দাসের বলি তাসের দেশে

বইয়ের শুরুতেই লেখকের স্বীকারোক্তিতে পেলাম সাদাত হোসেন মান্টোর প্রতি লেখকের বিদ্যুতায়িত আনুগত্য। লেখক অকপটে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন; তিনি মান্টোর মতো তীক্ষ্ণ গল্প লিখতে চেয়েছেন। লেখকের ভাষায় “যে গল্প পড়ে পাঠক সুবোধের তাড়নায় ভুগবেন”।
একই সাথে এও বলেছেন, “আমি মান্টো নই, তাই আমার গল্পের ভাষা এবং ধরন আলাদা”। পাঠক হিসেবে আমার নিজস্ব কিছু অনুভূতি তৈরি হয়েছে। যা লেখক দ্বারা একেবারেই প্রভাবিত নয় বরং পাঠক হিসেবে আমার অবস্থান, “থার্ড আই”!
‘লাশালাশি’-গল্পের নাম দেখেই চোখ আটকে গেল! কষাকষির সাথে মিল রেখেই কি এমন নাম ভেবেছিলেন লেখক? লাশ নিয়েই দরকষাকষির চিত্র আছে গল্পে। দৈনিক রোজগারের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিক্রেতার লাশ বেচাবিক্রির চরিত্র হিসেবে গল্পে আবির্ভাব!
এতো কিছু থাকতে লাশ? পাঠক হিসেবে অণুগল্পের বৈশিষ্ট্যের লেন্স দিতে দেখার সময় কনফ্লিক্টের জায়গাটা দারুণ উপভোগ করেছি! দশ না পনেরো হাজার? ন্যায্য দাম কোনটা? ন্যায্য বলে কি আদৌ কিছু আছে?
অণুগল্পের পরিসর বেশ ছোট। গল্পের প্লট তৈরি করে, ক্লাইমেক্স ও রিসলভের ক্ষুদ্র অথচ পরিপূর্ণ চিত্র ফুটিয়ে তোলা সহজ কাজ নয়!
‘মানীর অপমান বজ্রপাত’ পাঠ করতে গিয়ে অনুভব করলাম লেখক কী চমৎকার করে গল্পটি এঁকেছেন! অণু সাইজের পরিপূর্ণ একটি গল্প! “…ঘটনা ঘটেছিল মাস ছয়েক আগে।…পেরেকের ওপর একটা বোর্ড ঝোলানো হয়।…লেখা ছিল, ‘আমাদের অঙ্গীকার, দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার। …বোকা বট গাছ! বিশ্বাস করেছিলো এই প্রতিশ্রুতি তারা রক্ষা করবে। …অপমানে আত্মহত্যা করল’।
‘দ্বন্দ্বপূরণ’-এ যম আর অর্বাচীন-এর কথোপকথন আমাকে গল্পের চরিত্র দুটো নিয়ে পাঠ শেষ হওয়ার পরেও ভাবিয়েছে! যমকে এক রকম দ্বন্দ্বের চিপায় ফেলে দিয়ে অর্বাচীন যে তৃপ্তি পেয়েছে তা পাঠক হিসবে বেশ উপলব্ধি করতে পারছিলাম।
‘কথা কম কবা’-এ ‘বাউল হাসছেন আর সাংবাদিক ক্ষেপে যাচ্ছেন…’; এভাবেই গল্পের শুরু। সাংবাদিকের কাজ কী? এমন প্রশ্নের উত্তর গল্পে সরাসরি আসেনি কিন্তু প্রশ্ন উত্তর পর্বের একটা চমৎকার খেলা সাংবাদিকের সাথে খেলা হয়েছে। খুব ইতিবাচকভাবে সাংবাদিকের চরিত্র এখানে আসেনি। এসেছে জেনেও না জানার ভানের গল্প! এসেছে সাংবাদিকের প্রশ্ন ছোঁড়ার দৃশ্য, অযথাই! বেশ ইন্টারেস্টিং যে চরিত্রের সাথে সাংবাদিকের কথোপকথন এসেছে, তা সমাজের এমন এক চরিত্র যারা সয়ে যায় নীরবে। ভদ্রতা করে। আচ্ছা শিল্পের মানুষ কি অভদ্র হতে পারে? যারা সত্যিই শিল্পকে নমস্কার করে শ্রদ্ধা ভরে?
