এবার দেশজুড়ে নাফিসার খাদ্য উপহার
মহামারি করোনাভাইরাসের ভয়ে চারদিকে আতঙ্ক। মৃত্যু আর সংক্রমণ বেড়েই চলছে। সরকারের বেঁধে দেওয়া বিধিনিষেধে কর্মহীন দিনমজুরদের ঘরে জ্বলছে ক্ষুধার আগুন। সেই আগুন নেভাতে নিজেকে সঁপে দেন নাফিসা আনজুম খান।
সিএনজির মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবারের প্যাকেট নিয়ে গবির-অসহায়দের ঘরে ছুটে যান তিনি। খাবার না থাকা ঘরগুলো খাবার পেয়ে যেন অন্য এক আনন্দে প্রবেশ করে। এই আনন্দই নাফিসাকে আরও বেশি অনুপ্রাণিত করে। সেবা ও দায়িত্ব দুই বেড়ে যায় তার।
করোনা মহামারিতে সবাই যখন নিজেদের ঘরের মধ্যে গুটিয়ে নিতে ব্যস্ত, ঠিক তখন নাফিসা আনজুম খান নিজেকে বিপরীত অবস্থানে নিয়ে যান। বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দেওয়ার মহতী কাজে ব্যস্ত রাখেন নিজেকে। ১৩ হাজার পরিবারকে খাদ্য সহযোগিতা করে অনন্য উচ্চতায় গেছেন তিনি।
শুরুটা হয় গত বছর। মোহাম্মদপুরে নাফিসা আনজুম খানের বাসা থেকে খাবার সহযোগিতার মধ্য দিয়ে। এরপর নাফিসা নিজেই সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেন। বাড়তে থাকে সহযোগিতার পরিধি। বাড়ি থেকে মহল্লা। এরপর রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা।
এবার ঢাকার বাইরেও মিলবে নাফিসার সহযোগিতার হাতের ছোঁয়া। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের বেঁধে দেওয়া বিধিনিষেধে দেশজুড়ে নাফিসা মধ্য ও নিম্নবিত্তের ঘরে খাদ্য উপহার নিয়ে হাজির হবেন। আমজনতাসহ সব শ্রেণির সহযোগিতা পৌঁছে দিবেন খাবারের সন্ধানে থাকা মানুষদের কাছে।
নাফিসার এ মহতী উদ্যোগে শুরুতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তার পরিবার, পরিচিতজন, নিম্ন এবং মধ্যবিত্ত কাছের মানুষ। বর্তমানে তিনি অনেকের কাছ থেকেই সহযোগিতা নিয়ে গরিবদের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছেন। সবার কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়া অর্থ দিয়ে চাল, ডাল, তেল, আলু, স্যালাইন, প্রয়োজনীয় ওষুধসহ সময় উপযোগী খাদ্যসামগ্রী কিনে পৌঁছে দেন তিনি।
কোন অনুপ্রেরণা থেকে এমন উদ্যোগ নিলেন, এ প্রশ্নের উত্তরে নাফিসা ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনুপ্রেরণা হিসেবে আসলে কাজ করেছে আমার দেশ। ৫২-এর যুদ্ধ জয়। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়। এই করোনা মহামারির যুদ্ধকে জয় করতে পারব না, এটা কখনও মনেই হয় না। সব সময় আমি বিশ্বাস করি, সবাই মিলে কাজ করলে অবশ্যই জয় হবে। সুতরাং আমার দেশ আমার অনুপ্রেরণা।
এ বছরে কাজের পরিকল্পনা সম্পর্কে ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, এ বছরও একইভাবে কাজ করব। তবে গতবছরের চেয়ে কাজটা সাজিয়ে করব। এবার অভিজ্ঞতার আলোকে কাজগুলো যেন আরও ভালো করে সম্পাদন করা যায় সেই চেষ্টা করব। এবার মধ্যবিত্তদের বেশ প্রাধান্য দেবো। তাদের নিশ্চুপে খাবার পৌঁছে দেবো। এবার দরজার সামনে খাবার পৌঁছে দেওয়ার পর তাকে জানাব। এছাড়া গত বছরের তুলনায় এবার আরও বড় পরিসরে কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে।
অর্থের যোগান কীভাবে হচ্ছে জানতে চাইলে নাফিসা বলেন, ফান্ডিংটা আসলে আমজনতার। আমার সঙ্গে যে যেভাবে চায় সেভাবে যুক্ত হতে পারে। যে কেউ ২০ টাকা ডোনেট করেও যুক্ত হতে পারে। আমার কাছে আসলে অ্যামাউন্টটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেউ চাইলে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করতে পারেন। কেউ হয়তোবা তার বাসার বাড়তি খাবার দিয়ে সহযোগিতা করতে পারেন। ধরুন, বাসায় ৫ কেজি আলু কিনেছি, এখান থেকে দুই কেজি দিতে চাই।
