শহরজুড়ে দৃষ্টিদূষণ, ব্যানার-ফেস্টুনে ‘ঢাকা’ পড়েছে ঢাকা

শহর যেন নিজের রং হারিয়ে রাজনৈতিক প্রচারণা, ব্যবসায়িক বিজ্ঞাপন আর ব্যক্তিগত প্রচারণার স্তূপে ঢাকা পড়ে গেছে। শহরের আকাশ দিনে দিনে ছেয়ে গেছে রঙিন কাপড়, প্লাস্টিক আর কাগজের ভিড়ে। প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি যেদিকে তাকানো যায় সেখানেই ঝুলছে ব্যানার, ফেস্টুন ও নানা রঙের পোস্টার।
বিশাল প্রচারণা-প্রদর্শনীর ফলে নিজস্ব সৌন্দর্য হারানোর মধ্য দিয়ে রাজধানী শহর ঢাকা যেন ব্যানার-পোস্টারে ঢাকা পড়েছে। ফুটপাতের ওপরের ঝুলন্ত ফেস্টুনে সাধারণ মানুষের চলাচলও অনেক স্থানে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ট্র্যাফিক সিগন্যাল, বৈদ্যুতিক খুঁটি— সবকিছুতেই এখন সেঁটে আছে প্রচারণার চিহ্ন। শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা যতটুকু করা হয়, তার চেয়ে কয়েক গুণ গতিতে আবার নতুন দৃষ্টিদূষণ তৈরি হয়ে যাচ্ছে। নান্দনিকতা নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি, একেকটি ব্যানার ও পোস্টার খুলে ফেলার পর সেগুলোর অবশিষ্ট অংশ রাস্তায় পড়ে থাকে।
রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় এ প্রসঙ্গে কথা হয় পথচারী নাজমুল হকের সঙ্গে। তিনি একজন ব্যাংকার।
শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করা ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘মতিঝিল একটি বাণিজ্যিক এলাকা, ব্যাংক পাড়া। এখানে এমন কোনো সড়ক, অলিগলি নেই যেখানে যততত্র ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার সাঁটিয়ে সৌন্দর্য নষ্ট করা হয়নি। এমনকি শাপলা চত্বরের স্থাপনা পর্যন্ত দেখা যায় না এসব পোস্টারের কারণে। সিটি কর্পোরেশনের উচিত এসব অপসারণ করার পাশাপাশি এদের জরিমানা করা বা এমন কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা, যাতে করে কেউ পোস্টার-ব্যানার লাগানোর সুযোগ না পায়।’
ফার্মগেটের রাস্তায় চলাচলকারী পথচারী খাদেমুল ইসলামও একই ধরনের অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ‘ফার্মগেটে মনে হয় এমন কোনো স্থান নেই যেখানে এসব ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার লাগানো নেই। এতে মনে হয় ফার্মগেট এলাকা যেন রাজনৈতিক কার্যালয় অথবা প্রচারণা-বিজ্ঞাপনী জোন। এখানে যেমন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পোস্টার-ব্যানার-ফেস্টুন রয়েছে, তেমনি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রয়েছে বিজ্ঞাপনী পোস্টার-ব্যানার। এগুলো সব সরিয়ে শহরের সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে হবে সংশ্লিষ্টদের।’

এ চিত্র শুধু ফার্মগেট বা মতিঝিল এলাকার নয়, পুরো ঢাকা শহরের একই অবস্থা। পরিকল্পনাবিদদের মতে, যেখানে খুশি ব্যানার টাঙানোর এই প্রবণতা আধুনিক নগর ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সঠিক ব্যবস্থাপনা ছাড়া প্রচারণা চালালে তা শুধু সৌন্দর্য নষ্টই করে না বরং নগরজীবনে বিশৃঙ্খলাও বাড়ায়। অনিয়ন্ত্রিত পোস্টার-ব্যানারের বিরুদ্ধে আইনি কাঠামো থাকলেও শৃঙ্খলা অনুপস্থিত।
‘যত্রতত্র পোস্টার বা ফেস্টুন লাগানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার মতো স্পষ্ট আইন থাকলেও বাস্তবে তা-র প্রয়োগ তেমন দেখা যায় না। সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত স্থানের বাইরে কোনো পোস্টার লাগানোর কথা নয়; তবুও প্রতিদিনই নতুন নতুন প্রচারণা যুক্ত হচ্ছে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে।’
এর আগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এক গণবিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল, ‘অনুমোদন ছাড়া পোস্টার, ব্যানার ও দেয়াল লিখন আইনত নিষিদ্ধ। দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২-এর ধারা ৩ ও ৪ অনুযায়ী এসব কার্যক্রম অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। একই আইনের ধারা ৬-এ অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আইনের প্রয়োগ খুব একটা দেখা যায় না।’
একই ধরনের গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনও (ডিএনসিসি)। সংস্থাটি জানিয়েছিল, সৌন্দর্য নষ্ট করে শহরের বিভিন্ন জায়গায় দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগালে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
গণবিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল, ‘দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১২ এর ধারা ৩ ও ৪ মোতাবেক সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো নিষেধ। এ আইনের ধারা ৬ মোতাবেক অর্থ ও কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ অবস্থায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় যেসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি অবৈধভাবে দেয়ালে লিখেছেন বা পোস্টার লাগিয়েছেন তাদেরকে নিজ দায়িত্বে ও খরচে সব দেয়াল লিখন ও পোস্টার অপসারণ করে দেয়াল পুনরায় রঙ করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। এগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো অথবা যত্রতত্র ময়লা ফেলার সঙ্গে যেসব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে এ আইন মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

