লঞ্চে রোটেশন পদ্ধতি : ক্ষুব্ধ যাত্রীরা, মালিকরা বলছেন উপায় নেই

# লোকসান কমাতেই রোটেশন পদ্ধতি
# যাত্রীরা বলছেন দুইটি লঞ্চ থাকায় নেওয়া হয় অতিরিক্ত ভাড়া
# তেলের দাম বৃদ্ধিতে বিপাকে লঞ্চ মালিকরা
# সদরঘাটের যানজট এড়াতে মেট্রোরেল সদরঘাট পর্যন্ত বর্ধিতকরণের দাবি
# যাত্রী কমায় বিপাকে হকাররাও
প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে ঢাকা-বরিশাল নৌ রুটের নিয়মিত যাত্রী ষাটোর্ধ্ব সায়েদুল ইসলাম। প্রথম যখন ঢাকায় এসেছিলেন তখন এত বিলাসবহুল লঞ্চ ছিল না। কিন্তু দিন বদলেছে, মানুষ হয়েছে শৌখিন। আর এ সৌখিনতার পূর্ণ ছোঁয়া প্রতীয়মান হয়েছে বছর কয়েক আগেই। বর্তমানে এ রুটে চলাচল করে কীর্তনখোলা-১০, পারাবাত-১২, সুন্দরবন ১০, অ্যাডভেঞ্চার-১০, মানামি ও এনভি শুভরাজের মতো বিলাসবহুল লঞ্চ। তবে পদ্মাসেতুর উদ্বোধন ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় জৌলুস হারিয়েছে লঞ্চ ব্যবসা।
তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আগের চেয়ে দ্বিগুণ ভাড়া বাড়িয়েছেন লঞ্চ মালিকরা, বর্তমানে যা পদ্মাসেতুর ওপর দিয়ে চলাচলকারী বাসগুলোর ভাড়ার সমান। ফলে লঞ্চের পরিবর্তে পদ্মাসেতু দিয়ে দ্রুততম সময়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে বাস ভ্রমণকেই বেছে নিচ্ছেন সায়েদুল ইসলামের মতো যাত্রীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ২৫ অক্টোবর পদ্মাসেতু চালু হওয়ায় এবং তেলের দাম লিটারে ৩০ টাকা বৃদ্ধির পাওয়ায় লঞ্চে বাড়ানো হয়েছে ভাড়া। এর ফলে লঞ্চের এ রুটে যাত্রী কমে গেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। তারপরও রুটে লঞ্চগুলো চালিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন মালিকরা। তবে যাত্রী সংখ্যা আরও কমে যাওয়ায় গত ১৭ জুলাই থেকে ঢাকা-বরিশাল নৌ রুটে প্রতিদিন দুইটি লঞ্চ সমন্বয় করে চালানোর সিদ্ধান্ত নেন তারা। এতে লঞ্চ মালিকদের লোকসানের পরিমাণ কিছুটা কমে এলেও যাত্রীদের জিম্মি করার একটি প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে বলে অভিযোগ সাধারণ যাত্রীদের।
পদ্মাসেতু চালু হওয়ায় এবং তেলের দাম লিটারে ৩০ টাকা বৃদ্ধির পাওয়ায় লঞ্চে বাড়ানো হয়েছে ভাড়া। এর ফলে লঞ্চের এ রুটে যাত্রী কমে গেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। তারপরও এসব রুটে লঞ্চগুলো চালিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন মালিকরা
সদরঘাটে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে সাইদুল ইসলামের কথা হয়। তিনি বলেন, পদ্মাসেতু চালু হওয়ায় লঞ্চের যাত্রী কিছুটা কমেছে। তারপরও ঢাকা বরিশাল রুটে চারটি লঞ্চ নিয়মিত চলাচল করত। তবে বর্তমানে লঞ্চ মালিকরা সমন্বয় করে রোটেশন পদ্ধতিতে প্রতিদিন দুইটি লঞ্চ চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে করে দুইটি লঞ্চই সিন্ডিকেট করে সাধারণ যাত্রীদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো ভাড়া নিচ্ছে। লঞ্চের পরিমাণ বেশি থাকলে এ সমস্যা হতো না। বাসে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা ভাড়া দিয়ে মাত্র তিন ঘণ্টায় বরিশালে পৌঁছানো যায়। এখন যদি লঞ্চের ভাড়াও বাসের সমান হয়ে যায়... তাহলে দীর্ঘ যানজট ঠেলে ছয়-সাত ঘণ্টা ব্যয় করে কে লঞ্চে যাবে? আমিই ভাবছি এখন থেকে বাসে যাব।
