কারাগারে থাকা হাফেজ ছেলেকে মায়ের স্নেহমাখা চিঠি প্রকাশ্যে

জুলাইয়ের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান চট্টগ্রামের এইচএসসি পরীক্ষার্থী হাফেজ আব্দুল্লাহ বিন আয়ুব। বিচ্ছিন্ন হন পরিবারের সান্নিধ্য থেকে। অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটান ১৭টি নিঃসঙ্গ রাত। তখন এক কারারক্ষীর মাধ্যমে মা ও ছেলের মধ্যে হয় চিঠির আদান-প্রদান।
জেল জীবনের বছর ঘুরতে আব্দুল্লাহ সম্প্রতি সেই আবেগভরা মায়ের চিঠি প্রকাশ করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ লেখায় উঠে এসেছে একজন মায়ের অগাধ স্নেহ, একটি ছেলের সাহসিকতা এবং রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের বাস্তবচিত্র।
জানা যায়, জুলাইয়ে ছাত্র আন্দোলন চলাকালে কারাগারে বন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেতেন না পরিবারের লোকজন। তখন এক কারারক্ষীর মাধ্যমে মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন আব্দুল্লাহ।
আব্দুল্লাহর বাড়ি সাতকানিয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নের গারাংগিয়া এলাকায়। তার বাবা মোহাম্মদ আয়ুব জীবিকার তাগিদে সৌদি আরবে থাকেন। নগরের চকবাজার থানার ডিসি রোডে নিজেদের বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে থাকেন আব্দুল্লাহ। তিনি পরিবারে তৃতীয়। তার বড় বোন আফিয়া আয়মান রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস শেষ করেছেন। বড় ভাই মোহাম্মদ আবরার সৌদি আরবে থাকেন। ছোট আনাস বিন আয়ুব বর্তমানে এইচএসসি পরীক্ষার্থী ও আরেকজন আম্মার বিন আয়ুব পড়েন দশম শ্রেণিতে।
ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চিটাগাংয়ের (ইউএসটিসি) ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ। গত বছরের জুলাইয়ে আন্দোলন চলাকালে নগরের হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ১৪ জুলাই তার পদার্থবিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা ছিল। এরপর আব্দুল্লাহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখেন কোটা বাতিলের দাবিতে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। পরিবারের কাউকে না জানিয়ে ১৬ জুলাই নগরের ২ নম্বর গেটে আন্দোলনে অংশ নেন তিনি।
আরও পড়ুন

জুলাই আন্দোলনে গ্রেপ্তার হওয়া, কারাগারে থাকার অভিজ্ঞতা এবং মায়ের দেওয়া চিঠির প্রসঙ্গে শনিবার (৯ আগস্ট) আব্দুল্লাহর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, আশুরা উপলক্ষ্যে রোজা রাখার জন্য ১৭ জুলাই ভোরে আমরা ঘুম থেকে উঠি। সেহরির সময় আন্দোলন ও পুলিশি নির্যাতন নিয়ে মায়ের সঙ্গে আমরা গল্প করি। তারপর ভোরে হঠাৎ আমার বাসায় হানা দেয় একদল পুলিশ। দরজায় নক করলে আম্মু খুলে দেন। এরপর আব্দুল্লাহ কে জিজ্ঞেস করতে আমি এগিয়ে যাই। তখন পুলিশ আমার মোবাইল দেখতে চায়। আমি মোবাইল আনতে রুমে ঢুকি। পেছন পেছন পুলিশও ঢুকে আমার কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে নেয়। তখন আন্দোলন নিয়ে ফেসবুকে দেওয়া পোস্ট পুলিশ দেখে ফেলে। তারা আমাকে বলেন, চকবাজার থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) আমার সঙ্গে কথা বলবেন এবং এজন্য আমাকে তাদের সঙ্গে যেতে হবে। আমি প্যান্ট পরে তাদের সঙ্গে রওনা দিই।
‘আমাকে গ্রেপ্তারের টিমে ছিল চকবাজার থানার এসআই (উপ-পরিদর্শক) জাহেদ ও ইমরান। তাদের মধ্যে ইমরান আমাকে বাড়িওয়ালা হিসেবে চিনতেন। কিন্তু জাহেদ ছিলেন উগ্র। তিনি আমার গায়ে কয়েকবার হাত তোলার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে আমাকে বলেন, তোদের আন্দোলনে কে যেতে বলেছে। তোরা এই আন্দোলন করে কি সরকারের পতন করতে পারবি? এভাবে আমাকে হুমকি দিতে থাকেন। ১৭ জুলাই দুপুরে আমাকে পাঁচলাইশ থানায় প্রেরণ করা হয়। সেখানে একজন এসআই এসে আমাকে জিজ্ঞেস করতে থাকে শিবির করি কি না? আন্দোলনে আর কে কে আছে? ইত্যাদি। ওই থানায় তখন অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ওইদিন রাতে আমাদেরকে প্রিজন ভ্যানে করে আদালতে না তুলে সরাসরি কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।’
কারাগারের দুঃসহ কষ্টের বর্ণনা দিয়ে আব্দুল্লাহ বলেন, রাতে আমাদেরকে একটি রুমে রাখা হয়। যেখানে সর্বোচ্চ ৫০ জনের জায়গা হবে সেখানে অন্তত ১৫০ জনকে রাখা হয়। সেখানে বাথরুমের অবস্থা এত নোংরা, বলার মতো না। কারা কর্তৃপক্ষের সরবরাহ করা খাবার আমরা খেতে পারিনি। পরদিন আমার আম্মু সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। ৩টা লোহার গ্রিলের মধ্যে কোনোমতে কথা বলেছিলাম। এরপরে পরিবারের আর কারো সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয়নি। আমাকেসহ আন্দোলনে গ্রেপ্তার কয়েকজনকে কারাগারের কর্ণফুলী ভবনের একটা কক্ষে রাখা হয়েছিল। যেখানে অন্য দাগি আসামিরা ছিলেন। ওইখানে আমি হাফেজ হিসেবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে ইমামতি করতাম।
তিনি বলেন, এক কারারক্ষীর মাধ্যমে আমার মাকে বিভিন্ন খবরাখবর জানাতাম। তিনিও আম্মুর নানা খবর আমাকে পৌঁছাতেন। ৩০ জুলাই আম্মুকে আমি একটা চিঠি লিখি। ওই চিঠি কারারক্ষী বের হয়ে আম্মুকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি তুলে পাঠান। পরে আম্মুও আমার উদ্দেশে একটি চিঠি লিখে কারারক্ষীর বাসায় পৌঁছে দেন। ৩১ জুলাই আম্মুর সেই চিঠি আমি পাই। চিঠিটি আমি সংরক্ষণ করি।
‘আমার আব্বু দেশের বাইরে থাকেন। গ্রেপ্তারের পর আম্মুই আমার মুক্তির জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। পাশাপাশি আমার বাড়ি চট্টগ্রাম মহানগর শিবির অফিসের পাশে। সেজন্য শিবিরের লোকজনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল। তারাও আমার মুক্তির জন্য চেষ্টা করে। ২ আগস্ট আমি কারাগার থেকে মুক্তি পাই।’
সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে আব্দুল্লাহর মা জান্নাতুল ফেরদৌস ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ছেলে বাসা থেকে বের হলেই আমি তাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় দিই। গ্রেপ্তারের দিন আমি তাকে জড়িয়ে ধরতে পারিনি। কারাগারে যতদিন ছিল, রাতবিরাতে নিঃশব্দে কেঁদেছি। ধৈর্য ধরে থেকেছিলাম। ২ আগস্ট রাতে যখন কারাগার থেকে বের হয়, অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে কেঁদেছি।

