বিএনপি নেতা সাধন হত্যার নেতৃত্বে সরকারি কর্মকর্তা!

রেস্টুরেন্ট ব্যবসা ছেড়ে ২০১৮ সাল থেকে ইন্টারনেট ব্যবসায় নেমেছিলেন গুলশান থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল আহসান সাধন। গত ২১ মার্চ রাজধানীর গুলশানে পুলিশ প্লাজার সামনে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবসায়ী সুমন মিয়া ওরফে টেলি সুমন (৩৩) নিহত হওয়ার পর সাধনের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় চাঁদাবাজিসহ ডিশ ও ইন্টারনেটের ব্যবসা।
নির্বিঘ্নে স্বদেশ কমিউনিকেশনস নামক ইন্টারনেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা বিএনপি নেতা সাধনও একই কায়দায় খুন হন গত ২৫ মে। সেদিন রাত সোয়া ১০টার দিকে রাজধানীর মধ্য বাড্ডার গুদারাঘাট-৪ নম্বর গলিতে তাকে জনসম্মুখে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।
পুলিশের তদন্ত ও সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দুই মাসের মাথায় গুলিতে দুজন ব্যবসায়ীর চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনায় উঠে আসে আন্ডারওয়ার্ল্ডের আধিপত্যের দ্বন্দ্ব। গুলশানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মার্কেটে দোকান বরাদ্দ, কেব্ল টিভি–সংযোগ, ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবসা ও ফুটপাতের চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় দুটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের জেরে খুন হন বিএনপি নেতা সাধন।
আরও পড়ুন
সাধন হত্যা মিশনের নেতৃত্বে সরকারি কর্মকর্তা মিজানুর রহমান!
একাধিক তদন্ত সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, আমেরিকায় থাকা তিতুমীর কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও গুলশান-বাড্ডা এলাকার সন্ত্রাসী মেহেদী ওরফে কলিনসের পরিকল্পিত ছকেই খুন হন সাধন। এ হত্যাকাণ্ডকে সন্দেহের বাইরে রাখতে, অনেকটা স্লিপার সেল স্টাইলে তিনটি লেয়ারে যোগাযোগের মাধ্যমে কিলিং মিশন সাকসেস করতে চারজনকে নিযুক্ত করা হয়।
চাঞ্চল্যকর এই কিলিং মিশন পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ যিনি করেন, তার নাম মিজানুর রহমান মিম। তিনি শতভাগ সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডে(ডিএমটিসিএল) সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। যা ছিল তদন্তকারী কর্মকর্তাদের ভাবনার বাইরে।
একটি সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণের ভিত্তিতে প্রথমে তাকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ডিবি পুলিশ। তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। হত্যা মিশনে জড়িত ছিল মোট চারজন। যদিও ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা সিসিটিভি ফুটেজে দুজনকে শ্যুট করতে দেখা গেছে।
মিমের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে শ্যুটার হৃদয় ও মুন্নাকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। গত জুলাইয়ে গ্রেপ্তার এই তিনজনের মধ্যে মিম ও হৃদয় আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
আরও পড়ুন
যে কারণে বিএনপি নেতা সাধনকে খুন করা হয়
ডিবি পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, তিতুমীর কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সন্ত্রাসী মেহেদী ওরফে কলিনসের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল গুলশান ও বাড্ডা এলাকায়। সে চাঁদাবাজি, ডিশ ও ইন্টারনেটের ব্যবসা পরিচালনা করতো। বর্তমানে সে আমেরিকায় অবস্থান করছে।
৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে তার গ্রুপের সদস্য টেলি সুমন খুন হন। এরপর পুরো গুলশান-বাড্ডা এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় সাধনের হাতে। সাধন হচ্ছে মেহেদীর বিপক্ষ আন্ডারওয়ার্ল্ড গ্রুপ রবিন, ডালিম ও মাহবুব গ্রুপের সদস্য। মালয়েশিয়ায় থাকা মাহবুব ও সাধন সম্পর্কে মামা-ভাগ্নে বলে প্রচার রয়েছে। টেলি সুমন হত্যার বদলা ও হারানো ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে সাধনকে হত্যার পরিকল্পনা করে মেহেদী। অনেকটা স্লিপার সেল স্টাইলে ৩ বা ৪টি লেয়ারে যোগাযোগের মাধ্যমে অপরাধমূলক কাজ পরিচালনা করতো মেহেদী। সেই কৌশল প্রয়োগ করেই অপরিচিত চারজনকে ভাড়া করে সাধন হত্যা মিশন সম্পন্ন করে মেহেদী।
সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ, ইশারা দেওয়া যুবককে আটকে তদন্ত শুরু ডিবির
ডিবি পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, হত্যার ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে— কালো গেঞ্জি পরিহিত এক যুবক সামনের দিকে আগানোর সময় দুই শ্যুটারকে হাতের ইশারায় সাধনকে দেখিয়ে দেয়। প্রথমে ডিবি পুলিশ তাকে হেফাজতে নেয়। অবাক করা বিষয় আলামিন নামে ওই যুবকের মোবাইল নম্বর নেই, আগে বা পরে সে যেখানে-যেখানে গেছে সেটা যাচাই করে শক্ত সংশ্লিষ্টতা মেলেনি। যদিও জামিনে থাকা আলামিন ডিবির সন্দেহের বাইরে নয়।
শ্যুটারদের চিহ্নিত করতে ২ বা ৩ কিমি দূরের ফুটেজ বিশ্লেষণ
জানতে চাইলে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ডিবি-দক্ষিণ) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, চাঞ্চল্যকর সাধন হত্যার ঘটনায় মামলার পরপরই ডিবি পুলিশ ছায়া তদন্ত শুরু করে। থানা পুলিশও তদন্ত করছিল। প্রথমদিকে কার্যত আমরা ব্যর্থই ছিলাম। তবে হাল ছাড়িনি, লেগেছিলাম। একটার পর একটা সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ, শ্যুটারদের যখন কোনোভাবেই ফেসম্যাচ করতে পারছিলাম না। তখন ঘটনাস্থল থেকে আরও ২ বা ৩ কিলোমিটার দূরত্বের ফুটেজ সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ শুরু করি। কারণ, সাধনকে শ্যুট করা দুজনের মুখেই মাস্ক ছিল।
তিনি বলেন, তদন্তে ভিডিও ফুটেজ, স্থানীয় লোকজন, হকার ও সোর্স কাজে লাগাই, জিজ্ঞাসাবাদ করি। গত ২১ মার্চ পুলিশ প্লাজার সামনে সন্ত্রাসীদের গুলিতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবসায়ী সুমন মিয়া ওরফে টেলি সুমন হত্যার ঘটনাও আমরা বিশ্লেষণ করি। দুটো ঘটনার ক্রাইম প্যাটার্ন কিন্তু প্রায় একই। সবমিলিয়ে ডিবি পুলিশের একাধিক টিম গ্রুপ করে কাজ করছিল। শুধু খুঁজছিলাম কোথায় গিয়ে মাস্ক খুলেছে কিলাররা।
আরও পড়ুন
ডিবির এ যুগ্ম কমিশনার বলেন, কোনো কূল-কিনারা না পেয়ে ২ বা ৩ কিলোমিটার দূরের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করা শুরু করি। কাকতালীয়ভাবে এই পর্বে সফল হই। আমেরিকান অ্যাম্বাসির পেছনে গুদারাঘাটের শেষ মাথায় একটি দোকানের সামনে দুই শ্যুটারসহ চারজনকে একসঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়।
‘ওই ফুটেজটি হত্যার ঘটনার তিন ঘণ্টার আগের। ধারণা করি, সেখানেই দীর্ঘ আলাপচারিতায় হত্যার পরিকল্পনা করে। ভিডিওতে আমরা নানা কথাবার্তা, ম্যাসেজ দেখানো তথ্য আদান-প্রদান করতে দেখতে পাই।’
নাসিরুল ইসলাম বলেন, প্রথমে ওই চারজনের ছবি দেখিয়ে পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলে। তবে স্থানীয় সূত্রে একজনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়। তার নাম মিজানুর রহমান মিম। তিনি সরকারি দপ্তরের সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অফিসার। আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বন্ধ। কর্মস্থলেও অনুপস্থিত। গত ৪ জুলাই তাকে হেফাজতে নেওয়া হয়। রিমান্ডের আগেই সে ডিবির কাছে জিজ্ঞাসাবাদে সবকিছু স্বীকার করে। মূলত তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে কিলিং মিশনে জড়িত চারজনের নাম ও পরিচয় জানতে পারি। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অপর দুই শ্যুটার হৃদয় চৌধুরীকে ১২ জুলাই ও সাহেদ হোসাইন মুন্নাকে ১৬ জুলাই গ্রেপ্তার করি। মিম ও হৃদয় আদালতে সব কিছু স্বীকার করেছে।
মেহেদীকে অনুসরণ, কথিত ছোটভাইদের চালাতে গিয়ে ধরা মিম
