ইউরোপ যেতে চেয়েছিলেন বাবু, বাসার সামনেই কুপিয়ে হত্যা

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান ৩ নম্বর রোডে বাসার সামনেই এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয় বিল্লাল হোসেন ওরফে বাবু (২৬) নামে এক যুবককে। কিছুদিন পরেই ইউরোপে যাওয়ার কথা ছিল; পাসপোর্টও রেডি ছিল তার। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় বাবুকে। আর মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন তার বাবা আবুল কাশেম। প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী— হত্যার নেপথ্যে রয়েছে ইকবাল হোসেন সবুজের কাছ থেকে সোহেল নামে এক ফল ব্যবসায়ীর সুদে টাকা ধার নেওয়া।
সরেজমিনে ঘুরে ও অনুসন্ধানে জানা যায়, ইকবাল হোসেন সবুজ ঢাকা উদ্যান এলাকায় সুদের কারবার করেন। তিনি মানুষকে ঋণ দিয়ে মোটা অঙ্কের সুদ নেন। সোহেল নামে এক ফল ব্যবসায়ীকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ দেয় সবুজ। সেই টাকা নিয়ে সোহেলের সঙ্গে সবুজের দ্বন্দ্ব চলছিল। কয়েকদিন আগে সবুজ ওই সুদের টাকার জন্য সোহেলকে ধরে আনে। পরে আবুল কাশেম ঘটনার মধ্যস্থতা করে কয়েক দিনের সময় নিয়ে সবুজের কাছ থেকে সোহেলকে ছাড়িয়ে আনেন।
গতকাল সোমবার সেই সুদের টাকা সবুজকে দেওয়ার কথা ছিল সোহেলের। কিন্তু সোহেল তা দেয়নি। পরে, সোহেলকে ধরার জন্য সবুজ, রাজিব, মোহন, রুবেলসহ বেশ কয়েকজন ধাওয়া দেয়। পরে সোহেল দৌড়ে কাশেমের মুদি দোকানের সামনে ৩ নম্বর রোডে চলে যায়। সেখানে সবুজ, রাজিবসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কাশেমের কথা কাটাকাটি হয়, একপর্যায়ে তাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
এর কিছুক্ষণ পরে রাজিব, সবুজ, রুবেল, মোহন, মাছুমসহ আরও বেশ কয়েকজন ধারালো অস্ত্র নিয়ে বাসার সামনেই কাশেমকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। পরে তার ছেলে বাবা কাশেমকে বাঁচাতে এলে তাকেও এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা। মুহূর্তেই তারা দুজনকে কুপিয়ে জখম করে পালিয়ে যায়। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক বিল্লাল হোসেন বাবুকে মৃত ঘোষণা করেন। আর গুরুতর আহত অবস্থায় আবুল কাশেমকে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। সেখান থেকে তাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক; পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ঢাকা উদ্যান এলাকায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নিহত বাবুর মামা হানিফকে কুপিয়ে রাজিব, জোবায়ের ও রুবেল তিনজন ৮০ হাজার টাকা নিয়ে যায়। এই ঘটনায় তাদের তিনজনের নাম উল্লেখ করে মোহাম্মদপুর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছিলেন হানিফ। এ ঘটনার তদন্ত করছিলেন মোহাম্মদপুর থানার এসআই সাজ্জাদ। থানায় এই অভিযোগের ঘটনা নিয়েও রাজীবের সঙ্গে আবুল কাশেমের দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। এছাড়া, সুজন ও বিল্লাল পরিকল্পিতভাবে কাশেমকে একটি ধর্ষণের মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়। এ ঘটনা নিয়েও আবুল কাশেমের সঙ্গে তাদের পূর্বশত্রুতা ছিল।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, গতকাল সোমবার রাত ৭টা ৫৫ মিনিটের দিকে রাজিবসহ বেশ কয়েকজন ঢাকা উদ্যান ৩ নম্বর রোডের ডি ব্লকের সামনে যায়। যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধারালো অস্ত্র বের করে দুর্বৃত্তরা এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে কাশেমকে। পরে তার ছেলে বাঁচাতে এলে তাকেও কুপিয়ে মুহূর্তেই তারা সেখান থেকে চলে যায়। সিসিটিভি ফুটেজে রাজিব, রুবেল, মোহন, সবুজ, মাছুম, সজীব, বিল্লালসহ কয়েকজনকে চেনা যায়।
নিহত বাবুর মা পারভিন বলেন, আমার স্বামী একজন মুদি দোকানদার। সবুজ নামে একজন ৪ নম্বর রোডে আড্ডা দেয় এবং সে বিভিন্ন মানুষকে ঋণ দিয়ে চড়া সুদে টাকা আদায় করে। সোহেল নামে এক ফল ব্যবসায়ী সবুজের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নেয়। টাকা শোধ হয়ে গেলেও সোহেল সুদের পাওনা টাকা দিচ্ছিল না। পরে সোহেলকে সবুজের লোকজন রাজিব, মোহন, রুবেলসহ বেশ কয়েকজন ৪ নম্বর রোডে ধরে আনে। পরে আমার স্বামী কাশেম তাদেরকে একটু সময় নিয়ে দেন এবং পরবর্তী সময়ে ওই টাকা গতকাল দেওয়ার কথা ছিল।
