৮ দফা ঘোষণা দিয়ে জলবায়ু ন্যায্যতা সমাবেশের সমাপ্তি

বাংলাদেশের সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা (আইইপিএমপি) অবিলম্বে বাতিল এবং সব নতুন জীবাশ্ম জ্বালানি-ভিত্তিক প্রকল্প বন্ধের জোরালো দাবি উঠেছে ৩য় জলবায়ু ন্যায্যতা সমাবেশ-২০২৫ থেকে।
জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী ও দেশি-বিদেশি জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইইপিএমপি বাংলাদেশকে দীর্ঘমেয়াদে আমদানিনির্ভর কয়লা ও এলএনজি ব্যবস্থার মধ্যে আটকে দিচ্ছে, যা জলবায়ু সংকটের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে।
রোববার (১৪ ডিসেম্বর) ঢাকায় দুই দিনব্যাপী এই সমাবেশের সমাপনী দিনে জলবায়ু ন্যায্যতা, পরিবেশ সুরক্ষা ও জনগণের অধিকার বিষয়ে ৮ দফা ঘোষণা প্রকাশ করা হয়।
১৩ থেকে ১৪ ডিসেম্বর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে উপকূল, হাওর, চর ও বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে আসা জেলে, কৃষক, আদিবাসী জনগোষ্ঠী, নারী, যুব, পেশাজীবী ও শিক্ষার্থীসহ মোট ১,৯৪৫ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। অংশগ্রহণকারীরা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে জলবায়ু পরিবর্তন, শিল্পায়ন ও জীবাশ্ম জ্বালানির প্রভাব তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানে ৮ দফা ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এর সদস্য সচিব শরীফ জামিল। এতে সভাপতিত্ব করেন জলবায়ু ন্যায্যতা সমাবেশ-২০২৫ এর আহ্বায়ক ড. মুজিবুর রহমান।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়, আইইপিএমপি–এর পাশাপাশি মহেশখালী-মাতারবাড়ী উন্নয়ন উদ্যোগ (এমআইডিআই)–এর মতো মেগা শিল্প পরিকল্পনাগুলো বাংলাদেশের চরম জলবায়ু ঝুঁকি উপেক্ষা করে কয়লা ও এলএনজি-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। এতে একদিকে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে জ্বালানি আমদানির কারণে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ওপর বাড়ছে চাপ।
শরীফ জামিল বলেন, ‘আইইপিএমপি ও এমআইডিআই পরিকল্পনাগুলো বাংলাদেশের জলবায়ু বাস্তবতার সঙ্গে মৌলিকভাবে সাংঘর্ষিক। এগুলো ব্যয়বহুল আমদানিকৃত কয়লা ও এলএনজি নির্ভরতা বাড়ায়, ক্যাপাসিটি পেমেন্টের বোঝা চাপায় এবং জনগণকেন্দ্রিক নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক ভবিষ্যৎকে দুর্বল করে।’
তিনি আরও বলেন, বিদ্যমান বিদ্যুৎ চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করে অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বিপুল অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হচ্ছে, যা জনস্বার্থবিরোধী।
সমাবেশ থেকে সব নতুন জীবাশ্ম জ্বালানি-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বন্ধ, আইইপিএমপি ও এমআইডিআই মাস্টারপ্ল্যান বাতিল, বিদ্যমান কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক প্রকল্প ধাপে ধাপে বন্ধের জন্য সময়ভিত্তিক রোডম্যাপ ও অলস বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বন্ধ করে ‘বিদ্যুৎ নেই, পেমেন্ট নেই’ নীতি চালুর দাবি জানানো হয়।
ঘোষণাপত্রে সরকারকে জাতীয় জ্বালানি পরিকল্পনা পুনর্গঠন করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। এতে ব্যাটারি সংরক্ষণসহ সৌর বিদ্যুৎ, স্মার্ট গ্রিড এবং পর্যাপ্ত জাতীয় বাজেট বরাদ্দের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়।
প্রতিনিধিরা বলেন, জলবায়ু অর্থায়ন অবশ্যই ঋণ নয়, অনুদান হিসেবে দিতে হবে এবং শিল্পোন্নত দেশগুলোর ঐতিহাসিক নিঃসরণের দায় হিসেবে এটিকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তারা দ্রুত লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড কার্যকর করা এবং বাংলাদেশসহ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর অভিযোজন খাতে অর্থায়ন বৃদ্ধির দাবি জানান।
সমাবেশে নদীভাঙন, লবণাক্ততার বিস্তার, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, বায়ু ও পানি দূষণ, বন উজাড় এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে আলোচিত হয়।
অংশগ্রহণকারীরা বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানির সম্প্রসারণ ও অপরিকল্পিত শিল্পায়ন এসব সংকটকে আরও তীব্র করছে এবং মানুষের জীবিকা ধ্বংস করছে।
সুন্দরবনসহ অন্যান্য ম্যানগ্রোভ বন সংরক্ষণ, দূষিত নদী পুনরুদ্ধার, শিল্প দূষণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং জ্বালানি ও অবকাঠামো প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ভূমিদখল ও দুর্নীতির জন্য জবাবদিহি নিশ্চিতের দাবিও উঠে আসে।
ফসিল ফুয়েল নন-প্রোলিফারেশন ট্রিটি ইনিশিয়েটিভের কৌশলগত উপদেষ্টা হারজিৎ সিং বলেন, ‘জলবায়ু ন্যায্যতা কেবল দেশগুলোর মধ্যকার বিষয় নয়; এটি দেশের ভেতরের বৈষম্য এবং আমরা যে উন্নয়ন মডেল বেছে নিচ্ছি, তার সঙ্গেও জড়িত। এখন সময় এসেছে গ্লোবাল নর্থের ধ্বংসাত্মক উন্নয়ন পথ প্রত্যাখ্যান করার।’ তিনি জাতীয়, আঞ্চলিক ও সহযোগিতা জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, প্রতিটি সিদ্ধান্তে মানুষ ও প্রকৃতিকে কেন্দ্রে রাখতে হবে।
সমাবেশের সহ-আহ্বায়ক এম এস সিদ্দিকী বলেন, ‘রামপাল প্রকল্পসহ যেসব প্রকল্পের বিরুদ্ধে আমরা আপত্তি জানিয়েছিলাম, আজ তার ক্ষতিকর প্রভাব স্পষ্ট। তরুণদের সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অর্থবহভাবে যুক্ত করা জরুরি। মানবাধিকার ঘোষণায় স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আইনি পথেও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে পারে।’
তৃতীয় জলবায়ু ন্যায্যতা সমাবেশ-২০২৫ এর আয়োজন করে ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)। জাতীয় সহ–আয়োজকদের মধ্যে ছিল ব্রাইটার্স, ব্রতী, সিপিআরডি, কোস্ট ফাউন্ডেশন, ক্রেসল, মিশন গ্রিন বাংলাদেশ, ওএবি ফাউন্ডেশন ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের মধ্যে ছিল এপিএমডিডি, ফসিল ফুয়েল নন-প্রোলিফারেশন ট্রিটি ইনিশিয়েটিভ, ফসিল ফ্রি জাপান, এলডিসি ওয়াচসহ বিভিন্ন সংগঠন।
আয়োজকরা জানান, ৮ দফা জনগণের এই ঘোষণা সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে জমা দেওয়া হবে। তাদের আশা, এটি জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভর জ্বালানি পরিকল্পনার বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হবে এবং বাংলাদেশে একটি ন্যায়ভিত্তিক, নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর ও জনগণকেন্দ্রিক রূপান্তরের পথ তৈরি করবে।
টিআই/বিআরইউ