল প্রবন্ধে আইপিডির পক্ষ থেকে নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড.আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা এবং সমন্বয় না করেই এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন র‍্যাম্প নির্মাণ ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। কোনো ধরনের পরিকল্পনাগত প্রভাব বিশ্লেষণ ছাড়াই নতুন করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের যে এক্সটেনশন রাস্তা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা হাতিরঝিল প্রকল্পকে ধ্বংস করবে। হাতিরঝিলে প্রস্তাবিত ৪১টি পিলার প্রকল্প এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জলাধারের পানিপ্রবাহ ও সার্বিক উপযোগিতা ধ্বংস করবে।

তিনি বলেন, জলাধার ভরাটের উদ্যোগ জলাধার সংরক্ষণ আইন ও বিভিন্ন পরিকল্পনার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। পৃথিবীর উন্নত ও আধুনিক শহরগুলো নগর এলাকায় ফ্লাইওভারকেন্দ্রিক পরিবহন সমস্যা সমাধানের কৌশল থেকে সরে এসেছে। অথচ আমরা এখন পরিবহন সমস্যার সমাধান কৌশল হিসেবে নগর এলাকায় ফ্লাইওভারকেন্দ্রিক পরিবহন সমাধান পরিকল্পনা করে যাচ্ছি, যা ব্যক্তিগত গাড়িকে উৎসাহিত করে। পরিবহন-ভূমি ব্যবহার এর পারস্পরিক সম্পর্কজনিত প্রভাব বিশ্লেষণ না করেই অধিকাংশ পরিবহন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে।

আইপিডির পক্ষ থেকে বলা হয়, পরিবহন অবকাঠামো সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে জনগণের মতামত নেওয়া, গণশুনানির আয়োজন করার প্র‍য়াস একেবারেই অনুপস্থিত। ট্রাফিক সমস্যার সমাধানে অর্থনৈতিক ও পরিকল্পনাগত প্রভাব যথাযথ বিবেচনা না নিয়েই মেগা প্রকল্পে অতি আগ্রহ। এক্ষেত্রে দেশীয় স্বার্থান্বেষী মহলের পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারী রাষ্ট্র ও বিদেশি ঠিকাদারদের প্রভাবে অতি ব্যয়বহুল এবং কম উপযোগী পরিবহন অবকাঠামো প্রকল্প গ্রহণ, যা শ্বেতহস্তীতে পরিণত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। টপ ডাউন প্ল্যানিং বা ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া এ ধরনের পরিকল্পনা জনগণের প্রকৃত চাহিদাভিত্তিক সমাধানের সঙ্গে সম্পৃক্ততাবিহীন।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কারণে হাতিরঝিলের জলাধারে বালু ফেলে ভরাট ও প্রকল্প সম্প্রসারণ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে নাগরিকদের প্রদেয় ৪৬৯টি মতামত বিশ্লেষণ করেছে আইপিডি। এতে দেখা গেছে, হাতিরঝিল জলাধার ভরাট ও প্রকল্প সম্প্রসারণ বিষয়ে নেতিবাচক মন্তব্য এসেছে শতকরা ৭১ শতাংশ। এছাড়া ইতিবাচক ১৩ শতাংশ, নিরপেক্ষ ৩ শতাংশ ও অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য এসেছে ১৩ শতাংশ। ফলে দেখা যায়, সাধারণ মানুষের অধিকাংশই এ ধরনের অন্যায্য বিষয় সমর্থন করছেন না। তারপরও এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরিবেশের বিপর্যয় ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে। যা ইতোমধ্যে পরিবেশগত বিপর্যস্ত ঢাকা মহানগরীর জন্য অশনিসংকেত। সরকারি সংস্থাগুলোর যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা অত্যন্ত নাগরিকদের জন্য অত্যন্ত হতাশার।

অনুষ্ঠানে আইপিডি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, বিশদ সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়াই হাতিরঝিলের জলাধার ভরাট ও পান্থকুঞ্জ পার্কের মধ্য দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ে সম্প্রসারণ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। ১৯৫৩ সালের টাউন ইম্প্রুভমেন্ট আইন অনুযায়ী রাজউকের অনুমতি ছাড়া কিংবা ডিটিসিএর সমন্বয় ছাড়া এ ধরনের প্রকল্প কীভাবে বাস্তবায়ন করা হয়? পরিবেশ ও নগর এলাকাকে ধ্বংস করে এ ধরনের প্রকল্পের সঙ্গে যেসব পেশাজীবী ও কর্মকর্তা যুক্ত থাকেন, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি জানাই।

আইপিডির পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশে যোগাযোগ ও পরিবহন অবকাঠামোর ক্ষেত্রে প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত আগে নেওয়া হয়, তারপর সেটাকে বৈধ করার জন্য সমীক্ষা বা সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ব্যক্তিগত গাড়িতে যেই ৫ শতাংশ লোক চলাচল করেন, তাদের জন্য বড় বড় মেগা প্রজেক্ট নেওয়া হয়। অথচ তার কুফল ভোগ করেন বাকী ৯৫ শতাংশ মানুষ। এ প্রবণতা থেকে বের হয়ে কম ব্যয়ে ও সহজে বাস্তবায়নযোগ্য অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবহন অবকাঠামো গড়ে তোলা জরুরি।

অনুষ্ঠানে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের মাধ্যমে ‘ঢাকার ফুসফুস’ হাতিরঝিলকে ‘মেরে ফেলার’ আয়োজন করা হচ্ছে। এক্সপ্রেসওয়ের ৪১টি পিলার যেন হাতিরঝিলের বুকে ৪১টি পেরেক ঠুকবার আয়োজন। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ঢাকার অন্যতম কম তাপীয় এলাকা হাতিরঝিলের তাপমাত্রা অনেকাংশে বেড়ে যাবে।

এএসএস/কেএ

Link copied