‘ড্যাপ অভিজাত এলাকার সঙ্গে ফার মানের বিদ্যমান বৈষম্য জিইয়ে রাখা হয়েছে’

ডিটেল এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) অভিজাত এলাকার সঙ্গে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (ফার) মানের বিদ্যমান বৈষম্য জিইয়ে রাখা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান।
মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
ড্যাপর সংশোধনী বিষয়ের বিপক্ষে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে পরিবেশকর্মী, আইনজীবী, শিক্ষক, পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, প্রকৌশলী, অর্থনীতিবিদ, নাগরিক, সমাজকর্মী ও গবেষকরা।
অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) সাম্প্রতিক সংশোধনীর প্রস্তাবনা অনুযায়ী, ঢাকার অধিকাংশ এলাকার এফএআর এর মান অনেকাংশেই বাড়ানোর যে প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর কারিগরি ভিত্তি নেই। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহলের প্ররোচনায় পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট কারিগরি জ্ঞানকে উপেক্ষা করেই এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব, ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) ও আবাসন ইউনিটের কিছু স্বেচ্ছাচারী ও ফরমায়েশি মান প্রস্তাব করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ড্যাপ সংশোধনী প্রস্তাবনায়, গুলশান-বানানী ও ধানমন্ডির মতো অভিজাত এলাকার ফার মান কমানোর দাবিকে বারংবার উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে অভিজাত এলাকার সঙ্গে ফার মানের বিদ্যমান বৈষম্য জিইয়ে রাখা হয়েছে। এই বিষয়টিকে সামনে এনে অনেক এলাকার ফার ও জনঘনত্বকে বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। পূর্বাচলের মত এলাকায়ও ফারকে নিয়ন্ত্রণ করবার কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। একইসঙ্গে অতিরিক্ত ফার প্লট মালিকদের অতিরিক্ত অনার্জিত আয়ের সুযোগ করে দেবে, যা নগরে প্লটহীন নাগরিকদের সঙ্গে বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দেবে।
আদিল মুহাম্মাদ খান বলেন, এলাকাভিত্তিক ভবনের উচ্চতার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করবার ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন উপদেষ্টারা। কিন্তু আবাসিক এলাকার জন্য নগর পরিকল্পনার এই অতি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলের ব্যাপারে পরিবর্তিত ড্যাপে বিষয়টিকে একেবারেই উপেক্ষা করা হয়েছে।
যানজট, জলজট, বায়ুদূষণ, উষ্ণায়ন, পরিবেশ দূষণে বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহর বিশ্বের অবাসযোগ্য শহরের তালিকায় তলানিতে অবস্থান করে। ঢাকা শহর যেভাবে বেড়ে উঠেছে, তাতে ঢাকার সাধারণ নাগরিকদের জন্য প্রতিটি দিনই যেন একটি যুদ্ধ। জনবিরোধী ও পরিবেশ বিধ্বংসী নানা অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ঢাকার যে শোচনীয় অবস্থা তাতে এই শহরে মানুষ ও প্রাণিকুলের টিকে থাকার ন্যূনতম কোনো মানদণ্ড বজায় থাকেনি বলেও উল্লেখ করেন এই নগরপরিকল্পনাবিদ।
তিনি বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য যে অর্থনীতির সীমাহীন প্রবৃদ্ধির যে ধারণা পৃথিবীতে বিপর্যয় ডেকে এনেছে, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা রাষ্ট্রের নীতিমালা এবং পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় এখনো সেই ধারণার বাইরে চিন্তা করতে পারছেন না।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ গাছ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আমিরুল রাজিব বলেন, যানজট, জলজট, বায়ু দূষণ, উষ্ণায়ন, পরিবেশ দূষণে বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহর বিশ্বের অবাসযোগ্য শহরের তালিকায় তলানিতে অবস্থান করে। ঢাকা শহর যেভাবে বেড়ে উঠেছে, তাতে ঢাকার সাধারণ নাগরিকদের জন্য প্রতিটি দিনই যেন একটি যুদ্ধ। জনবিরোধী ও পরিবেশ বিধ্বংসী নানা অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ঢাকার যে শোচনীয় অবস্থা তাতে এই শহরে মানুষ ও প্রাণিকুলের টিকে থাকার ন্যূনতম কোনো মানদণ্ড বজায় থাকেনি।
আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, বর্তমানে আবাসন ব্যবসায়ীরাই পরিকল্পনা নিয়ন্ত্রণ করছে। স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকবার কারণে এটা পুরোপুরি অন্যায্য।
পরিকল্পনাবিদ সৈয়দ শাহরিয়ার আমিন বলেন, বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হলো কেন্দ্রীকরণের প্রবণতা— অর্থনীতি, বিচারব্যবস্থা সহ সবকিছুই রাজধানীকেন্দ্রিক। বর্তমান পরিকল্পনা জনকল্যাণের জন্য নয়, বরং একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্যই করা হচ্ছে। রাজধানীর মাটি শুধুই মুনাফার জন্যে নয়।
ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টের পরিচালক গাউস পিয়ারি বলেন, ঢাকা শহরে অসংখ্য মানুষ বসবাস করছে, কিন্তু তাদের চাহিদার কথা কেউ ভাবছে না— সবাই শুধু নিজের স্বার্থের দিকেই নজর দিচ্ছে। এলাকার মানুষ ও দায়িত্বশীলদের নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে একটি ড্যাপ তৈরির কথা ভাবা হলেও, তা বাস্তবে দেখা যায়নি।
হাউজ বিল্ডিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক প্রকৌশলী আবু সাদেক বলেন, ড্যাপের পরিবর্তন শহরের বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত করব। বাসযোগ্য ঢাকা গড়বার প্রচেষ্টার কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হল। অবিলম্বে এই উদ্যোগ বাতিলের আহ্বান জানাই।
এএসএস/এমএন