অর্থ, পেশীশক্তি ও ধর্মের অপব্যবহারে অঙ্গীকার দাবি, ৫২ সুপারিশ টিআইবির

রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে জনস্বার্থের পাশাপাশি অর্থ, পেশীশক্তি এবং ধর্মের অপব্যবহার বিষয়ে দলগুলোর অবস্থান জনগণের কাছে পরিষ্কার করে নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করতে মোট ৫২টি সুপারিশ উপস্থাপন করেছে সংস্থাটি।
রোববার (৭ ডিসেম্বর) সংস্থাটির ধানমণ্ডি কার্যালয়ে “সুশাসিত, বৈষম্যহীন ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশের অঙ্গীকার: ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের ইশতেহার প্রণয়নে টিআইবির সুপারিশ” শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এই সুপারিশমালা উপস্থাপন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান।
সংবাদ সম্মেলনে সুপারিশমালা উপস্থাপনা করেন টিআইবির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মো. জুলকারনাইন।
নির্বাচন পরবর্তী সরকার পরিচালনায় দুর্নীতি প্রতিরোধ, জবাবদিহি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার অঙ্গীকার ইশতেহারে উল্লেখ করারও আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি।
এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, নারী-পুরুষসহ সকল জেন্ডার, শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধকতা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও জাতিগত সম-অধিকার, সম্প্রীতি ও সহঅবস্থান বিষয়ে দলগুলোর অঙ্গীকার বা প্রত্যয় জাতি প্রত্যাশা করে। একই সঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা, অভীষ্ট ও জুলাই সনদ পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার রাজনৈতিক দলগুলো কতটুকু পালন করবে ও গণভোটের বিষয়ে তাদের অবস্থান ইশতেহারে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশলগত প্রত্যয় ও পথরেখার উপাদানগুলো কি হবে, সে বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করা প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে জুলাই জাতীয় সনদের বাইরে থাকা সংবিধান সংস্কারসহ ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশমালা, যা নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা হয়েছে। তা যেন ধামাচাপা পড়ে না যায় সে লক্ষ্যে তাদের অঙ্গীকার ইশতেহারে ব্যক্ত করতে হবে। অন্যান্য সংস্কার কমিশন তথা স্থানীয় সরকার, গণমাধ্যম, নারী, স্বাস্থ্য ও শ্রম বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত সুপারিশসমূহ নিয়ে উল্লেখযোগ্য আলোচনা রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে নেই, এই বিষয়টি আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে, তাই তারা এগুলো সম্পর্কেও নিজ দলের অবস্থান পরিস্কার করবেন বলে আমরা আশা প্রকাশ করছি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিংস প্রতিবেদন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটিসহ অন্যান্য কমিটি ও টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের সুপারিশমালা সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান এবং জুলাই সনদসহ অন্যান্য সংস্কার কমিশনের ওপর ভিত্তি করে যে সকল ইতিবাচক অধ্যাদেশ জারি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, সেগুলো অব্যাহত রাখা ও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করতে হবে বলে মন্তব্য করে ইফতেখারুজ্জামান।
ড. জামান আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে সংঘটিত সকল হত্যাকা-, অপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করবে বলে জনগণ আশাবাদী। পাশাপাশি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও শহীদ পরিবারকে যথাযথ সহায়তা প্রদান এবং আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের অবস্থান পরিস্কার করতে হবে।’
টিআইবির সুপারিশমালায় সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে একটি সমন্বিত ও কার্যকর “দুর্নীতিবিরোধী জাতীয় কৌশলপত্র” প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই কৌশলপত্রে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতিবিরোধী দায়িত্ব ও কর্তব্য স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে তাদের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
টিআইবি’র সুপারিশের মধ্যে রয়েছে-
জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী সনদের আলোকে বেসরকারি খাতে ঘুষ লেনদেনকে স্বতন্ত্র অপরাধ হিসেবে আইনের আওতায় আনা এবং মানি লন্ডারিং বন্ধে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স ব্যবস্থাকে কার্যকর করা, বিএফআইইউ, এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, সিআইডি, বাংলাদেশ পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার সুপারিশ।
জনপ্রতিনিধিত্ব ও সরকারি কার্যক্রমে ব্যক্তিস্বার্থ, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধে “স্বার্থের দ্বন্দ্ব আইন” প্রণয়নেও সুপারিশ করেছে টিআইবি।
টিআইবির সুপারিশে রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য দলের কমিটি গঠন ও নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্ম, নারী, আদিবাসী, দলিত ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনে এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রার্থীর মনোনয়ন এবং বাস্তব অর্থে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও সুস্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য “জিরো-সাম পলিটিকস” পরিহার করার আহ্বান জানায় টিআইবি।
টিআইবির সুপারিশমালায় রাজনৈতিক দলগুলোকে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং দুর্নীতি ও বৈষম্যমুক্ত উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে, এবং সকল সরকারি ক্রয়, উন্নয়ন প্রকল্পে “ভ্যালু ফর মানি” নিশ্চিত করতে আইনি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে।
এছাড়া, টিআইবি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষায় আদিবাসী ও দলিতদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং তাদের ভূমি ও রাজনৈতিক অধিকারের বাস্তবায়ন দাবি করেছে।
শিক্ষা খাতে, একটি স্বাধীন শিক্ষা কমিশন গঠনের পাশাপাশি শিক্ষাক্রমের পর্যালোচনা ও সংস্কারের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। স্বাস্থ্যখাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় টিআইবি নিরপেক্ষ, স্বনামধন্য, স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত ও দক্ষ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংক কমিশন গঠন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিতে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিলুপ্তি, ঋণ জালিয়াতি ও প্রতারণাসহ ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত ব্যক্তি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তা ও পরিচালকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে।
একইসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা থেকে রাজনৈতিক ও গোষ্ঠীগণ স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অপসারণ এবং পুঁজিবাজারের অতীত অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত ও দায়ীদের শাস্তির মাধ্যমে একটি স্বাধীন, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক নিয়ন্ত্রণ কাঠামো গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়।
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সুরক্ষার ক্ষেত্রে, জলবায়ু ক্ষতিপূরণ দাবি করার পাশাপাশি, জলবায়ু তহবিলের স্বচ্ছতা এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
আরএম/এমএসএ