সার্বিক বিষয় নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার রাজনৈতিক প্রচারণার। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা এসব তুলতে গেলে, স্থানীয় প্রভাবশালীদের বাঁধার মুখে পড়তে হয়। আমরা চাই শহরের সৌন্দর্য যেন নষ্ট না হয়। কিন্তু সব সময় কর্মীরা এসব অপসারণ করতে পারে না। তবুও আমরা কাউকে ছাড় দেব না, শহরের সৌন্দর্য রক্ষায় এগুলো অপসারণ করতে আরও বেশি তৎপর হব। পাশাপাশি বিজ্ঞাপনী পোস্টার-ব্যানার-ফেস্টুনও অপসারণ শুরু হবে।’
গত আগস্ট মাসের শেষের দিকে ঢাকায় ২৫ স্থায়ী পোস্টার বোর্ড চালু করেছিল ডিএনসিসি। তারা ১০টি নতুন পোস্টার বোর্ড (আয়তন ৫ ফুট × ৮ ফুট) এবং সংস্কারকৃত ১৫টি বিদ্যমান বোর্ড (আয়তন ১৬-২৫ ফুট × ৫ ফুট) উদ্বোধন করে। প্রাথমিকভাবে শহরে বিভিন্ন স্থানে ২৫টি বোর্ড চালু করা হলেও পর্যায়ক্রমে সব ওয়ার্ড, গুরুত্বপূর্ণ মোড়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সামনে পোস্টার বোর্ড স্থাপন করা হবে বলেও সংস্থাটি জানিয়েছিল। কিন্তু, এর সুফল পাওয়া যায়নি। শহরের সর্বত্র যত্রতত্রভাবেই ব্যানার-ফেস্টুন লাগানো যেন অব্যাহত রয়েই গেছে।
তবে, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) গত মাসে নগরজুড়ে মোট এক লাখ ২৫ হাজার অবৈধ ব্যানার-ফেস্টুন অপসারণ করেছে। এ বিষয়ে ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, গত মাসে আমরা প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণ করেছি। অনুরোধ করছি দয়া করে শহরটিকে ব্যানার-ফেস্টুন দিয়ে আর নোংরা করবেন না। নগরকর্মীদের জন্য এটি অত্যন্ত কষ্টসাধ্য কাজ। শহর পরিচ্ছন্নতার জন্য আমাদের সব ধরনের কার্যক্রম অব্যাহত আছে, এগুলো অপসারণে কাজ করে যাচ্ছি।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১০টি অঞ্চলের ৫২টি ওয়ার্ডে পরিচালিত ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণ কার্যক্রমের পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, সম্প্রতি ডিএনসিসির অঞ্চল-৩ এ সর্বাধিক ২৯ হাজার ৪৪১টি ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণ করা হয়েছে। এছাড়া, অঞ্চল-২ থেকে প্রায় ২৫ হাজার, অঞ্চল-৪ থেকে ১৮ হাজার, অঞ্চল-৫ থেকে ১২ হাজার এবং অঞ্চল-৯ থেকে প্রায় ১১ হাজার ব্যানার ও ফেস্টুন উচ্ছেদ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে তাদের কার্যক্রম এখনো অব্যাহত আছে।
গতকাল (শনিবার) অবৈধ ব্যানার–ফেস্টুন উচ্ছেদ অভিযান সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন মোহাম্মদ এজাজ। এ সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বহুদিন ধরে অনুরোধ করছি অবৈধভাবে ব্যানার-ফেস্টুন লাগাবেন না। অনেকেই শুনছেন না। তাই আর অনুরোধ নয়, ইতোমধ্যে জরিমানা কার্যক্রম শুরু করেছি। এখন থেকে ব্যাপকহারে অবৈধ বিজ্ঞাপন ব্যানার পোস্টার স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে আর্থিক জরিমানা করা হবে।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ও নগরপরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যত্রতত্র পোস্টার বা ফেস্টুন শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করছে। এসব না লাগাতে স্পষ্ট আইন থাকলেও বাস্তবে তা প্রয়োগ তেমন দেখা যাচ্ছে না। এসব ব্যানার পোস্টার সাঁটানো রোধে সিটি কর্পোরেশনের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। পাশাপাশি আইন অনুযায়ী শাস্তির বিধান কার্যকর করতে হবে।
এএসএস/এমজে
