এমপি প্রাণ গোপালের নামে বিজ্ঞাপন : ভেজাল ওষুধ বেচে মাসে আয় ৩৮ লাখ

কুমিল্লা-৭ আসনের সংসদ সদস্য, নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্তের নাম ব্যবহার করে সামাজিক মাধ্যমে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে যৌন উত্তেজক, ডায়াবেটিসসহ নানা ভুয়া ওষুধ বিক্রির প্রচারণা করা হচ্ছে। ফেক আইডি খুলে আগ্রহী ক্রেতাদের সঙ্গেও করা হচ্ছিল যোগাযোগ। ব্যবহার করা হচ্ছিল মোবাইল নাম্বার। বিজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে— ঘুমাতে যাওয়ার আগে ভেষজ পানি পান করুন। রক্তে শর্করার মাত্রা কমাবে। আর সরল-বিশ্বাসে ওষুধ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
বিষয়টি নজরে আসার পর ঢাকার কলাবাগান থানায় মামলা দায়ের করেন ডা. প্রাণ গোপাল দত্তের চেম্বার সহকারী। সেই মামলায় তদন্ত করতে গিয়ে একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সন্ধান পায় ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ। এরপর যশোর জেলা ও রাজধানীর মিরপুর থানা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে চক্রের ছয় সদস্য গ্রেপ্তার করা হয়। জব্দ করা ভেজাল ওষুধ ও ফুড সাপ্লিমেন্ট।
গ্রেপ্তাররা হলেন- মো. জহুরুল ইসলাম (৪১), সাবিদ চৌধুরী (৩৩), হাসিব চৌধুরী (২৭), মোহাম্মদ আলী (৪১), রাফিদ ইসলাম নুহিন (১৯) ও জাকির নাসের (২২)।
ডিবি সাইবার সূত্রে জানা যায়, নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্তের চেম্বার সহকারী বদরুল ইসলাম (৩৩) গত ১১ ফেব্রুয়ারি বাদী হয়ে কলাবাগান থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় তিনি উল্লেখ করেন— অজ্ঞাত আসামিরা ডা. প্রাণ গোপাল দত্তের নাম ও ছবি ব্যবহার করে বিভিন্ন ফেসবুক আইডি ও পেইজ থেকে বিজ্ঞাপন ও প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন, যা তিনি জানেন না।
আরও পড়ুন
সেই বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়— ৬ দিন পরে, রক্তে শর্করার মাত্রা হবে ৪.২ মি.মি./ লি. ঘুমাতে যাওয়ার আগে শুধু একটি পানীয় পান করুন...।
এছাড়া বিভিন্ন পরামর্শ সম্বলিত পোস্ট ও কমেন্ট করে একটি অননুমোদিত ডায়াবেটিসের ওষুধ প্রাণ গোপাল দত্তের উদ্ভাবিত বলে বিক্রয় করে আসছিল। এসব ওষুধ বিক্রয়ে যোগাযোগের জন্য আলাদা মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হচ্ছিল। এসব ব্যাপারে ডা. প্রাণ গোপাল কিছুই জানেন না।
ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বলছে, দীর্ঘ দিন ধরে প্রতারণামূলক এই ব্যবসায় জড়িত সবাই উচ্চশিক্ষিত। কেউ অনার্স, মাস্টার্স, এমবিএ ও এমএসসি পাশ করা। যাদের মাসিক ইনকাম ৩৮ লাখ টাকা।
প্রাণ গোপাল দত্তের নামে ফেইসবুক আইডি
চক্রের সদস্যরা সরকারি অনুমোদন ব্যতীত সাধারণ ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো যৌন উত্তেজনা বর্ধক বিভিন্ন কেমিক্যাল মিশিয়ে শক্তিবর্ধক ওষুধ তৈরিসহ নিজেদের ইচ্ছামতো বিভিন্ন ফরমুলা তৈরি করে ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধ প্রস্তুত করে এবং বাজারজাত করে আসছিল।
তারা বিভিন্ন নামে একাধিক ফেসবুক আইডি খুলে বিজ্ঞাপন বুস্টিংয়ের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এমনকি তারা প্রাণ গোপাল দত্তের নামে ফেইক ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে বিজ্ঞাপনে কমেন্টকারীদের প্রশ্নের উত্তর প্রদান করে থাকে। "নিখাদ" নামে তারা একটি ব্র্যান্ডের নামকরণ করেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে তাদের উৎপাদিত সব পণ্য কুরিয়ারের মাধ্যমে বিক্রি করে আসছিল।

মঙ্গলবার ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ গ্রেপ্তার ছয়জন সম্পর্কে বলেন, প্রতারণামূলক ব্যবসায় স্বনামধন্য চিকিৎসক ডাক্তার প্রাণ গোপাল দত্তের নাম ব্যবহারের উদ্দেশ্য ছিল মানুষজনের বিশ্বাস অর্জন। এই বিশ্বাসকে তারা প্রতারণামূলক ব্যবসার পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের মাসে বিক্রি ৩৮ লাখ টাকা। যে কয়দিন ব্যবসা করেছেন তাতে ইনকাম হয়েছে কোটি কোটি টাকা। আর তাদের এই প্রতারণামূলক ব্যবসার প্রসার-প্রচারের জন্য ডা. প্রাণ গোপাল দত্তের ছবি ও নানা বিবৃতির পোস্ট তৈরি করে ফেসবুকে বুস্টিং করতেন।
হারুন জানান, প্রাণ গোপাল দত্তের দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার ছয়জনকে আদালতে পাঠানোর পরে রিমান্ডে এনেছি। জিজ্ঞাসাবাদে তারা সবকিছু স্বীকার করেছেন। আমরা প্রায় একটা কথা বলি ফেসবুকে চটকদার বিজ্ঞাপন দেখলেই এ ধরনের ওষুধ কিনবেন না। তারপরও অনেকেই এসব চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে ভেজাল যৌন উত্তেজক ও ডায়াবেটিকের ওষুধ কিনছেন। অনুমোদিত ওষুধের গায়ে তো বিএসটিআই ও ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর কর্তৃক অনুমোদনের লেখা বা লোগো থাকার কথা। তবে আমরা এসব পাইনি।
ডিবিপ্রধান পরামর্শ দিয়ে বলেন, চটকদার বিজ্ঞাপন নয়, অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ কেনা উচিত। বিজ্ঞাপন দেখলে বা প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়লে আমাদেরকে জানান। তাহলে গোয়েন্দা পুলিশ এ ব্যাপারে কাজ করবে। আর ওষুধ কিনতে অবশ্যই বিএসটিআই বা ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদিত কি না তা দেখে নিন।
এক প্রশ্নের জবাবে ডিবিপ্রধান বলেন, চক্রটি অনেকদিন ধরে ব্যবসা করছিল। প্রত্যেকেই যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি, কিন্তু তারা কেন এই ধরনের প্রতারণামূলক ব্যবসা করে আসছেন তার সদুত্তর পাওয়া যায়নি। তবে তারা কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
জেইউ/এমজে