হলি আর্টিজান হামলার ৯ বছর, ভয়-ঝুঁকি কতটা কমলো?

ঢাকার অভিজাত এলাকা গুলশান। বিদেশি কূটনীতিকদের নিয়মিত বিচরণ থাকে এই এলাকায়। ২০১৬ সালের ১ জুলাই সন্ধ্যার পর এই এলাকার রেস্তরাঁ হলি আর্টিজানে ঘটে নারকীয় এক জঙ্গি হামলা। জঙ্গিরা জিম্মি করে দেশ-বিদেশি বহু লোককে। প্রায় ১২ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস জিম্মি সংকটের অবসান ঘটে সেনাবাহিনীর কমান্ডো অভিযান ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’। জঙ্গিদের হামলায় ১৭ জন বিদেশিসহ মোট ২২ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে দুজন ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। নিহত হয় হামলাকারী পাঁচ জঙ্গিও।
ভয়াবহ এ জঙ্গি হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে বেরিয়ে আসতে থাকে জঙ্গিদের নানা পরিকল্পনার তথ্য। নৃশংস এ হামলার সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের যোগসাজশের বিষয়টিও আলোচনায় আসে।
রক্তাক্ত সেই জঙ্গি হামলার ৯ বছর আজ (১ জুলাই)। হলি আর্টিজানের মতো জায়গায় নারকীয় এ হামলা স্মরণ করিয়ে দেয়, কোনো স্থানকে যত নিরাপদই মনে করা হোক না কেন নজরদারি ছাড়া ঝুঁকি রয়েই যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ নিয়ে আর 'ঝুঁকি নেই' বা 'নিয়ন্ত্রণে আছে'- এমন কথা বলে বলে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। এখন হয়তো ভয় কমেছে, জঙ্গি হামলা নেই। কিন্তু উগ্রবাদী কার্যক্রম থেমে নেই। তাই ঝুঁকি থাকবেই এবং জন্য সর্বত্র নজরদারি বাড়ানোর বিকল্প নেই।

হলি আর্টিজান হামলার পর তৎকালীন সরকারের জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রম প্রশ্নের মুখে পড়ে। সরকারের ভাবমূর্তি ফেরাতে জঙ্গিবাদ বিরোধী জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করা হয়। এক হাজারের বেশি অভিযান পরিচালনা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নিহত হয় জড়িত আরও ৮ জন, যাদেরকে হলি আর্টিজান হামলায় জড়িত ও শীর্ষস্থানীয় জঙ্গি সদস্য হিসেবে জানিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারা হলেন- তামিম আহমেদ চৌধুরী (৩৩), নুরুল ইসলাম মারজান (২৩), সারোয়ার জাহান মানিক (৩৫), তানভীর কাদেরী (৪০), বাশারুজ্জামান চকলেট (৩২), মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম (৩৭), মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান (৩২) এবং রায়হানুল কবির রায়হান ওরফে তারেক (২০)।
চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনার পর গুলশান থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করে পুলিশ। মামলার তদন্ত শেষে আট আসামির বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর অভিযোগ গঠন করা হয়। টানা এক বছর মামলার বিচার শেষে ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর রায় ঘোষণা করা হয়। ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমানের আদালত রায়ে ৭ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে খালাস দেন।
আরও পড়ুন
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- হামলার মূল সমন্বয়ক তামিম চৌধুরীর সহযোগী আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে আবু জাররা ওরফে র্যাশ, অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী নব্য জেএমবি নেতা হাদিসুর রহমান সাগর, জঙ্গি রাকিবুল হাসান রিগ্যান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব ওরফে রাজীব গান্ধী, হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আব্দুস সবুর খান (হাসান) ওরফে সোহেল মাহফুজ, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ।
এদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এ মামলার অপর আসামি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে খালাস দেওয়া হয়।
২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স ও খালাস চেয়ে করা আসামিদের জেল আপিল শুনানির জন্য মামলার নথিপত্র বিচারিক আদালত থেকে হাইকোর্টে আসে। বিচারিক আদালতের এসব নথির মধ্যে মামলার এজাহার, জব্দ তালিকা, চার্জশিট, সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও রায়সহ মোট ২ হাজার ৩০৭ পৃষ্ঠার নথিপত্র হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় জমা করা হয়। এরপর পেপারবুক তৈরি শেষে মামলাটি শুনানিতে ওঠে।

