আনফিট বাসের রমরমা ব্যবসা : বিআরটিএ’র ফিটনেস আছে কি?

বাসের দরজা বন্ধ হয় না, জানালায় ফাটল, ব্রেক অচল— তবুও চলছে ‘ফিট’ সনদ নিয়ে! রাজধানীসহ সারাদেশে প্রায় অর্ধেক বাসেরই ফিটনেস নেই, কিন্তু বিআরটিএ’র কাগজে সব ঠিকঠাক। অথচ এসব বাস কর্তৃপক্ষের চোখের সামনেই প্রতিদিন যাত্রী নিয়ে চলছে। আর যাত্রীরা শুধু গন্তব্যের উদ্দেশে নয়, জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সড়কে পা রাখছেন। মূলত নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার নজরদারি এবং মালিকদের প্রভাবের দ্বন্দ্বে চরম ভোগান্তিতে সাধারণ যাত্রীরা।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি শুধু প্রশাসনিক দুর্বলতা নয়, বরং প্রভাবশালী মহল ও ঘুষের একটি জটিল নেটওয়ার্ক। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে— যানবাহনের ফিটনেস দেখার আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ’র নিজের ফিটনেস ঠিক আছে কি না?
সরকারি হিসাবে দেখা গেছে, সারাদেশে চলাচলকারী বাণিজ্যিক বাসগুলোর প্রায় ৪২ শতাংশের ফিটনেস মেয়াদ শেষ। অথচ এসব বাস প্রতিদিনই যাত্রী পরিবহন করছে। সরকারের দুর্বল নিয়ন্ত্রণের কারণে যাত্রীরা ঝুঁকি নিয়েই প্রতিদিন এসব বাসে চড়ে যাতায়াত করছেন।
প্রতিটি রুটে অন্তত ১০টির মধ্যে সাত থেকে আটটি বাসই দৃশ্যমানভাবে ফিটনেসবিহীন। এসব বাসের দরজা ঠিকমতো বন্ধ হয় না, জানালা ফাঁকা, বডিতে মরিচা দেখা যায়, রঙ উঠে গেছে এবং টায়ারের বাতাস থাকে অনিয়ন্ত্রিত। কিছু বাসের হেডলাইট বা ইন্ডিকেটর লাইট ভাঙা, ব্রেকিং সিস্টেমের অবস্থা খুবই খারাপ। গ্লাসে ফাটার অসংখ্য দাগ। এমন ভাঙাচোরা, বিশ্রী বাসে যাত্রী ঝুঁকি জেনেও বাধ্য হয়ে উঠছেন
সম্প্রতি সরকারের এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) কিছু তথ্য উপস্থাপন করেছে। বৈঠকে জানানো হয়েছে, জুন পর্যন্ত সারাদেশে নিবন্ধিত বাসের সংখ্যা ৫৬ হাজার ৭৩৩টি। এসব বাসের মধ্যে ২৩ হাজার ৬৬৫টির ফিটনেস নবায়ন করা নেই। এছাড়া, ২৮ হাজার ৫৬১টি মিনিবাসের মধ্যে ১১ হাজার ৯০৫টি এবং ১৭ হাজার ৩৭৪টি হিউম্যান হলারের মধ্যে ১৪ হাজার ৫১০টির ফিটনেস নবায়ন করা হয়নি।
প্রধান শহর ঢাকার প্রেক্ষাপটে দেখা গেছে, প্রায় ৩০৫ বর্গকিলোমিটারের এই রাজধানী শহরে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিআরটিএ নিবন্ধন দিয়েছে ৪৩ হাজার ৬৭৬টি বাস। এর মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশই ফিটনেসবিহীন।
আরও পড়ুন
আনফিট বাস, চলছে ট্রাফিক পুলিশের সামনেই
রাজধানীর একাধিক ব্যস্ততম সড়কে সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রতিটি রুটে অন্তত ১০টির মধ্যে সাত থেকে আটটি বাসই দৃশ্যমানভাবে ফিটনেসবিহীন। এসব বাসের দরজা ঠিকমতো বন্ধ হয় না, জানালা ফাঁকা, বডিতে মরিচা দেখা যায়, রঙ উঠে গেছে এবং টায়ারের বাতাস থাকে অনিয়ন্ত্রিত। কিছু বাসের হেডলাইট বা ইন্ডিকেটর লাইট ভাঙা, ব্রেকিং সিস্টেমের অবস্থা খুবই খারাপ। গ্লাসে ফাটার অসংখ্য দাগ। এমন ভাঙাচোরা, বিশ্রী বাসে যাত্রী ঝুঁকি জেনেও বাধ্য হয়ে উঠছেন।