কী আছে আব্দুল্লাহর মায়ের চিঠিতে
‘বাবা, তুমি আমাদের জন্য চিন্তা করিওনা। আলহামদুলিল্লাহ বাসার সবাই ভালো আছে। আনাস, আম্মারকে কোথাও বের হতে দিই না। যা লাগে দাদাকে দিয়ে আনি। তুমি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করিও, নিজের যত্ন নিও। চিন্তা করিও না। আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে। তুমি একদম নিরাশ হইও না। বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করা। দোয়া ইউনুস, সুরা কাসাসের ২৪নং আয়াত, সুরা ইয়াসিনের প্রথম ৯ আয়াত বেশি বেশি, দরুদ শরিফ আর ইস্তেগফার পড়বে। জীবন মানেই পরীক্ষা। একদম উল্টা-পাল্টা চিন্তা করবে না, সবর কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবরকারীদের সাথে আছে।
বাবা, সবগুলো কলেজের শিক্ষার্থীরা এইচএসসি পরীক্ষা বয়কট করেছে। অনেক পরীক্ষার্থীকে ধরে নিয়ে গেছে। পরীক্ষা নিয়ে টেনশন করিওনা, পরীক্ষা আপাতত হবে না। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। আজকে কোর্ট বিল্ডিংয়ের উকিলরা ছেলে-মেয়েদের সাথে বিক্ষোভ মিছিল করছে। তুমি ধৈর্য ধরো। জামিন হতে সময় লাগবে। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তোমার বন্ধুরাও ফেসবুকে অনেক প্রচারণা চালাচ্ছে তুমিসহ আরও যারা পরীক্ষার্থী আটক হয়েছে তাদের মুক্তির জন্য। উকিল প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছেন। আমরা তোমার জন্য ৩ জন উকিল নিয়োগ করেছি। কাউকে জামিন দিচ্ছে না। উপর মহলের নির্দেশ না আসা পর্যন্ত কারও জামিন হবে না। তাও আমরা প্রতিনিয়ত খোঁজ রাখছি, যদি কোনো উপায় পাওয়া যায়। তোমার ফ্রেন্ডের মাধ্যমে হাইকোর্টের একজন উকিলের কাছে মামলার কাগজপত্র পাঠিয়েছি আজকে। দেখা যাক, আল্লাহ কি করে।
বাবা, তোমার কিছু দরকার হলে খবর দিও। পিসিতে আজকে ৩০০০ টাকা দেব। তোমার জন্য সবাই দোয়া করতেছে। ৭ আগস্ট কোর্টে শুনানি হবে কি না আমি উকিলের সাথে কথা বলে তোমাকে জানাব। কারণ তোমাদের মামলার শুনানি একবার হয়েছে ২৪ জুলাই। ওইদিন ১৫ জনের জামিন চেয়েছিল উকিলরা। কোর্ট থেকে নামঞ্জুর করে দিছে। শুধু তুমি পরীক্ষার্থী বলে জজ পরীক্ষার অনুমতি দিছে। দোয়া করতে থাক বেশি করে, দেশের পরিস্থিতি যেন ভালো হয়। এখন যাদেরকে ধরতেছে তাদেরকে অনেক অত্যাচার করতেছে। নির্বিচারে গুলি করতেছে। যাকে যেখানে পাচ্ছে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।
পরিশেষে, বাপ আমার চিন্তা করিও না। বুকে সাহস রাখবা। আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও বেশি বেশি। ইনশাআল্লাহ, খুব শিগগিরই মার কাছে ফিয়ে আসতে পারবে। আল্লাহ তুমি আমার ছেলেকে হেফাজতে রাখ, আমিন।’
এমআর/এসএসএইচ