২০২৩ সালের শুরুর দিকে হাইকোর্টে মামলাটির ডেথ রেফারেন্স, আপিল ও জেল আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়। যা শেষ হয় একই বছরের ১১ অক্টোবর। পরে ৩০ অক্টোবর রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। রায়ে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে সাত জঙ্গিকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেন হাইকোর্ট।
দণ্ডিতরা হলো- জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, হাদিসুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, আব্দুস সবুর খান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশিদ রিপন।
বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের সাজা কমানোর বিষয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়েছে, এটা স্বীকৃত যে ঘটনার তারিখ ও সময়ে ঘটনাস্থলে ঘটনাটি ঘটানোর উদ্দেশ্যে আপিলকারীদের কেউ উপস্থিত ছিল না কিংবা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে ঘটনাটি ঘটানোর জন্য কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করেনি। ফলে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(১)(ক)(অ) ধারার অভিযোগ এই আসামিদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তাই বিচারিক আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ রদ ও রহিত করে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(২)(আ) ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে তাদের প্রত্যেককে (সাত আসামি) আমৃত্যু কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও পাঁচ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো।
হাইকোর্টের রায় প্রকাশের পর সংক্ষুব্ধ পক্ষ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করেন। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী— আপিলটি শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
জঙ্গিরা বসে নেই, নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনায় রাখার পরামর্শ
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মতাদর্শ কখনো মরে না। জঙ্গিবাদের মতো উগ্রপন্থার মতাদর্শকে মোকাবিলা করতে হবে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে।
হলি আর্টিজানের মতো বড় ও নিখুঁত হামলা স্মরণে রাখলে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই, ঝুঁকি বিবেচনায় সতর্ক থাকতে হবে ও নিরবচ্ছিন্ন নজরদারি অব্যাহত রাখার পরামর্শ সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক নুরুল হুদার।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, হ্যাঁ, হয়তো ভয় কমেছে, তবে উগ্রবাদ জঙ্গিবাদী কার্যক্রম কখনো থেমে যায় না। সুতরাং সিকিউরিটি থ্রেট নেই এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। জঙ্গিবাদ-উগ্রবাদ এটা একটা মতাদর্শ। তাদের লোকজন সীমিত হলেও অনলাইন ও অফলাইনে কার্যক্রমে সহজেই যুক্ত হতে পারেন তারা।
তিনি আরও বলেন, তারা (জঙ্গি) কিন্তু বসে নেই। ভবিষ্যতে মাথাচাড়া দেবে না, বড় সিকিউরিটি থ্রেট তৈরি করবে না বা বড় হামলার ঝুঁকি তৈরি করবে না- এটা মনে করলে ভুল হবে। এখন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আছে বলে স্বস্তি কিংবা আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। বরং থ্রেট বিবেচনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কাজ করে যেতে হবে।

সম্মিলিতভাবে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
বাংলাদেশ পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) ভারপ্রাপ্ত প্রধান ডিআইজি আক্কাস উদ্দিন ভুঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অভিযোগে সন্ত্রাস বিরোধী আইনের মামলায় গ্রেপ্তার থাকা এবং ৫ আগস্টের পর জামিনে মুক্ত হওয়া ব্যক্তিদের নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। জেল থেকে পলাতক জঙ্গিদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। অনেকে ধরাও পড়েছেন। স্বস্তির সুযোগ নেই। আমরা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এটিইউ, সিটিটিসি ও র্যাবসহ অন্যান্য ইউনিট সম্মিলিতভাবে কাজ করছি। আমরা এলার্ট আছি।
বর্তমানে স্বস্তিকর অবস্থায় আছি
জানতে চাইলে সিটিটিসি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মাসুদ করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা বর্তমানে স্বস্তিকর অবস্থায় আছি, ভালো আছি মনে করছি। তবে নজরদারি বন্ধ রাখিনি। এটা চলমান থাকবে।
জেইউ/এমজে
