বিআইডব্লিউটিএ-র ১১ হাউজবোট ক্রয়ের মূল্যায়ন কমিটি গঠনে অনিয়ম

* ১১ ক্রু হাউজবোট ক্রয়ে মানা হচ্ছে না পিপিআর
* অনিয়মের ব্যাখ্যা চেয়ে বিআইডব্লিউটিএ-কে মন্ত্রণালয়ের চিঠি
* ভুল স্বীকার কর ব্যাখ্যা দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ
* তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন একটি প্রকল্পের অধীনে ১১টি ক্রু হাউজবোট কেনার জন্য ২০২৪ সালের ৬ জুন দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর বিপরীতে ৪টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। গত বছরের ১৫ জুলাই তাদের মধ্যে একটিকে কাজ দেওয়ার সুপারিশ করে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি। অভিযোগ উঠেছে, এই দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত বিধিমালা মানা হয়নি।
ঢাকা পোস্টের হাতে আসা নথিপত্রে দেখা গেছে, দরপত্র প্রক্রিয়ায় পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর ২০০৮) লঙ্ঘন করা হয়েছে। বিধি অনুযায়ী– দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে হোপ (হেড অব প্রকিউরিং এনটিটি) বা ক্রয়কারী সংস্থার প্রধানের অব্যবহিত নিম্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তার দায়িত্ব পাওয়ার কথা। কিন্তু আইন না মেনে কয়েক ধাপ নিচের কর্মকর্তা প্রকল্প পরিচালককে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে মূল্যায়ন কমিটি গঠনের পূর্বে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা নেওয়া হয়নি।
পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর ২০০৮) এর বিধি ৩-এ বলা হয়েছে, ‘দরপত্র অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ মূল্যায়ন কমিটি গঠন করবে। তবে পরিচালনা পর্ষদ বা মন্ত্রণালয় যদি অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ হয় বা সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি সুপারিশকারী কর্তৃপক্ষ হয়, তাহলে পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি বা মন্ত্রণালয় অথবা বিভাগের সচিবের অনুমোদনক্রমে মূল্যায়ন কমিটি নিয়োগ করতে হবে।’
বিধি অনুযায়ী— নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের অনুমোদনক্রমে মূল্যায়ন কমিটি গঠন করার কথা থাকলেও মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। ফলে এখানে স্পষ্ট আইনের লঙ্ঘন করা হয়েছে।
অপরদিকে পিপিআর ২০০৮-এর বিধি ১০ এর ক, ঘ এবং ঙ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ যেহেতু মন্ত্রণালয়, সেহেতু মূল্যায়ন কমিটিতে সভাপতিত্ব করবেন অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের অব্যবহিত নিম্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তা। পিপিআর-এর এই বিধি অনুযায়ী— মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি হওয়ার কথা কোনো অতিরিক্ত সচিবের। তারা অসমর্থ হলে এ দায়িত্ব পাওয়ার কথা বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যানের। তিনি কোনো কারণে অসমর্থ হলে সভাপতিত্ব করার কথা বিআইডব্লিউটিএ'র কোনো সদস্যের। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ধাপে ধাপে নিম্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের সভাপতিত্বের কথা থাকলেও এ বিধিও অমান্য করে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কয়েক ধাপ নিচের কর্মকর্তা প্রকল্প পরিচালককে।
আরও পড়ুন
এ অনিয়ম নিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে গত ২২ মে বিআইডব্লিউটিএর ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। মূল্যায়ন কমিটি গঠনে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাওয়ার পাশাপাশি যদি অনুমোদন নেওয়া হয় তাহলে ই-জিপি সিস্টেমের ওয়ার্ক ফ্লো চার্ট দাখিল করতে বলা হয়। এ ছাড়া, অনুমোদনকারীর অব্যবহিত নিম্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তার পরিবর্তে প্রকল্প পরিচালককে মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক কেন করা হয় তার ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়।