আরও পড়ুন>>সদরঘাটে ভিন্ন চিত্র
ঢাকা-হুইলার হাট-ভাণ্ডারিয়া রুটের যাত্রী গার্মেন্টস কর্মী শাহনাজ বেগম বলেন, আগে এ রুটে দুই-তিনটি লঞ্চ চলত। কিন্তু এখন যাত্রী কম হওয়ায় একটি লঞ্চ চলে। সেই সুযোগে আমাদের কাছ থেকে চারশ টাকা এমনকি মাঝে মাঝে সাড়ে চারশ টাকা ভাড়া নিয়ে থাকে। যদি ভাড়া না কমায় তাহলে আমিও আর লঞ্চে যাতায়াত করব না।
এদিকে লঞ্চ মালিকরা বলছেন, পদ্মাসেতু হওয়ায় একদিকে যেমন অর্ধেকের বেশি যাত্রী কমেছে, অন্যদিকে তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে প্রতি ট্রিপেই গুনতে হচ্ছে লোকসান। এই লোকসানের ভার বহন করতে না পেরে লঞ্চ কেটে বিক্রি করে দিয়েছেন অনেক লঞ্চ মালিক। তাই আমরা মালিকরা একপ্রকার বাধ্য হয়েই এই রোটেশন পদ্ধতি চালু করেছি। এ পদ্ধতি চালু করার পর কিছুটা হলেও যাত্রী পাই, এতেও যদি আমাদের লোকসানের পরিমাণ কিছুটা কমে। এই মুহূর্তে রোটেশন পদ্ধতি চালু করা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় ছিল না।
ইতোমধ্যে নয়টি রুটের লঞ্চ চলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি সামনে আরও কয়েকটি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। বন্ধ হওয়া এ রুটগুলো হলো— ঢাকা-মাদারীপুর, ঢাকা-তুষখালী, ঢাকা-পয়সারহাট, ঢাকা-আমতলী, ঢাকা-পাতারহাট, ঢাকা-টরকী, ঢাকা-রাঙ্গাবালী, ঢাকা-ঘোষেরহাট ও ঢাকা-পাতাবুনিয়া
রোটেশন পদ্ধতি নিয়ে যাত্রীদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে একাধিক লঞ্চ মালিকের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, আমরা যদি যাত্রীদের কাছ থেকে আগের মতো ভাড়া নিতে পারতাম... তাহলে আমাদের কাছেও ভালো লাগত। কিন্তু যাত্রী না থাকায় প্রতিটি ট্রিপে শুধু তেল খরচ বাবদ আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা লোকসান গুনতে হতো লঞ্চ মালিকদের। তাই এ লোকসান যেন কিছুটা কম হয় সেজন্য আমরা পরীক্ষামূলকভাবে রোটেশন পদ্ধতি চালু করেছি। সামনে যদি যাত্রীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় তাহলে আবার আগের মতো লঞ্চ চালু হবে।
আরও পড়ুন>>লঞ্চ ব্যবসায় শনির দশা, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক নৌ-রুট
পারাবাত-১২ লঞ্চের সুপারভাইজার নজরুল ইসলাম বলেন, রোটেশন পদ্ধতি চালু করার আগে চারটি লঞ্চে যে যাত্রী হতো, তাতে প্রতিটি লঞ্চের ট্রিপ প্রতি শুধু তেল খরচ খরচ বাবদ আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা লোকসান হতো। এই লোকসান কিছুটা কমানোর জন্যই মালিক সমিতি রোটেশন পদ্ধতি চালু করেছে। তবে এখানে যাত্রীদের কাছ থেকে কোনো অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া হয় না।