আবুল হোটেল থেকে বসুন্ধরা বাসস্টপ পর্যন্ত নিয়মিত অফিসে যাতায়াত করেন আদনান সাজীম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সর্বশেষ কখন একটি বাস দেখে মন ভালো হয়েছিল, তা মনে নেই। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাসগুলোকে দেখলেই ভয় লাগে। কোনো বাস একদিকে কাত হয়ে আছে, কোনো বাসের রঙচটা, হাজারও দাগ বাসের গায়ে। কিছু বাসের সামনে-পেছনের গ্লাস ভাঙা, নেই ইন্ডিকেটর লাইট। চালক মানছেন না কোনো নিয়ম।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাসের ভেতরের অবস্থা আরও খারাপ। সিটগুলো ছোট, পাশাপাশি দুজন বসা কষ্টকর। কভার নোংরা, কখনও-কখনও তেলাপোকাও থাকে। ফ্যান নষ্ট, যাত্রীরা গরমে ঘামে ভিজে যান।’
আদনান সাজীম আক্ষেপ করে বলেন, ‘সরকারের দায়িত্বশীলরা খুব দুর্বলভাবে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করছেন। একটা দৃশ্যমান ফিটনেসবিহীন বাস কীভাবে ট্রাফিক পুলিশের চোখের সামনে চলতে পারে, তা বোঝা যায় না। বিআরটিএ-এর কর্মকর্তারা কি সড়ক ব্যবহার করছেন না? তারাও তো সড়কে এসব বাস দেখেন।’
কলাবাগান থেকে উত্তরা রুটের নিয়মিত যাত্রী সুমাইয়া রহমান। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন এমন ফিটনেসবিহীন বাসে উঠতে ভয় লাগে। অনেক বাসে হঠাৎ ব্রেক ধরলে মনে হয় গাড়ি উল্টে যাবে। বাসের জানালা অনেক সময় বন্ধ হয় না, ধুলোবালি ঢুকে যায়। আর সিটগুলোও ছেঁড়া-ময়লা।’
‘এটা শুধু শারীরিক ঝুঁকি নয়, মানসিকভাবেও আমরা প্রতিদিন চাপের মধ্যে থাকি। তবুও এই ভাঙাচোরা, অক্ষম বাসগুলোই ভরসা এবং এর বাইরে অন্য কোনো বিকল্প নেই।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাসের ফিটনেস ইস্যু এখন শুধু প্রশাসনিক নয়; এটি ঘুষ, প্রভাব ও দুর্বল নীতিনির্ধারণের জটিল এক চক্রে আটকে গেছে। পরিবহন-মালিক ও সমিতির নেতাদের প্রভাব এতটাই গভীর যে সরকারও তাদের সামনে অসহায়।
আরও পড়ুন
উন্নত বিশ্বের কঠোর পরীক্ষার বিপরীতে বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন
বিআরটিএ’র এনফোর্সমেন্ট শাখা সূত্রে জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে সারাদেশে ৩৮৬টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। এসব আদালত ২৬১৮টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ১৩ জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ডাম্পিং করা হয়েছে ৩৬৪টি গাড়ি। মোট জরিমানা আদায় হয়েছে ৬৫ লাখ ২১ হাজার ১০০ টাকা।
ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখা গেছে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বাণিজ্যিক বাসের ফিটনেস পরীক্ষা ব্যক্তিগত গাড়ির তুলনায় অনেক কঠোর ও নিয়মিত। এই পরীক্ষা যাত্রীদের নিরাপত্তা, পরিবেশ রক্ষা এবং যানজট নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করে। সাধারণত এই পরীক্ষা ছয় থেকে ১২ মাস বা বছরে একবার বাধ্যতামূলক করা হয়।