আরও পড়ুন
সমাজের অণু বিষয়গুলো অণুগল্পের রূপেই এসেছে এ বইতে। লেখকের প্রয়াস ছিল মাত্রা চেতনা ধরে রেখেই চরিত্র নির্বাচন করা। ‘পিরিয়ড’ গল্পে মা ও মেয়ের উপস্থিতি নিয়ে ভাবতে বসে দেখলাম, চরিত্রের ধরন বেশ ফ্ল্যাট! মানে খুব বেশি বৈশিষ্ট্য এখান থেকে বের হয়নি! বোরকা পরা মায়ের চরিত্র কি কোনো সিম্বোলিক চরিত্র? তিনি আসলে গল্পে কি অবদান রাখছেন? স্যানিটারি প্যাডের ব্যবহারের সাথে হারাম বা হালালের প্রশ্ন সমাজের কোন শ্রেণির মানুষের? একই সাথে কোন শ্রেণির মানুষের মধ্যে এমতাবস্থায় পিরিয়ড বন্ধ করার বুদ্ধি মগজে আসে? সমাজের এই মানুষগুলো কারা? ডাক্তার কেন এমন কনসেপ্টকে প্রশ্রয় দেন?

‘মনন’ গল্পের শিরোনাম দেখে আমার শৈশবের দিনের কথা মনে পড়ে গেল! আব্বা আমাদের পারিবারিক লাইব্রেরির নাম দিয়েছিলেন মনন! মানুষের মনের, চিন্তার, ভাবনার বিশালতার স্বল্পতা এখানে এসেছে। মানুষকে মানুষ করতে চাওয়ার বাসনার সাথে মানুষের মতো চিন্তা করার বা গ্রহণ করার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক!
‘অপরূপ পূর্ণিমা’ গল্প পাঠের সময় বেশ আবেগী হয়ে গেলাম! একটা বাস্তব পেশার পরাবাস্তব চরিত্র এতোটা কাতর হয়ে একজন মেয়ের কথা ভাবলো? জীবিকার রিস্ক নিলো? সত্যজিৎ রায়-এর ‘মহানগর’ সিনেমায় দেখেছিলাম এমনই একটা দৃশ্য। প্রতিবাদের সুর চাকরি ছেড়ে দেওয়া পর্যন্ত গড়িয়ে গেছে সেখানে! অথচ কী সুন্দর, অনেকটাই নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে সিনেমার চরিত্র আবারও নতুন উদ্যমে চাকরি খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে! এ গল্পের চরিত্রের পরবর্তী জীবিকা ভাবনা অবশ্য পাঠক জানতে পারেন না!
শেষ হইয়াও হইলো না শেষ! এমন করে গল্প নির্মাণ হয়। অণুগল্প নির্মাণের শর্ত কী বলে? গল্পের মধ্য দিয়েই গল্পকারকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করছিলাম। গল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে লেখক বেশ সচেতন ছিলেন কোনো সন্দেহ নেই! প্রতিটি গল্পের জন্য মোর্যাল বা থিংকিং ম্যাটিরিয়েল ভেবে বের করা খুব সহজ নয়!
অণুগল্পের সীমাবদ্ধতা এই যে, চরিত্র নিয়ে খেলার জন্য স্পেস কম। কম স্পেসে ইন্টেরিওর দক্ষতা যেমন একটা ম্যাজিক, অণুগল্প লেখাও একটা ম্যাজিক বটে! কাজেই বইয়ের শুরু থেকে শেষ অব্ধি লেখক প্রায় তাল, লয়, ছন্দ ঠিক রাখার খুব চেষ্টা করেছেন! বেশ কিছু গল্পে চমৎকারভাবে সার্থক! হাতেগোনা কিছু গল্প কাছাকাছি অনুভূতি তৈরি করতে পেরেছে!