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক লঞ্চ মালিক বলেন, একসময় লঞ্চ মালিকদের কাছে খুবই পরিচিত ছিলাম। হাতেগোনা কয়েকজন মালিকের মধ্যেও ছিলাম অন্যতম। কিন্তু আজ আমি প্রায় পথে বসে গেছি। যে কারণে আমার নামটিও আপনাকে মান-সম্মানের ভয়ে আপনাকে বলতে পারছি না। এখনো আমার কয়েক কোটি টাকা ঋণ আছে। জানি না ঋণগুলো কবে পরিশোধ করতে পারব। এরইমধ্যে ঋণের টাকা না দিতে পেরে একটি লঞ্চ কেটে বিক্রি করে দিয়েছি। আরেকটি লঞ্চ বিক্রির কথাবার্তা চলছে। এখন কোনোমতে ঋণের টাকাটা পরিশোধ করতে পারলেই হলো। কিন্তু হাতে মাত্র দুইটি লঞ্চ আছে। এ দুইটি বিক্রি করলেও হয়ত সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ হবে না।
আরও পড়ুন>>ধারণক্ষমতা ২০ হাজার, ২ লাখ যাত্রী নিয়ে ঢাকার পথে বরিশালের ১৯ লঞ্চ
সদরঘাট সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে নয়টি রুটের লঞ্চ চলাচল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি সামনে আরও কয়েকটি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। বন্ধ হওয়া এ রুটগুলো হলো— ঢাকা-মাদারীপুর, ঢাকা-তুষখালী, ঢাকা-পয়সারহাট, ঢাকা-আমতলী, ঢাকা-পাতারহাট, ঢাকা-টরকী, ঢাকা-রাঙ্গাবালী, ঢাকা-ঘোষেরহাট ও ঢাকা-পাতাবুনিয়া। যদিও চাঁদপুর ও ইলিশা ঘাটে আগের মতই লঞ্চগুলো চলছে। এ রুটে তেমন যাত্রী সংকট নেই।
এদিকে যাত্রী কমে যাওয়ায় সদরঘাটে হকারদের সংখ্যা দিনদিন কমেই যাচ্ছে। দিলীপ (৩৮) নামের এক হকার বলেন, প্রায় ১৩ বছর ধরে সদরঘাটে হকারি করছি। একসময় সারাদিন বিক্রির পরও ছয়-সাতশ টাকা আয় হতো। আর এখন ছয়-সাতশ টাকাও বিক্রি করতে পারি না। এখন তিনশ টাকাও আয় করতে পারি না। বউ-বাচ্চা নিয়ে কী খাব? জিনিসপত্রের যে দাম! আমার জানা মতে অর্ধেকের বেশি হকার গত কয়েক মাসে এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। তাদের মধ্যে কেউ রিকশা চালায়, কেউ বা বিভিন্ন কাজ করে... আবার অনেকেই গ্রামের বাড়ি চলে গেছে।
লঞ্চ ব্যবসার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, লঞ্চে ৬০ শতাংশের বেশি যাত্রী কমে গেছে। এর পেছনে আমরা পদ্মাসেতুকে নয় বরং তেলের দাম বৃদ্ধিকে দায়ী করতে চাই। কারণ তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভাড়া বাড়াতে হয়েছে। যাত্রী কমার আরেকটি কারণ হলো— গুলিস্তান কিংবা যাত্রাবাড়ী থেকে সদরঘাটে আসতে যাত্রীদের যে পরিমাণে যানজটের সম্মুখীন হতে হয়, তাতেই লঞ্চের যাত্রী আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। আমি সরকারের কাছে আবেদন জানাতে চাই, যেহেতু খুব শিগগিরই মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হয়ে যাবে... এই মেট্রোরেল যদি সদরঘাট পর্যন্ত বর্ধিত করা যায়, তাহলে আমাদের লঞ্চে আবার আগের মতো যাত্রী হবে।
রোটেশন পদ্ধতিতে যাত্রীদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার ব্যাপাররে চাইলে তিনি বলেন, এটা করা ছাড়া মালিকদের কোনো উপায় ছিল না। তেলের দাম যে পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে, সঙ্গে আশঙ্কাজনক হারে যাত্রীর সংখ্যা কমে যাওয়ায় এই চাপ সামাল দিতে পারেননি লঞ্চ মালিকরা। তাই এ পদ্ধতি চালু করেছেন। যদি আবার তেলের দাম কমে তাহলে এ পদ্ধতি থেকে মালিকরা সরে আসবেন। তবে যাত্রীদের ভোগান্তির কথা অস্বীকার করেন তিনি।
এমএল/কেএ