টানেল খননের চ্যালেঞ্জ ও অভিজ্ঞতার কথা জানালেন পিডি হারুনুর রশিদ
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল এটি। শনিবার (২৮ অক্টোবর) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে এসে টানেলটি উদ্বোধন করবেন। পরের দিন থেকে জনসাধারণের জন্য এটি খুলে দেওয়া হবে।
দেশের গর্বের এই স্থাপনা নির্মাণে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে ছিলেন প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ। তিনি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার সন্তান। গ্রামের ধুলো মাড়িয়ে তার বেড়ে ওঠা। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধেরবছরে তিনি পটিয়ার একটি বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে তিনি প্রথমে চট্টগ্রাম ওয়াসা এবং পরবর্তীতে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। এই অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রকৌশলীহিসেবে অবসর গ্রহণের পর তিনি প্রকল্প পরিচালক হিসেবে চুক্তিভিত্তিক কাজ করছেন।
টানেল নির্মাণে কী কী চ্যালেঞ্জ ছিল, সেগুলো কীভাবে ওভারকাম করা হয়েছে, পাশাপাশি বিশাল এই কর্মযজ্ঞের নানা অভিজ্ঞতা এবং এই প্রকৌশলীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা পোস্ট চট্টগ্রামের নিজস্ব প্রতিবেদক মিজানুর রহমান।
ঢাকা পোস্ট : দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেলনির্মাণযজ্ঞে কীভাবে যুক্ত হলেন?
প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ : ২০১৭ সালেরফেব্রুয়ারি মাস থেকে আমি টানেলের সঙ্গে যুক্ত। প্রথমে উপ-প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ছিলাম। ২০১৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। অর্থাৎ প্রকল্পের শারীরিক কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে আমি পরিচালক হিসেবে আছি। ২০১৫ সালে আমি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে অবসর গ্রহণ করি। চাকরিকালীন আমি বিভিন্ন ব্রিজ কালভার্ট, বিভিন্ন রাস্তা, বরিশালের দপদপিয়া ব্রিজ এবং কর্ণফুলীর শাহ আমানত সেতুর প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি।
ঢাকা পোস্ট : দেশের ইতিহাসে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এই প্রকল্পের নির্মাণকাজ শেষ। এখন শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষা। বিষয়টি কীভাবে উপভোগ করেছেন?
প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ : এই বয়সে বিশাল এই নির্মাণযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত থাকা আমার জন্য অত্যন্ত সৌভাগ্যের। আমি খুবই উপভোগ করেছি। কারণ, এটি আমাদের জন্য নতুন, বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ার সমাজের জন্য নতুন কাজ ছিল। প্রথমে আমি মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নিকট শোকরানা জ্ঞাপন করি। অবসরে যাওয়ার পরও দীর্ঘ সময় ধরে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কাজ করার তৌফিক দিয়েছেন তিনি। এরপর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট কৃতজ্ঞতা, তিনি আমাকে এখানে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন।
ঢাকা পোস্ট : সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একটি কাজ। টানেল খননের চ্যালেঞ্জগুলো কেমন ছিল?
প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ : টানেল খনন যেহেতু বাংলাদেশে প্রথম, আমরা এই প্রযুক্তি দেখে দেখে শিখেছি। সুতরাং এখানে কিছু চ্যালেঞ্জ ছিল। টানেল বোরিং মেশিনের ওজন ছিল দুই হাজার ২০০ টন। এটি দিয়ে টিউব খননের শুরুতে অর্থাৎ যখন পাঁচ শতাংশ কাজ শেষ হয়, তখন এর একটু ঊর্ধ্বগতি প্রবণতা দেখা দেয়। একই সঙ্গে টিউবের রিংগুলো প্রতিস্থাপনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। ওই সময় অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে আমরা সেটি ওভারকাম করতে পেরেছিলাম। এরপর ওই টিউবের কাজ যখন অর্ধেক শেষ হয় অর্থাৎ নদীর গভীরতম অংশে পৌঁছায় তখন টানেলের মেইন বোরিং মেশিনের শিল্ডে একটু ডিফর্মেশন (বিকলতা) পাই। এটি যখন একটু চেঞ্জ হয়ে যায় তখন আমাদের কাজকর্ম একটু ব্যাহত হয়। এরপর আমাদের এবং চীনের বিশেষজ্ঞ টিম সমস্যার সমাধান করে। এ ছাড়া, তেমন কোনো জটিলতা তৈরি হয়নি।
ঢাকা পোস্ট : টানেলের সুবিধা কারা বেশি পাবে বলে মনে করেন?
প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ : টানেল পুরো বাংলাদেশেরই অংশ। আমি মিরাকলই চট্টগ্রামের পটিয়ার সন্তান, যে এই প্রকল্পের পরিচালক নিযুক্ত হয়েছিল। দক্ষিণ চট্টগ্রাম তথা বাঁশখালী, সাতকানিয়া,লোহাগাড়া উপজেলা এবং বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার লোকজন বিমানবন্দরে আসার ক্ষেত্রে সুবিধা পাবেন। আগে তাদের অনেক দূর থেকে শাহ আমানত সেতু দিয়ে ঘুরে আসতে হতো। এখন তারা সোজা টানেল দিয়ে বিমানবন্দরে যেতে পারবেন। এ ছাড়া, ঢাকা থেকে কক্সবাজারে সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। এতে সময় বাঁচবে এবং বাইপাসও হওয়া যাবে। ফলে চট্টগ্রামের যানজট নিরসন হবে। মাতারবাড়িতে নির্মিত হওয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে। বন্দরের কার্যক্ষমতা অক্ষুণ্ন রেখে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ হিসেবে চট্টগ্রাম গড়ে উঠবে। চট্টগ্রামের দক্ষিণে শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে এবং সেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া, কক্সবাজারের পর্যটনশিল্প বিকশিত হবে।
আরও পড়ুন
ঢাকা পোস্ট : আপনার শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবন সম্পর্কে যদি বলতেন...
প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ : আমার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায়। আমি ১৯৭১ সালে পটিয়ার রাহাত আলী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করি। এরপর চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি, চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ১৯৭৯ সালে সিভিল বিভাগে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করি। বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর আমি প্রথমে চট্টগ্রাম ওয়াসায় সাড়ে তিন থেকে চার বছর পর্যন্ত প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করি। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরের অধীনে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কাজ শুরু করি। এরপর অধিদপ্তরের অধীনে বরিশাল, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ভোলা, কক্সবাজার ও বান্দরবানসহ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করি। সর্বশেষ ২০১৫ সালে আমি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে অবসর গ্রহণ করি।
টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে চার হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। বাকি পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে চীন সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ হারে ২০ বছর মেয়াদি এ ঋণ দিয়েছে। চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে
জানা গেছে, নির্মাণের আগে করা সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী টানেল চালুর পর এর ভেতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সে হিসাবে দিনে চলতে পারবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। যার অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী পরিবহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ এক লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নদীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল এটি। কর্ণফুলী নদীর দুই তীর সংযুক্ত করে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে টানেলটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। টানেল চালু হলে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজারের যোগাযোগ সহজ হবে। দক্ষিণ চট্টগ্রামে গড়ে উঠবে নতুন শিল্পকারখানা। টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে চার হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। বাকি পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে চীন সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ হারে ২০ বছর মেয়াদি এ ঋণ দিয়েছে। চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
এমআর/এমএআর/