ক্রমবর্ধমান দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবিলায় যুব সমাজকে সম্পৃক্ত করতে হবে

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমবর্ধমান দুর্যোগ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। এসব ঝুঁকি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক নানা উদ্যোগের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারেরও রয়েছে বিভিন্ন নীতি-কৌশল। তবে দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য স্থানীয় পর্যায়ে যে কমিটিগুলো রয়েছে, সেগুলো সব জায়গায় কার্যকর নয়। রয়েছে পারস্পরিক সমন্বয়হীনতা।
এসব কার্যক্রমে এলাকার যুব সমাজকে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রেও নেই কার্যকর উদ্যোগ। ঝুঁকি মোকাবিলায় নির্মিত অবকাঠামোগুলো নিয়মিত সংস্কার না হওয়ায় বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি বেড়েই চলেছে। তাই দুর্যোগ সহিষ্ণু অবকাঠামো নির্মাণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলো কার্যকর করা এবং সেগুলোতে যুব প্রতিনিধিদের সংযুক্ত করা, নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া, ব্যাপক বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে সবুজ বেষ্টনী বাড়ানো এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করে সে অনুযায়ী যথাযথ বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
বৃহস্পতিবার (২৬ আগস্ট) অক্সফ্যাম বাংলাদেশের সহযোগিতায় ওয়েভ ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘ক্রমবর্ধমান দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকারি ব্যবস্থাপনা ও যুব সমাজ’ শীর্ষক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব বলেন।
ওয়েবিনারে অর্থনীতিবিদ ও পিকেএসএফের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান। বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরিন এবং লেখক ও গবেষক গওহার নঈম ওয়ারা।
ওয়েবিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ওয়েভ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মহসিন আলী।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, আমাদের দেশে যেকোনো দুর্যোগে যুবরাই সর্বপ্রথম এগিয়ে আসে ও ভূমিকা রাখে, যা পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সরকারি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি যুব সমাজকে সর্বদা সম্পৃক্ত করে থাকে। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে যুবদের সম্পৃক্ততা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, আমাদের মোট জনসংখ্যার ৩৭ শতাংশ যুব, যাদের বয়স ১৫-৩৫ এর মধ্যে। দেশের উন্নয়নে যুবরা বিরাট অবদান রাখছে। তিনি ওয়ার্ড, ইউনিয়ন এবং উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিতে যুবদের অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। একইসঙ্গে এ বিষয়ে দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেন।
সভাপতির বক্তব্যে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, শুধুমাত্র দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নয়, বরং সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যুবদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। যাতে তারা নিজেদের পাশাপাশি দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে অবশ্যই তাদের মানবিক মূল্যবোধও সৃষ্টি করতে হবে। একইসঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে স্থানীয় জনগণ ও প্রতিনিধিকে সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন।
ওয়েবিনারে অধ্যাপক ড. মাহবুবা নাসরিন বলেন, তিন দশকের গবেষণায় দেখা যায়, দুর্যোগ ঝুঁকি প্রশমনে বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান হারে অগ্রসর হচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসূচিতে যুবদের সম্পৃক্ততা রোল মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য যুবদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়াতে হবে। এবারই প্রথম দুর্যোগ বিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলীতে যুবদের যুক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। যা তাদের দক্ষতার পাশাপাশি নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাবে।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে মহসিন আলী বলেন, অতি সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াসের’ প্রভাবে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, বরগুনা, বরিশাল, খুলনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে, বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে, গৃহহারা হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। এসব ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে উপকূল অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষ প্রতিবছরই আক্রান্ত হয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেন, হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল, পুকুর ও মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়, গাছপালা উপড়ে যায়, বাড়ি-ঘর ভেঙে পড়ে, জলোচ্ছ্বাসের ফলে লবণাক্ত পানিতে কৃষি জমি প্লাবিত হয়, শত শত মাইল রাস্তাসহ বেড়িবাঁধ, সুইচগেট, ব্রিজ-কালভার্ট এবং বিদ্যালয়ের ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব ক্ষতি উপকূল অঞ্চলের মানুষ কখনওই পরিপূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে পারে না। সরকারের পক্ষ থেকে দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন উদ্যোগ ও বাস্তবায়নের নির্দেশনা সত্ত্বেও মাঠ পর্যায়ের বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, দুর্যোগ বিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলী অনুযায়ী দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড পর্যায়ে কোনো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন হয়নি; অধিকাংশ ইউনিয়নে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠিত হয়নি, আবার যেগুলো রয়েছে সেগুলোর কার্যকারিতা নেই।
এছাড়া উপজেলা ও জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকলেও নিয়মিত (দুর্যোগের সময় ছাড়া) কার্যক্রম নেই এবং ওয়ার্ড থেকে জেলা পর্যায় পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। তাই কমিটিগুলোর কার্যকারিতা নিশ্চিত করে ক্রমবর্ধমান দুর্যোগ ঝুঁকি মোকাবিলায় সরকার ও রেডক্রিসেন্টের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি)’ ভলেন্টিয়ারদের সঙ্গে আরও বেশি যুবদের সম্পৃক্ত করার আহ্বান জানান তিনি।
আরএইচটি/এসএসএইচ