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গ্রেপ্তার মিমও তিতুমীর কলেজে পড়াশুনা করেছে। সে সূত্রেই আন্ডারওয়ার্ল্ড অপরাধী মেহেদীর সঙ্গে তার যোগাযোগ ও পরিচয়। মেহেদীর সঙ্গে মূলত কিলিং মিশন পরিচালনার নেতৃত্ব দেয় মিম। তবে অস্ত্র সরবরাহকারী জনৈক যুবককে খোঁজা হচ্ছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, কিলিং মিশনে সরাসরি জড়িত ছিল চারজন। তবে শীর্ষ সন্ত্রাসী মেহেদী ছাড়াও ২ বা ৩টি লেয়ারে লোকজন জড়িত ছিল। কারণ, ঘটনার তিন ঘণ্টা আগের একটি সিসিটিভি ফুটেজে মেহেদীর সঙ্গে মিমের যোগাযোগ হয়। তখন গুদারাঘাটের হত্যার ঘটনাস্থলে আগে থেকেই অবস্থান করছিল কেউ। তার মাধ্যমে ছবিও আদান-প্রদান হয়। ঘটনার কয়েক মিনিট আগে নয়ন বিরিয়ানি হাউজে অবস্থান নেয় মিম। ঘটনাস্থলে আগে থেকে সাধনের ছবি তুলে পাঠানো হয় মেহেদীকে। মেহেদীর মাধ্যমে সেই ফুটেজ যায় মিমের কাছে। মিমের মোবাইল থেকে ছবি দেখে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় দুই শ্যুটার। দুই শ্যুটার মাস্ক পরিহিত অবস্থায় জনসম্মুখে গুলি করে নয়ন বিরিয়ানি হাউজের সামনে দিয়েই পালিয়ে যায়। ঘটনার পর মিম ছবি আদান-প্রদানের আলামত নষ্ট করতেই সবকিছু ভেঙে পানিতে ফেলে দিয়েছে।
আরও পড়ুন
চারজনের তিন কিলার গ্রেপ্তার হলেও উদ্ধার হয়নি অস্ত্র
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ডিবি-দক্ষিণ) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা এখন কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া আরেকজনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি। সেই মূলত অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। পাশাপাশি হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
হত্যা মামলাটির ছায়া তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবির একটি সূত্র বলছে, সুমন মিয়া ছিলেন মেহেদী গ্রুপের অনুসারী। তাকে গুলি করে হত্যা করেছিল রবিন, ডালিম ও মাহবুব গ্রুপের লোকেরা। ব্যবসা, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এই হত্যার প্রতিশোধ নিতেও তাকে হত্যা করা হয়।
জানতে চাইলে নিহতের স্ত্রী দিলরুবা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেহেদীর সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক বা শত্রুতা নাই। কখনো শুনিনি মেহেদীর সঙ্গে সাধনের দ্বন্দ্ব। সে কেন খুন করাবে? ঘটনাস্থলের আশপাশে কেউ না কেউ ছিল, যে খুনিদের সহযোগিতা করেছে। তাকে বা তাদের গ্রেপ্তার করা হোক, যারা সত্যিকারের খুনি। আর কথিত মামা মাহবুবের সঙ্গে সাধনের পরিচয় ও কথা ২০০০ সালেরও আগে। এরপর আর কোনো যোগাযোগ ছিল না বলে দাবি দিলরুবার।
উল্লেখ্য, গত ২৫ মে রাত সোয়া ১০টার দিকে রাজধানীর মধ্য বাড্ডার গুদারাঘাট-৪ নম্বর গলিতে গুলশান থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল আহসান সাধনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
পরে রক্তাক্ত অবস্থায় সাধনকে উদ্ধার করে অটোরিকশাযোগে চিকিৎসার জন্য মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অ্যাম্বুলেন্সযোগে জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তার বুকের ডানে-বামে, পিঠে ও ঘাড়ে গুলি লেগেছে। সেখান থেকে পরে তার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করে পুলিশ।
ঘটনার পর সাধনকে লক্ষ্য করে দুই যুবকের এলোপাতাড়ি গুলির ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ফুটেজে দেখা যায়, একটি দোকানের বাইরে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে কয়েকজনের সঙ্গে গল্প করছিলেন কামরুল আহসান সাধন। রাত ১০টা থেকে ১০টা ১০ মিনিটের মধ্যে দুজন হেঁটে এসে পিস্তল দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে দৌড়ে পালিয়ে যান। এতে ঘটনাস্থলে লুটিয়ে পড়েন কামরুল।
হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলের আশপাশে অনেকে উপস্থিতি থাকলেও হত্যাকারীদের আটকাতে কাউকেই এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। ওই ঘটনায় ২৬ মে সকালে নিহতের স্ত্রী দিলরুবা আক্তার বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ৩৩। মামলায় অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়।
জেইউ/এমজে