এ পরিস্থিতিতে মধ্যবিত্তের পরিবারের অনেকের চাকরি চলে যায়, অনেকেই কিছু চাইতে পারেন না আবার বলতেও পারেন না। বিষয়টি কেমনভাবে দেখছেন- জানতে চাইলে নাফিসা বলেন, মধ্যবিত্ত তো আমরাও। আসলে চাকরি যদি চলে যায় তাহলে আমি হুট করেই অপরিচিত কারও কাছ থেকে সহযোগিতা চাইতে পারব না। এজন্যে আমি ব্যানারটা পরিবর্তন করেছি।
নাফিসা বলেন, গত বছর ব্যানারে লেখা ছিল যে, বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণ। এবার লেখা হয়েছে খাদ্য উপহার। সুতরাং উপহার এমন একটা জিনিস- যে কেউ নিতে পারেন এবং দিতে পারেন। আমি ঢাকা পোস্টের মাধ্যমে সবাইকে বলব যে, এ সময়টা একটা ক্রাইসিসের সময়। এ সময়ে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। উপহারটা আপনার জন্যেই। উপহার নেওয়ার জন্যে আমাকে যেকোনো সময় জানাবেন। আমি কথা দিচ্ছি আপনার সম্মতিতে এবং আপনার নাম পরিচয় গোপন রেখেই এটা আপনার কাছে পৌঁছে দেবো।
কাজের পরিকল্পনার বিষয়ে নাফিসা বলেন, বিধিনিষেধ খুব কড়াকড়ি হবে শুনলাম। আসলে আমার ব্যানারটা অনেক সম্মান পেয়েছে। ১৪ এপ্রিল থেকে আমি আমার এই ব্যানার ও সিএনজি নিয়ে মুভ করব। পরিকল্পনা হচ্ছে আমাকে যারা এসএমএস ও ফোন কল করে জানাচ্ছেন সহযোগিতার কথা, তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করা। যাচাই-বাছাই করে একদম সঠিক জায়গায় সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব।
আলাপকালে নাফিসা বলেন, লকডাউনে চলাফেরায় কোনো প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়নি। আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা আমার এ ব্যানার দেখে বরং সহযোগিতা করেছেন। সবমিলিয়ে মানুষের ভালোবাসা আমাকে আরও বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
সোমবার (১২ এপ্রিল) মানিকগঞ্জ থেকে কাজ শুরু করেছেন জানিয়ে নাফিসা বলেন, রোজার কিছু খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিলাম। সারাদেশে ১৪ এপ্রিল থেকে আমাদের খাদ্য উপহার দেওয়া শুরু হবে। গতবছর শুধু ঢাকা কেন্দ্রিক ছিল। এ বছর ঢাকার বাইরে আমার প্রতিনিধি আছে। তারা আমাকে সঠিক তথ্য দিলে সেই তথ্য আমি আমার মাধ্যমে যাচাইবাছাই করে খাবার পৌঁছে দেবো। কোথাও যদি আমার একদমই যাওয়ার প্রয়োজন হয় সেখানে যাব।
নাফিসা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আমার মুঠোফোনের নম্বরটি (01711085064) দেওয়া আছে। এছাড়া আমি যে সিএনজিতে বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছি, সেখানেও নম্বরটি বড় করে লেখা আছে।
কাজ করতে গিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জও নিতে হয়। এ বিষয়ে নাফিসা জানান, অনেকেই অসৎ আচরণ করেন। সাহায্য বেশি পাওয়ার লোভে একই পরিবার থেকে একাধিক জন ফোন বা এসএমএস করেন। এগুলো আসলে আমরা যাচাইবাছাই করেই দেই।
তরুণদের উদ্দেশ্যে নাফিসা বলেন, আসলে যারা এ কাজের সঙ্গে যুক্ত হতে চান বা হয়েছেন তাদের সবাইকে অনেক অনেক শুভ কামনা। এটি একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। একে জয় করতে হলে আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। কাউকে খাদ্য দিয়ে সহযোগিতার করার মতো মহৎ কাজ আর হয় না। তাই যে যার জায়গা থেকে এগিয়ে আসা উচিত।
একে/এইচকে