তিনি বলেন, টাকা দিতে না পারায় সোহেলকে রাজিবসহ বেশ কয়েকজন ধাওয়া দেয়। দৌড়ে পালিয়ে আমার স্বামীর এখানে আসে। এরপর আমার স্বামী তাদের বাধা দেয়। বাধা দেওয়ার একপর্যায়ে রাজীবসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে ধস্তাধস্তি ও হাতাহাতি হয়। এর ঠিক আধাঘণ্টা পরে রাজিব, সবুজ, রুবেল, মোহন ও নাটা সুজনসহ আরও বেশ কয়েকজন ধারালো অস্ত্র নিয়ে বাসার সামনে এসে আমার স্বামীকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। পরে আমার ছেলে ঠেকাতে গেলে তাকেও এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে। আমার দশ বছরের মেয়ে তাদের পায়ে জড়িয়ে ধরলেও তারা আমার স্বামী ও ছেলেকে ছাড়েনি। পরে আহত অবস্থায় তাদেরকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেলে ছেলেকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।
তিনি আরও বলেন, আমার ভাইকে তারা একবার ঢাকা উদ্যান এলাকায় এলোপাতাড়ি কোপায় এবং তার কাছে থাকা ৮০ হাজার টাকাও নিয়ে যায়। পরে এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ দিলে এসআই সাজ্জাদ বলেন— আপনারা আসামিকে ধরে আমাকে ফোন দিয়েন। আর নাটা সুজন আমার স্বামীকে একটি মিথ্যা ধর্ষণের মামলায় জড়িয়ে দেয়। এ ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তারা সবাই একই গ্রুপের লোক।
বাবুর মা পারভিন আরও বলেন, আমার ছেলে আগে সৌদি আরব থাকত। সম্প্রতি তার পাসপোর্ট করানো হয়েছে, ভিসা এসেছে। তাকে ইউরোপে পাঠানো হবে। কিন্তু তার তো আর ইউরোপে যাওয়া হলো না। আমার সন্তানকে তারা কুপিয়ে মেরে ফেলল। আমার স্বামী বাঁচবে কি না মরবে, এখনো তাও জানি না।
এ ঘটনায় পারভিন বাদী হয়ে রাজিব, ইকবাল হোসেন সবুজ, রুবেল, মোহন, সুজন ওরফে নাটা সুজন ও ময়নুলের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত ১০-১২ জনের নামে মোহাম্মদপুর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
সোহেলের স্ত্রী স্বপ্না বলেন, আমার স্বামী সবুজের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিল। সে ঢাকা উদ্যান এলাকায় ফলের ব্যবসা করে। প্রতিদিন এক হাজার টাকা করে তাকে এক মাসে ত্রিশ হাজার টাকা শোধ করে আমার স্বামী সোহেল। আমাদের কাছে সে সুদের শুধু চার-পাঁচ হাজার টাকা পায়। কয়েকদিন আগে আমার স্বামীকে সবুজসহ কয়েকজন ধরে নিয়ে যায়। এরপর কাশেম ভাই সেটি সমাধান করে সময় নিয়ে দেন। গতকাল আমার স্বামীকে তারা ধাওয়া দিলে দৌড়ে কাশেম ভাইয়ের দোকানের সামনে যায়। এরপর রাজিব, সবুজসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে হাতাহাতি হয়। পরে তারা এসে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে কাশেম ভাই ও তার ছেলে বাবুকে গুরুতর আহত করে। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে বাবু মারা যায়।
এ ঘটনার পর থেকে পুলিশের পাশাপাশি র্যাব, ডিবি এবং সেনাবাহিনীর একাধিক টিম আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনা করছে। তবে, এখন পর্যন্ত আসামিদের কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।
তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার ইবনে মিজান বলেন, ঢাকা উদ্যান ৩ নম্বর রোডের ডি ব্লকে হামলায় কাশেম ও তার ছেলে বাবুকে কুপিয়ে জখম করে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। পরে মুমূর্ষু অবস্থায় দুইজনকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে ছেলে বাবুকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন এবং গুরুতর আহত অবস্থায় বাবা কাশেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ঘটনার পর থেকে পুলিশসহ একাধিক গোয়েন্দা টিম তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদেরকে খুব দ্রুত সম্ভব আইনের আওতায় আনা হবে।
এসএএ/এমজে
