১৮ থেকে ২২ জুলাই, পাঁচ দিনে ১২০০ ব্যাগ রক্ত সরবরাহ করেছিল ‘রিদম’

জুলাই বিপ্লবের রক্তাক্ত অধ্যায়ে আহতদের আর্তনাদ আর রক্তের অভাবে যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ঢামেক) এক অসহায় মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল, তখন একটি ফোনকল ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংক যখন শূন্য, চিকিৎসকেরা যখন অপারেশনের টেবিলে থাকা তরুণদের জীবন বাঁচাতে এক ব্যাগ রক্তের জন্য হাহাকার করছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে ত্রাতা হয়ে এসেছিল রিদম ব্লাড সেন্টারের একদল নীরব যোদ্ধা। তারা কেবল রক্ত দিয়েই থামেনি, রাজপথে দাঁড়িয়ে শহীদের শেষ নিঃশ্বাসের সাক্ষীও হয়েছেন। তাদের এই অসামান্য অবদানের কথা স্বীকার করেন স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও।
এটি শুধু একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের গল্প নয়, এটি সেই সব চিকিৎসকদের গল্প— যারা নিজেদের জীবন বাজি রেখেছিলেন। যে হাতে সিরিঞ্জ ধরে রক্ত সংগ্রহ করেছেন, সেই একই হাতে ঠাঁই হয়েছিল গুলিতে প্রাণ হারানো নিথর দেহ।

সেদিন ছিল ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর নেমে আসে সশস্ত্র হামলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পরিণত হয় রণাঙ্গনে। লাঠিসোঁটা, রড আর কুড়ালে আহত শত শত শিক্ষার্থী যখন ঢামেকের জরুরি বিভাগে কাতরাচ্ছিল, তখন তৈরি হয় এক অকল্পনীয় সংকট। প্রতি সেকেন্ডে আহতদের নতুন স্রোত আসছিল। শরীর থেকে রক্ত ঝরতে থাকা তরুণদের বাঁচাতে পারছিলেন না চিকিৎসকেরা। কারণ, ব্লাড ব্যাংক ছিল সম্পূর্ণরূপে খালি। আহতদের স্বজন আর বন্ধুরা যখন এক ব্যাগ রক্তের জন্য দিগ্বিদিক ছুটছিলেন, হাসপাতালের করিডরে যখন কান্নার রোল, তখনই ঢামেকের একজন মরিয়া চিকিৎসক ফোন করেন রিদম ব্লাড সেন্টারে। আর সেই একটি ফোনকলই ছিল শত শত জীবন বাঁচানোর প্রথম পদক্ষেপ।
সোমবার (৪ আগস্ট) রাজধানীর নিউ এলিফ্যান্ট রোডের রিদম ব্লাড সেন্টারে সরেজমিনে গিয়ে এবং পরিচালক ডা. এস এম মামুনের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
ছোট অফিস থেকে রাজপথের মহাযজ্ঞ
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর নিউ এলিফ্যান্ট রোডের ছোট্ট একটি অফিস থেকেই জুলাই বিপ্লবে রাজপথের মহাযজ্ঞ পরিচালিত হয়েছিল। একটি সাধারণ ভবন, খাইরুন্নেসা ম্যানসনের দ্বিতীয় তলার তিনটি ছোট কক্ষে চলেছে তাদের বিশাল কর্মযজ্ঞ। ২২ জন কর্মচারী আর একদল চিকিৎসকের অদম্য শক্তিতেই টিকে আছে সংগঠনটি। একটি মাত্র অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে কাজ শুরু করলেও দ্রুতই তাদের পাশে দাঁড়ান অন্য চিকিৎসকেরা।

জানা গেছে, জুলাই বিপ্লবের সেই ভয়াল দিনগুলোতে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত— শুধুমাত্র ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই রিদম ব্লাড সেন্টার প্রায় ৭০০ জন গুলিবিদ্ধসহ মোট ১৫০০ আন্দোলনকারীকে বিনামূল্যে রক্ত সরবরাহ করে। এর মধ্যে কেবল ১৮ থেকে ২২ জুলাই, এই পাঁচ দিনেই তারা ১২০০ ব্যাগ রক্ত সরবরাহ করেছিল। তাদের এই অসামান্য অবদানের কথা সম্প্রতি এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও।
ফোনের ভাইব্রেশন টের পাচ্ছিলাম, কিন্তু...
রিদম সেন্টারের পরিচালক ডা. এস এম মামুনের বর্ণনায় উঠে আসে সেই সময়ের লোমহর্ষক চিত্র। তার প্রতিটি শব্দ যেন রাজপথের সেই ভয়াল দৃশ্যকে চোখের সামনে জীবন্ত করে তোলে।
তার ভাষায়, ‘১৮ জুলাই সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টা। আমার ফোনে ভাইব্রেশন হচ্ছে। আমি ফোনটা তুলতে পারছি না। কারণ, আমি তখন রাস্তায়, আর সামনেই তুমুল গোলাগুলি হচ্ছে। তার মধ্যে আমাদের যে যোদ্ধা আহত হচ্ছেন; আমি, ডা. মিনহাজ ও ডা. জুবায়ের মাহমুদ— আমরা তিনজন, রিদম ব্লাড সেন্টারের অ্যাম্বুলেন্স এবং আমাদের ফার্স্ট এইড সেটাপ নিয়ে আহতদেরকে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছি।’
‘সেদিন ম্যাক্সিমাম মানুষ আহত হয়েছিল এবং সেই সময়টা ছিল চরম ভয়াবহ। তখন আমাদের রিদমের যতটুকু সক্ষমতা ছিল, আমরা পূর্ণ সক্ষমতা নিয়েই রাস্তায় নামি।’
বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের সহযোগিতার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “তখন ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের (এনডিএফ) একজনের সঙ্গে কথা বলি, ওনাকে জানাই যে আমাদের তো একটি গাড়ি, পরে হয়তো আরও গাড়ি দরকার। তখন তিনি বললেন ‘পেয়ে যাবা। তোমাদের আর কী লাগবে?’ আমি বললাম ‘আমাদের আরও ফার্স্ট এইড প্রয়োজন, আরও ওষুধ প্রয়োজন।’ তিনি আশ্বাস দিলেন এবং পরের দিন আরও তিনটা গাড়ি ম্যানেজ করে আমাদের অফিসে পাঠিয়ে দিলেন।”