দেশভিত্তিক নিয়ম ও শাস্তি ভিন্ন। জার্মানিতে বড় বাসের জন্য প্রতি বছর পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। অনুমোদিত সংস্থা যেমন- টিইউভি বা ডিইকেআরএ পরীক্ষা পরিচালনা করে। পরীক্ষায় ব্যর্থ হলে মেরামতের নির্দেশ দেওয়া হয়, তা না করলে চালনা নিষিদ্ধ ও জরিমানা বা লাইসেন্স সাসপেন্ড করা হয়। ফ্রান্সে বছরে একবার পরীক্ষা বাধ্যতামূলক; ব্যর্থ হলে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মেরামত করতে হবে। জাপানে ‘শেকেন’ নামে পরিচিত প্রক্রিয়ায় প্রতি এক থেকে দুই বছর অন্তর পরীক্ষা বাধ্যতামূলক; ব্যর্থ হলে ফিটনেস সার্টিফিকেট বাতিল হয়।
অথচ বাংলাদেশের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে টাকা দিলে আনফিট বাসও ‘ফিট’ হয়ে যায়।
আরও পড়ুন
নীতি হয় মালিকবান্ধব, জনবান্ধব নয়
বাসের ফিটনেস ইস্যু শুধু প্রশাসনিক নয়; এটি ঘুষ, প্রভাব ও দুর্বল নীতিনির্ধারণের জটিল চক্রে আটকে আছে বলে মন্তব্য করেছেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান।
তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মালিক ও সমিতির নেতাদের প্রভাব এত গভীর যে সরকারও তাদের সামনে অসহায়। তাদের অনেকেই সরকারের ভেতরেও প্রভাবশালী। ফলে, সিদ্ধান্তগুলো যাত্রীদের চেয়ে মালিক ও শ্রমিকদের পক্ষে চলে যায়। সরকারের ভেতরে নীতিনির্ধারকরা যখন ওই খাতের প্রতিনিধি, তখন স্বাভাবিকভাবে নীতি হয় মালিকবান্ধব, জনবান্ধব নয়।’
তিনি আরও বলেন, “ফিটনেস প্রদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বিআরটিএ’র ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। এটি একটি উচ্চমাত্রার টেকনিক্যাল কাজ, যেখানে গাড়ির যান্ত্রিক ও কাঠামোগত সক্ষমতা বিশ্লেষণ করতে হয়। কিন্তু সংস্থার নিজস্ব টেকনিক্যাল সক্ষমতা দুর্বল। অনেক ক্ষেত্রেই চোখে দেখে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া হয়, আবার ঘুষের বিনিময়ে আনফিট গাড়িকেও ‘ফিট’ ঘোষণা করা হয়। তাই এখন প্রশ্ন উঠেছে— যানবাহনের ফিটনেস দেখার আগে বিআরটিএ’র নিজের ফিটনেস আছে কি না, সেটাই আগে দেখা দরকার।”
আরও পড়ুন
সার্বিক বিষয় নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মনে করেন ঢাকায় পাঁচ লাখ বাসের রেজিস্ট্রেশন দেওয়া আছে। কিন্তু বাস্তবে এর দ্বিগুণ বাস সড়কে চলাচল করছে।’
তিনি বলেন, ‘সড়কের তুলনায় বাসের সংখ্যা বেশি, আবার যাত্রীদের চাহিদাও অনেক। তাই, নতুন বাস দিয়ে প্রতিস্থাপন না করা পর্যন্ত এগুলো রাস্তা থেকে সরানো যাচ্ছে না। বাস-মালিকদের সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে কাজ চলছে, যেন তারা নতুন বাস এনে পুরোনোগুলো রিপ্লেস (পরিবর্তন) করতে পারেন।’
এমএইচএন/এমজে/এমএআর/