দায়িত্বশীল সূত্র থেকে জানা গেছে, গত ২৮ মে মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠির ব্যাখ্যা দেয় বিআইডব্লিউটিএ। সংস্থাটির চেয়ারম্যান স্বাক্ষরিত ওই ব্যাখ্যায় দরপত্র প্রক্রিয়ার এই অনিয়মকে ‘ভুল’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ব্যাখ্যায় তারা বলেছে, দরপত্রটি ই-জিপি সিস্টেমে আহ্বান করা হলে বিধি অনুযায়ী অনলাইনে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়। মূল্যায়ন কমিটিতে হোপ-এর অব্যবহিত নিম্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তা হিসেবে প্রকল্প পরিচালককে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়। ই-জিপি সিস্টেমে দরপত্র আহ্বান করাকালীন মূল্যায়ন কমিটি গঠনের সময় ই-জিপিতে ওয়ার্ক ফ্লো তৈরিতে ভুলক্রমে হোপ-কে অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে রাখা হয়। ফলে তা হোপ কর্তৃক অনুমোদিত হয় এবং প্রকল্প পরিচালককে দরপত্রের মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক করা হয়। বর্তমানে ই-জিপি সিস্টেমে মূল্যায়ন কমিটি গঠন ও অনুমোদনের বিষয়টি সিস্টেম কর্তৃক স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ধারিত হয়। ভবিষ্যতে এ জাতীয় ভুল হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিআইডব্লিউটিএর এই জবাব যেন অন্ধের হাতি দর্শনের মতো। তারা নিয়মকানুন জেনেও অনিয়ম করেছেন।
এ বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, এ ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে। এরপর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগামী তিন থেকে চারদিনের মধ্যে তারা তদন্ত প্রতিবেদন দেবে। এটা যদি ইনটেনশনাল ভুল হয় তাহলে মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা আছে, মন্ত্রণালয় সেটা দেখবে।
এ বিষয়ে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের সাবেক সভাপতি এবং সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, পিপিআর এর বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলো, বাংলাদেশে সবই হয়। নিয়ম না মেনে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম সুপারিশ করা সরাসরি অনিয়ম। যেহেতু এই বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ বলেছে তারা ভুল করেছে, সেহেতু এটা রি-টেন্ডারে যাবে। আর কোনো পথ নেই। যারাই ভুল করেছে তাদের পানিশমেন্ট হওয়া উচিত। দায়িত্বশীল জায়গা থেকে এ ধরনের ভুল করার কোনো সুযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে এখন দুর্নীতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেছে। এটি তারই একটি প্রতিচ্ছবি। পুরো বিষয়টিই একটি দুর্নীতির পাঁকে পড়ে গেছে।
প্রসঙ্গত, ১১টি ক্রু হাউজ বোট কেনার জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে চারটি প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে খুলনা শিপইয়ার্ড ৫০ কোটি ৪৪ লাখ ২৭ হাজার ১১০ টাকায় দরপত্র জমা দেয়। ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড ৩৮ কোটি ২৩ লাখ ৭১ হাজার ৩৩ টাকায় দরপত্র জমা দেয়। থ্রি অ্যাঙ্গেল মেরিন নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান ৩২ কোটি ৩৩ লাখ ৮৯ হাজার টাকায় দরপত্র জমা দেয়। এ ছাড়া আনন্দ শিপইয়ার্ড নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান ৩৭ কোটি ২২ লাখ ২৬ হাজার টাকায় দরপত্র জমা দেয়।
গত বছরের ১৫ জুলাই দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে থ্রি অ্যাঙ্গেল মেরিনের নাম সুপারিশ করে। এরপর নিয়ম অনুযায়ী এ সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে ধরা পড়ে মূল্যায়ন কমিটি গঠনে অনিয়মের বিষয়টি। ফলে আটকে যায় এ টেন্ডার প্রক্রিয়া।
এমএম/এমজে