অপ্রত্যাশিত জায়গা থেকেও সহযোগিতা এসেছিল
রিদম সেন্টারের পরিচালক বলেন, জুলাই বিপ্লবের দিনগুলোতে আমরা যেমন জীবন ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছি, তেমনি এই কাজ চালিয়ে নিয়ে যেতে বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত জায়গা থেকেও সহযোগিতা পেয়েছি।
তার ভাষায়, “ঢাকা মেডিকেলের এক চিকিৎসক (ডা. কায়েস) আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, ‘তোমাদের তো মনে হয় টাকা লাগবে।’ আমি হ্যাঁ বলার পরপরই তিনি একজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সেদিন তার কাছ থেকে আমরা আর্থিক সহযোগিতা নিয়েছি। এভাবে অনেকেই জিজ্ঞেস করত, তোমাদের তো অনেক জিনিসপত্র প্রয়োজন, রাস্তায় খরচ হচ্ছে। তারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।”
ডা. মামুন আরও বলেন, ‘আমরা শুধু আহতদের চিকিৎসা দিয়েই ক্ষান্ত থাকতাম না। যারা আহত হচ্ছিল, তাদের স্বজনদেরও আমরা মাঝেমধ্যে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছি। কারণ, অনেকের সঙ্গেই তখন টাকা ছিল না, তাদের আমরা আর্থিক সহযোগিতা করতাম।’
‘আমার হাতে ছিল সোহাগের মস্তিষ্ক’, যে স্মৃতি ভুলতে পারেন না ডা. মামুন
রিদমের কাজ কেবল রক্ত সংগ্রহ আর বিতরণে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাদের কর্মীরা ছিলেন রাজপথের সেবক। ডা. মামুনের সবচেয়ে মর্মান্তিক স্মৃতিটি ছিল শহীদ সোহাগকে নিয়ে। কথা বলতে গিয়ে তার গলা ধরে আসে। তিনি বলেন, ‘আমার হাতের ওপর অনেক মানুষ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে... শহীদ সোহাগের ব্রেনটা গুলিতে খুলে আমার বাম হাতের ওপর ছিল। আমি দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসি।’
জুলাইয়ের এই রক্তযোদ্ধা বলেন, “সেই ছেলেটা ফুড ডেলিভারি করত। সে মারা যাওয়ার পর তার বাবা-মা ঢাকা ছেড়ে দিয়েছে। আমার সঙ্গে যখন কথা হলো, তার বাবা বললেন— ‘ঢাকার রাস্তায় আমি আর হাঁটতে পারি না। যে রাস্তায় আমার ছেলে পড়েছিল, সেই রাস্তায় আমি হাঁটতে পারি না।’ তারা ভোলার গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছে, আর ঢাকায় ফিরবে না।”
এই ত্যাগের গল্পগুলো মানুষের জানা উচিত বলে মনে করেন ডা. মামুন। বলেন, ‘আমরা তো আসলে একটু পর্দার পেছনে থাকতে পছন্দ করি। আমাদের যারা সবসময় সাপোর্ট দিয়েছেন, তারাও কিছুটা আড়ালেই থাকতে পছন্দ করেন। ফলে এই কথাগুলো মানুষ জানতে পারছে না। কিন্তু আমাদের জানানো উচিত। এগুলো বলছি, কারণ এই গল্পগুলো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ইন্সপায়ার করবে।’

মানবতার চেয়ে বড় কোনো বিপ্লব নেই
রিদমের পরিচালক বলেন, জুলাই বিপ্লব এই তরুণ চিকিৎসকদের জন্য শুধু ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, এটি তাদের অস্তিত্বের অংশ। তারা রক্তের ব্যাগ হাতে নিয়ে প্রমাণ করেছিলেন, মানবতার চেয়ে বড় কোনো বিপ্লব নেই। তারা জুলাইয়ের সেই অকথিত নায়ক, যাদের ত্যাগের হিসাব হয়তো কোনোদিন কোনো সরকারি খাতায় লেখা হবে না। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তারা অমর হয়ে থাকবেন।
ডা. মামুন বলেন, রিদম এবং তাদের মতো অগণিত নেপথ্যের নায়কদের কারণেই জুলাইয়ের সেই অন্ধকার দিনগুলোতেও মানবতার আলো জ্বলেছিল। প্রায় ২৫০ জন চিকিৎসক, মেডিকেল শিক্ষার্থী এবং ৮০ জন ভলান্টিয়ারের এক বিশাল টিম সেদিন কাজ করেছে। তাদের কেউ আহতদের হাসপাতালে এনেছে, কেউ রক্তের ব্যবস্থা করেছে, কেউবা চিকিৎসকদের জন্য পরিবহনের ব্যবস্থা করেছে।
‘সর্বোপরি রিদমের যে টিম, এই কাজের ক্ষেত্রে সামগ্রিক সহযোগিতা আমরা ডক্টরস ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরাম এবং আমাদের আরও অনেক চিকিৎসক ভাইদের পক্ষ থেকে পেয়েছি। আমরা সবার প্রতি কৃতজ্ঞ।’
টিআই/এমজে
