সচিব নিয়োগের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকবে : সংস্কার কমিশন

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সচিব নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের পরিবর্তে ইসির কাছে রাখতে প্রস্তাব দিয়েছে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। সেইসঙ্গে জনবল নিয়োগের জন্য আলাদা নির্বাচন সার্ভিস গঠনেরও সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
বুধবার (১৫ জানুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টার কাছে এই কমিশন পুরো নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের নয় পৃষ্ঠার সুপারিশ জমা দেয়।
এতে বলা হয়, নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে একটি আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনটির উদ্দেশ্য হলো ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে এবং নাগরিক সমাজের অর্থবহ অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে যোগ্য ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারদের নিয়োগ প্রদান এবং কমিশনারদের দায়িত্ব, স্বার্থের দ্বন্দ্ব, ক্ষমতা ও দায়বদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করা। বিকল্প: একটি স্থায়ী জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনসহ সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়োগ প্রদান করা যেতে পারে, যার জন্য অবশ্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা
(ক) নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল এবং পুনর্নির্বাচনের ক্ষমতা প্রদান করা।
(খ) নির্বাচন কমিশনের সচিব নিয়োগের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা।
(গ) নির্বাচনকালীন নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে নির্বাহী বিভাগের পক্ষ থেকে এমন কার্যক্রম গ্রহণের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের অনুমতি
নেওয়ার বিধান করা।
(ঘ) ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের মতো বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যা বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত, ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে, লিখিতভাবে যুক্তিসংগত কারণ প্রদর্শনপূর্বক, সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে, ৯০ দিনের জন্য নির্বাচন স্থগিত করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে প্রদানের জন্য রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের কাছে মতামত চাওয়ার বিধান করা।
আরও পড়ুন
নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব
(ক) জাতীয় নির্বাচনের পর নির্বাচন কমিশন গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে, ফলাফল গেজেটে প্রকাশের পূর্বে, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে ঘোষণা প্রদানের বিধান করা।
(খ) নির্বাচনের সুষ্ঠুতা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কিত নির্বাচন কমিশনের ঘোষণায় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী কোনো রাজনৈতিক দল সংক্ষুব্ধ হলে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে অভিযোগ করার সুযোগ সৃষ্টির বিধান করা। কমিশন/আদালত কর্তৃক সর্বোচ্চ ৭ কার্যদিবসের মধ্যে ওই অভিযোগ নিষ্পত্তি করার বিধান করা।
(গ) স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠানের পুরো দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের কাছে ন্যস্ত করা।
(ঘ) ভোটার শিক্ষা ও সচেতনতা এবং গবেষণা কার্যক্রমকে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা। এসব কার্যক্রমে শিক্ষার্থী ও বেসরকারি সংস্থার সহায়তা গ্রহণ করা।
(ঙ) নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ‘ভোটার-প্রার্থী মুখোমুখি’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা।
(চ) কমিশন কর্তৃক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের নির্বাচনী ও পোলিং এজেন্টদের সুরক্ষা প্রদানের বিধান করা।
(ছ) আউয়াল কমিশন ২০২৩ সালে যেসব বিতর্কিত রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন প্রদান করেছে, যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে সেগুলোর নিবন্ধন
বাতিল করা।
নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতা ও শান্তি
(ক) নির্বাচন কমিশনের আইনি, আর্থিক ও প্রশাসনিক প্রস্তাব কোনো মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষের (যদি না হয়, তাহলে বিদ্যমান সংসদের অনুরূপ) সংসদীয় কমিটির কাছে উপস্থাপনের বিধান করা।
(খ) নির্বাচন কমিশনের মেয়াদকালে কমিশনারদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের অভিযোগ উঠলে তা সংবিধানের ১১৮ ও ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে সুরাহা করার বিদ্যমান বিধান কার্যকর করা।
(গ) সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে এবং শপথ ভঙ্গ করলে কমিশনারদের মেয়াদ পরবর্তী সময়ে উত্থাপিত অভিযোগ প্রস্তাবিত সংসদীয় কমিটি তদন্ত করে সুপারিশসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর বিধান করা।
(ঘ) আরপিও’র ৯০(ক) ধারা সংশোধনপূর্বক নির্বাচনী অপরাধের মামলা দায়েরের সময়সীমা রহিত করা।
রিটার্নিং কর্মকর্তা/সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ
নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা। এ দায়িত্ব পালনের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক কমিশনের কর্মকর্তা পাওয়া না গেলে প্রশাসনসহ অন্য ক্যাডার থেকে নিয়োগ করা।
নির্বাচন কমিশনের ব্যয়
প্রশিক্ষণ ভাতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ম্যাজিস্ট্রেটদের ভাতার যথার্থতা ও পরিমাণ পর্যালোচনাপূর্বক পুনর্নির্ধারণ ও বাতিল করা। (উল্লেখ্য, নির্বাচন কমিশন তথা সরকারের নির্বাচন সংক্রান্ত ব্যয় ১৯৭৩ সালে ছিল প্রায় ৩ কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালে এসে দাঁড়িয়েছে মোট ১ হাজার ৯২৭ কোটি টাকা।)
নির্বাচন কমিশনের কার্যপদ্ধতি
(ক) একটি যৌথ সত্তা হিসেবে দৈনন্দিন রুটিন কার্যক্রম ব্যতীত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলিসহ নির্বাচন কমিশনের সব সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতভাবে বা সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কমিশনের সভায় গৃহীত হওয়ার বিধান করা।
(খ) নির্বাচন-সংক্রান্ত সব কার্যক্রম কমিশনের যৌথ সিদ্ধান্তে পরিচালিত করার বিধান করা।
কমিশনের এই সুপারিশগুলো দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেবে অন্তর্বর্তী সরকার।
এসআর/এসএম