বইমেলায় ইমন চৌধুরীর উপন্যাস ‘বকুল বৃক্ষের শহর’
‘একজন নার্স এসে ইসাবেলাকে বেরিয়ে যেতে অনুরোধ করল। মন খারাপ করে উঠে গেল ইসাবেলা, ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে ইউরোপীয় এই তরুণী। বাদলের তলপেট আবারও ভারী লাগতে শুরু করেছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। আর ঠিক সে সময় বাদল যখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে হাজার হাজার মাইল দূরের এক শহরে, তার বাড়ির পাশে পোস্ট অফিসের লোকজন তার প্রিয় বকুল গাছটিতে নির্দয়ভাবে কুড়াল চালাচ্ছে।’
ইমন চৌধুরীর ‘বকুল বৃক্ষের শহর’ উপন্যাসের শেষ দৃশ্যটি যেন পুরো উপন্যাসটিকে চিত্রায়ন করেছে। বাংলাদেশের ছোট একটি মফস্বল শহরে বেড়ে উঠেছে বাদল। বাদলের শৈশব কৈশর জুড়ে আছে নানা স্মৃতি। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে বাদল ভাগ্যের পরিবর্তনে বেছে নেন প্রবাস জীবন। বাঙালির স্বপ্নের জায়গা ইউরোপ। সেই স্বপ্নকে ধরতে ইতালি পাড়ি দিয়ে বাদল এসে হাজির হন ফ্রান্সের ড্রনসি শহরে।
বাদলের সঙ্গে সঙ্গে এ উপন্যাসের পাঠকও যেন দেখতে পান ফ্রান্সের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমৃদ্ধির ছবি। ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় ফ্রান্সে টুরিস্টদের আনাগোনা অনেক। ফলে এখানে নানা ধরনের টুকিটাকি ব্যবসা করে যে কেউ ভালো অর্থ উপার্জন করতে পারেন। অপরিচিত এ শহরে বাদল এসে আশ্রয় পান মামার বন্ধুর বাড়িতে। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ফুল বিক্রির মতো সামান্য কাজ দিয়ে জীবন শুরু করেন বাদল। দেশে তার মা-বাবা, ভাই-বোন আর লাখ লাখ টাকা দেনা। এই শহরে কাজ করেই তার দেনা শোধ আর পরিবার চালিয়ে নেওয়ার কঠিন শপথ।
ফুল বিক্রি করতে গিয়েই পরিচয় হয় ইসাবেলার সঙ্গে। ইসেবেলা আর্মেনিয়ান তরুণী। অনেক বছর ধরে ফ্রান্সে আছেন। অপূর্ব সুন্দরী ইসাবেলা নাইট ক্লাবে চাকরি করেন। তার বয়ফ্রেন্ড আছে। তবু ইসাবেলার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে গভীর টান অনুভব করেন বাদল। প্রতিদিন বাদল তার অবিক্রিত ফুল ইসাবেলাকে উপহার দেন। ইসাবেলাও এতে আনন্দ পান। এরপর ঘটনা ক্রমেই ঘনীভূত হতে থাকে।
দূর ইউরোপে বাদল আর ইসাবেলার চরিত্র দুটি এতো আকর্ষণীয় ও নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলার দক্ষ কারিগর ইমন চৌধুরীকে ধন্যবাদ না দিলেই নয়। বর্তমানে বাংলা সাহিত্যে যে কয়েকজন খ্যাতিমান লেখক রয়েছেন তিনি তাদের একজন। এই উপন্যাসের মধ্যে যেমন বাস্তবতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে কল্পনা। বাস্তবতা ও কল্পনার মিলে যে মনস্তাত্ত্বিক দিক উন্মোচন করেছেন ইমন চৌধুরী, তা প্রশংসনীয়। বিশেষ করে ঢাকায় আর্মেনিয়দের যে ইতিহাস তিনি তুলে এনেছেন এ উপন্যাসে, তা পাঠকদের কাছে অভিনব মনে হবে।
তৃত্বীয় বিশ্ব থেকে প্রথম বিশ্বে গিয়ে যে জীবন যুদ্ধ করতে হয় তার একটি বাস্তব দলিল এ উপন্যাসের নায়ক বাদল। সামান্য হকারি করতে গিয়েও তাকে গ্রেফতার ও ছুরির আঘাত সহ্য করতে হয়। কষ্টের মধ্যেও তার বকুল বৃক্ষের কথা মন থেকে মুছে যায় না। জীবন সংগ্রাম, প্রেম আর ভ্রমণের স্বাদ পাওয়া যাবে এ উপন্যাসের বাঁকে বাঁকে।
সাহিত্যদেশ থেকে প্রকাশিত ও মাঝহার কচির শৈল্পিক প্রচ্ছদে দুইশত টাকা মূল্যের এ উপন্যাসটি পাঠ শেষে একজন পাঠকের এই কথাটিই মনে থাকবে ‘আমার জন্য কেঁদো না তোমরা, কেন শোক করো আর/আমি তো হারিয়ে যাইনি, শুধু একটু আগে চলে গেছি।’
এসএসএইচ