কূটনীতিক হিসেবে কেমন ছিলেন সুফিউর রহমান?

সম্প্রতি প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর দায়িত্ব পেয়েছেন মোহাম্মদ সুফিউর রহমান। তবে বিগত সরকারের (আওয়ামী লীগ) সঙ্গে সম্পর্ক জড়িয়ে দিয়ে সুফিউর রহমান যেন তার দায়িত্ব শুরু না করতে পারেন, সেই প্রচেষ্টা চলছে।
অথচ চার দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা সুফিউর রহমানকে নিয়ে ভিন্ন বার্তা দিচ্ছেন স্থানীয় কূটনীতিকরা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, অবসরে যাওয়া এই কূটনীতিক বিদেশের মাটিতে শুরুতে দিল্লি এবং জেনেভায় কাজ করার পর ২০০২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তৎকালীন বিএনপি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খানের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পেশাগত উৎকর্ষের জন্য পরবর্তী সময়ে তাকে নেপালে সার্ক সচিবালয়ে পদায়ন করা হয়। এরপর বিগত আওয়ামী লীগের শাসনামলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কয়েকবার তাকে বিএনপি-জামায়াতের মিথ্যা অভিযোগে কালো-তালিকাভুক্ত করা হয়।
সার্ক সচিবালয়ে পরিচালক পদে থাকাকালীন সময়ে ভারত-পাকিস্তান প্রতিদ্বন্দ্বিতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে তিনি সার্ক উন্নয়ন তহবিল গঠনের উদ্যোগে সাফল্যের অবদান রাখেন। সার্ক কৃষি কেন্দ্র, সার্ক ফুড ব্যাংক, সার্ক আঞ্চলিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি গঠনে সহায়ক ভূমিকা রয়েছে।
রাষ্ট্রদূত রহমান ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সার্ক (মাঝে মাঝে দক্ষিণ এশিয়া) ও বহুপাক্ষিক অর্থনীতি বিষয়ক মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। সুফিউর রহমান সার্ক উইংয়ের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সরকার সার্কের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে অন্য সব সদস্য রাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করে দক্ষিণ এশীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল। তখন তিনি এ প্রচেষ্টাকে রুখে দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন।
আরও পড়ুন
বহুপাক্ষিক অর্থনীতি বিষয়ক মহাপরিচালক হিসেবে তিনি বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিট বিষয়ে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা আদায় ও ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তিতে দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তবে তিনি সফল হতে পারেননি। কেননা, বিগত সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীসহ অন্যদের প্রভাবে তার বাধা টেকেনি।
২০১২ সালে শ্রীলঙ্কায় হাইকমিশনার করা হয় সুফিউর রহমানকে। তার উদ্যোগে বাংলাদেশ থেকে ওষুধ আমদানির জন্য শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু বেক্সিমকোর মতো ফ্যাসিস্ট সরকারের মদদপুষ্ট কিছু ওষুধ কোম্পানির কারণে বাংলাদেশ এই সুবর্ণ সুযোগকে ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারেনি। শুধু তাই নয়, তাদের অনাগ্রহে রাষ্ট্রদূত রহমানের বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার মধ্যকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি আর আলোর মুখ দেখেনি, যা বাংলাদেশের জন্য প্রথম মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হতে পারত।
বিগত সরকার ২০১৪ সালে সুফিউর রহমানকে শ্রীলঙ্কা থেকে মিয়ানমারে রাষ্ট্রদূত করে পাঠায়। ওই সময় মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের অবৈধ বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে প্রচারণায় ব্যস্ত ছিল। রাষ্ট্রদূত রহমান রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের অধিবাসী হিসেবে প্রমাণ করে একটি গবেষণাপত্র প্রস্তুত ও প্রচার করেন। ফলে মিয়ানমারের সে প্রচেষ্টা ভণ্ডুল হয়।
আগস্ট ২০১৭ সহিংসতার সময় জীবন বাঁচাতে রাষ্ট্রদূত রহমান রাখাইনের অভ্যন্তরে নিরাপদ অঞ্চল তৈরির চেষ্টা করেন। তিনি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন, তাদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিতকরণে দ্বি-পক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী মিয়ানমারের এক মন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় একান্ত পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্বার্থ বিরোধী একটি অনুচ্ছেদ চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত করতে রাজী হন। তবে রাষ্ট্রদূতের আপত্তির কারণে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সেদিন সে অনুচ্ছেদ বাদ দিতে হয়েছিল।
২০১৮ থেকে ২০২২ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ফিজি এবং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের হাই কমিশনার ছিলেন সুফিউর রহমান। তিনি বাংলাদেশ এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ফলে চার বছরে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২.৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। তিনি বাংলাদেশকে অস্ট্রেলিয়ার ‘গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার দেশ’ করে তুলে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ভিত্তি স্থাপন করেন।
অস্ট্রেলিয়ায় দায়িত্ব পালনের সময় সুফিউর রহমান বিগত সরকারের অনেক মন্ত্রীর তদবির ও ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে অস্ট্রেলিয়াতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে আওয়ামী লীগের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত দুর্নীতিবাজ একজন ফার্স্ট সেক্রেটারিকে, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী মন্ত্রীর বাধার পরেও হাইকমিশন থেকে বের করে দেন। তিনি দলীয় রাজনীতিকে দূরে ঠেলে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনকে কমিউনিটির সবার জন্য উন্মুক্ত রাখেন।
তিনি সর্বশেষ ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং জেনেভার জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জেনেভায় কর্মকালে তিনি জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আইএলওর মামলা সমাধান করে ইইউর বাজারে বাংলাদেশকে জিএসপি রক্ষা, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় এলডিসি পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ ও কোভিড-পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যে উন্নয়নশীল দেশের স্বার্থ সুরক্ষিত করাকে অগ্রাধিকার প্রদান করে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকেন।
বিগত সরকারের তৈরি মানবাধিকার বিষয়ক প্রচারণায় অত্যধিক গুরুত্ব প্রদান না করার কারণে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন ২০২৩ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার ‘ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ’-এর সময় তাকে জোর করে ছুটিতে পাঠানোর মতো চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন।
২০২৪ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে অবসরে যাওয়া সব সচিব এবং রাষ্ট্রদূতদের মেয়াদ যখন ছয় মাস বাড়ানো হয়, তখন দৈবক্রমে রাষ্ট্রদূত রহমানকেও জেনেভায় কাজ চালিয়ে যেতে হয়। ২০২৪ সালে বিতর্কিত নির্বাচনের পরে প্রথম কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে বিগত সরকার রাষ্ট্রদূত রহমানকে ঢাকায় ফেরানোর আদেশ জারি করে। ২০২৪ সালের ৩১ মে রাষ্ট্রদূত রহমান চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
এনআই/এসএম