তবু আমি একজন মুগ্ধ পাঠক। সমাজের এতো সব অসংগতি, এতো ডাইমেনশন এসেছে আর তা শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছে মগজের চমৎকার পুষ্টি! এটা নিঃসন্দেহে উপভোগ্য! খুব দ্রুত পাঠ করেই বারবার নানা রকম চিন্তায় হারিয়ে যাওয়া যাচ্ছে! এটা আমার কাছে দারুণ!
একটা ব্যাপার কি সমাজের নানা অসংগতি চোখে অনেকের পড়ে, সবাই কি বলে? বলা যায়? আমি অনুভব করি কঠিন। আচ্ছা যা বলা যায় না তা তো অন্যভাবেও ভাগাভাগি করে নেওয়া যায়! মন হালকা হয়! বই পাঠ করার পর অনুভব করতে পারছিলাম লেখক এক অর্থে নিজেকেই হালকা করছিলেন! এতো অবলীলায় সবগুলো গল্পের ভিত সামাজিক অসংগতি নিয়ে লিখে গেলেন! আচ্ছা, লেখক কি নির্ভার হতে পেরেছিলেন?
অর্বাচীন-এর একাধিক উপস্থিতি গল্পে ছিল চোখে পড়ার মতোন! লেখক এঁদের নিয়ে বেশ রসিকতাই করেছেন! লেখকের থার্ড আই চিন্তার সাথে সাথে হিউমার যুক্ত করে ভাবনার ক্ষেত্রে এবং একই সাথে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে যে মাত্রা যুক্ত করেছেন তা অণুগল্পের বুননের সাথে চমৎকার মানানসই লেগেছে! চরিত্রের আবেগ নিয়ে খেলতে বসে লেখক পাঠকের আবেগের জায়গায় কম নাড়া দেননি! এটা সিরিয়াস বিষয়কে হালকা করেছে।
‘লাশ পরিহিত মাস্ক!’ এবং ‘অপেক্ষার আত্মহত্যা’; এ আবার কেমন গল্পের নাম? ‘অপেক্ষার আত্মহত্যা’-এর কী দুষ্টুভাবে চরিত্রের পরিকল্পনা পণ্ড হয়ে যায়! আর মাস্ক পড়ে লাশ হয়ে ওঠার গল্প করোনার সময়ের বাস্তবতা মেলে ধরে। বিষয়বস্তু করোনার হলেও এটি বর্তমান অন্যসব সামাজিক নিয়ম অবহেলার সাথে মানানসই! যেমন? সেখানে সেখানে মূত্র বিসর্জন! প্লেনে চড়ে যানবাহনের নিয়ম অবহেলা বা সাইনবোর্ড না মেনে যেখানে সেখানে ঠেলা গাড়ির ব্যবসা বসিয়ে দেওয়া!
মানুষের চৈতন্য কী বলে? সচেতনতার চর্চা না কি অসচেতনতা? এইসব চেতনার চর্চা কীসে হয়? স্কুলে পড়ে, চাকরি করে? সার্টিফিকেট জমিয়ে? পাঠক হিসেবে আমি মনে করি চেতনার চর্চা মজে পাঠে, ভাবনায়, প্রশ্ন করে। প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা করে!
লেখককে সাধুবাদ জানাই সমাজের নানা দিকগুলো গল্পের ক্যানভাসে তুলে ধরার জন্য। এগুলো পাঠককে কেবল ভাবাবে না বরং পাঠককে প্রশ্ন ধরে উত্তর খুঁজে বের করার অনুপ্রেরণাও দেবে! লেখক এক অর্থে সমাজের প্রতি দায়, মানুষ হিসেবে দায়, মানুষের প্রতি দায় থেকেই লিখেছেন। আচ্ছা আবারও জানতে চাই, লেখক কি নির্ভার হয়েছেন? হতে পেরেছেন?
‘দাসের বলি তাসের দেশে’ গল্পগ্রন্থের লেখক বিনয় দত্ত, বইটির প্রকাশক ‘পাঞ্জেরী’। প্রচ্ছদ করেছেন মানব। বইটির মুদ্রিত মূল্য ২০০ টাকা। বইটি পাঞ্জেরী, রকমারিসহ বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এবং দেশের বিভিন্ন বুকশপে পাওয়া যাচ্ছে।
