রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দেবে যুক্তরাষ্ট্র, আশা সরকারের
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেছে। মামলা হয়েছে, প্রায় এক যুগ হতে চলল রায়ও ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু এখনও আত্মস্বীকৃত সব খুনির বিচারের রায় কার্যকর করতে পারেনি সরকার। খুনিদের মধ্যে ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলেও পলাতক পাঁচজনকে ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিষয়টি ঝুলে আছে অনেকদিন।
পলাতক পাঁচ খুনির মধ্যে এ এম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরী কানাডায় আছেন। বাকি তিনজন শরিফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন খান ও খন্দকার আব্দুর রশিদ কোথায় আছেন সে বিষয়ে সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।
খুনি রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনতে কয়েক বছর ধরে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা থেকে ইতিবাচক সাড়া মিলছে না। চেষ্টা তদবিরের এ পর্যায়ে সরকারের ভাষ্য, কানাডা নূর চৌধুরীকে ফেরত দিতে রাজি না হলেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাওয়া যাবে রাশেদ চৌধুরীকে।
যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় অবস্থান করা দুই আত্মস্বীকৃত খুনিকে ফেরানোর কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর আইনি প্রক্রিয়া চলমান আছে
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় অবস্থান করা দুই আত্মস্বীকৃত খুনিকে ফেরানোর কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর আইনি প্রক্রিয়া চলমান আছে।
খুনিদের দেশে ফেরানোর অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের আইনি প্রক্রিয়া চলমান আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা কোনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে থাকা খুনি রাশেদ চৌধুরীকে নিয়ে আমরা কিছুটা আশাবাদী। কারণ, ও (রাশেদ চৌধুরী) যে মিথ্যা তথ্য দিয়ে দেশটির নাগরিকত্ব নিয়েছে, সেটির রিভিউ হচ্ছে। বিষয়টি যেহেতু সে দেশের আদালতের, তাই আমরা কোনো চাপও দিতে পারছি না।’
মোমেন আরও বলেন, ‘কানাডা তো একগুঁয়ে হয়ে আছে। আমরা কানাডাকে বলেছি, তোমরা সব খুনিদের আশ্রয়স্থল করে রাখবা নাকি! এটি খু্ব দুঃখজনক। খুনিকে তোমরা ফেরত দাও।’
গত বুধবার (১১ আগস্ট) কানাডার আন্তর্জাতিক উন্নয়নমন্ত্রী কারিনা গোল্ডের সঙ্গে ভার্চুয়ালি বৈঠক করেন ড. মোমেন। বৈঠকে কানাডার উন্নয়নমন্ত্রীর কাছে নূর চৌধুরীকে ফেরত চান তিনি। মোমেন বলেন, ‘আমি তাকে বলেছি, খুনিকে ফেরত দিন। জবাবে তিনি জানালেন, তারা আমাদের জন্য সমব্যথী; কিন্তু কানাডার সাংবিধানিক নিয়ম বাতিল না হলে তাকে ফেরত পাঠানো কঠিন হবে।’
বৃহস্পতিবার (১২ আগস্ট) বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক গণমাধ্যমকে জানান, বঙ্গবন্ধুকে খুনের দায়ে সর্বোচ্চ আদালত থেকে যারা সাজাপ্রাপ্ত হয়ে পলাতক রয়েছেন, তাদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকরের ব্যাপারে সরকার বদ্ধপরিকর। শুধু সরকার নয় আওয়ামী লীগ যতক্ষণ থাকবে, আমার মনে হয় বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর একজন অনুসারী থাকলেও এই হত্যাকারীদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর হবে। খুনিদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলমান। যতই সময় লাগুক না কেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের রায় কার্যকর করা হবে। তাদের ধরে আনতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
খুনি রাশেদ চৌধুরী ব্রাজিল থেকে ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। ২০০৪ সালে দেশটিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পান তিনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এলে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ করে। কিন্তু ফাঁসির আসামি বলে তাকে ফেরত দিতে অনীহা দেখায় যুক্তরাষ্ট্র।
রাশেদকে ফেরত দেওয়ার জন্য ২০১৮ সালে দু’বার এবং ২০২০ সালে আরও একবার সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর সঙ্গে একাধিক বৈঠকে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর দাবি তুলেছিলেন। ২০১৯ সালে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের ভারপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অ্যালিস ওয়েলসের সঙ্গে এক বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে রাশেদ চৌধুরীর বিচারের নথিপত্র চেয়েছে ওয়াশিংটন।
ঢাকার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে গত বছরের মাঝামাঝিতে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা রাশেদ চৌধুরীকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিষয়টি পর্যালোচনার উদ্যোগ নেয় দেশটির বিচার বিভাগ। এর মধ্যেই দেশটির ক্ষমতার পালাবদল হয়ে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। সর্বশেষ, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন। দেশে ফিরে মোমেন জানান, রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফেরানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকারের সঙ্গে আলাপ করেছেন।
সর্বশেষ, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন। দেশে ফিরে মোমেন জানান, রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফেরানোর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকারের সঙ্গে আলাপ করেছেন
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোররাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের ১৮ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সে সময় দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। পরবর্তীতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে হত্যাকারীদের বিচারের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ঘটনার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা আসলে প্রথমবারের মতো ওই ঘটনায় মামলা দায়ের হয়। ১৯৯৮ সালে হত্যার দায়ে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ২০০০ সালে হাইকোর্টে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ২০০৯ সালে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখলে আসামিরা রিভিউ আপিল করেন। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি রিভিউ আপিল খারিজ করা হয় এবং পরদিন ২৮ জানুয়ারি পাঁচ খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
১০ বছর পর ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল খুনি আবদুল মাজেদের ফাঁসিও কার্যকর করা হয়। তাকে ভারত থেকে গ্রেফতার করা হয়। ২৪ বছর তিনি ভারতের কলকাতায় লুকিয়ে ছিলেন। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ১২ খুনির একজন আজিজ পাশা ২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যান।
এনআই/ওএফ/জেএস/এমএআর/