‘কিশোর বয়সেই বঙ্গবন্ধু নেতাজির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন’

উপমহাদেশে মানব মুক্তির জন্য যে মহান মানুষরা সংগ্রাম করেছেন তাদের মধ্যে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম সবার আগে আসে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি।
তিনি বলেন, যেভাবে নেতাজি ঔপনিবেশিক শাসন শোষণের কবল থেকে ভারতবর্ষের মানুষকে মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নিয়েছিলেন, ঠিক একইভাবে বঙ্গবন্ধুও বেনিয়া এবং হানাদার পাকিস্তানি শাসকদের কবল থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করার জন্য সশস্ত্র জনযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন।
তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ে অন্তত তিনবার নেতাজির কথা বলেছেন। অর্থাৎ কিশোর বয়সেই বঙ্গবন্ধু নেতাজির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
শনিবার (২৩ জানুয়ারি) অনলাইনে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত ‘নেতাজী ও বঙ্গবন্ধু: ভারতবর্ষের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক এক আলোচনায় মন্ত্রী এ কথা বলেন। ২৩ জানুয়ারি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মদিন এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আলোচনা সভাটির আয়োজন করা হয়।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে মহাত্মা গান্ধী অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে বিশ্বাস করতেন উল্লেখ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, নেতাজী বেছে নিয়েছিলেন সশস্ত্র সংগ্রামের পথ। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য সাফল্যের সঙ্গে মহাত্মা গান্ধী ও নেতাজীর দুই ধারার সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। মানুষের জন্য নেতাজি এবং বঙ্গবন্ধুর যে ত্যাগ ও আত্মবলিদান তা কোনোভাবেই একটি আলোচনায় বলে শেষ করা যাবে না। এ দুজন মহান নেতার জীবন ও আদর্শ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে আমাদের সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। মানব মুক্তির পথ আরও প্রশস্ত করতে হবে।
সভায় ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী যুক্ত হয়ে বলেন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনস্বীকার্য ক্যারিশমা এবং তাদের ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা যুগ যুগ ধরে ভারতীয় ও বাংলাদেশিদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে। আজাদ হিন্দ ফৌজ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে নেতাজির বীরত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিল।
টিকার প্রসঙ্গ টেনে হাইকমিশনার বলেন, আজ ভারত ও বাংলাদেশ কেবল উন্নয়নের নিবিড় অংশীদার নয়, আমরা মানব মুক্তির অভিন্ন সংগ্রামেরও অংশীদার। ‘প্রতিবেশীই প্রথম’ নীতিমালায় ভারত, নিজেদের তৈরি কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনের ২০ লাখ ডোজ বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী কোভিড মহামারি মোকাবিলায় একসঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।
নির্মূল কমিটির সভাপতি লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বলেন, ভারতের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অতুলনীয় বীরত্ব ও আত্মত্যাগ ৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং অন্যান্য রচনা ও ভাষণে উল্লেখ করেছেন কিভাবে অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এবং সূর্য সেন, প্রীতিলতা, বাঘা যতীন প্রমুখ অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা তাকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।
তিনি আরও বলেন, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর রাজনৈতিক দর্শন ছিল গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও একই দর্শনের বিশ্বাস করতেন। যা প্রতিফলিত হয়েছে দুই ভ্রাতৃপ্রতিম রাষ্ট্রের সংবিধানে। বঙ্গবন্ধু তার ১০ জানুয়ারির (১৯৭২) ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছেন, দুই দেশের নীতি ও আদর্শের এ মিল হচ্ছে বিশ্বশান্তির জন্য। সমগ্র বিশ্ব আজ ধর্ম, বর্ণ, জাতিসত্তার নামে যুদ্ধ, সন্ত্রাস ও সংঘাতে আক্রান্ত। ১৯৭১-এ পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ নিরস্ত্র নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছিল ইসলাম ও পাকিস্তান রক্ষার দোহাই দিয়ে। বাংলাদেশ এই গণহত্যাকারীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও পাকিস্তান এখন পর্যন্ত দায় অস্বীকার করছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির যে উদ্যোগ নিয়েছে আমরা আশা করব স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ভারত এ ক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতা করবে। আমাদের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি গণহত্যাকারীদের বিচারের পথ সুগম করবে এবং ভবিষ্যতের গণহত্যাকে নিরুৎসাহিত করবে। ৭১-এর গণহত্যার জন্য পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিচার না হওয়ার কারণে সেদেশে এখনও বেলুচ, সিন্ধি ও পশতুন জাতিসত্তার ওপর জাতিগত নিধন ও গণহত্যা অব্যাহত রয়েছে।
আলোচনায় আরও অংশগ্রহণ করেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর শৈশবের বন্ধু অধ্যাপক ক্ষেত্রেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র অধ্যাপক মহেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মুখার্জি তদন্ত কমিশনের অন্যতম সাক্ষী ও কলকাতা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক নন্দলাল চক্রবর্তী, নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজের গবেষক ও কলকাতার শ্রী শিক্ষায়তন কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক মৈত্রেয়ী সেনগুপ্ত, নির্মূল কমিটির সহ সভাপতি ও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্যতম অধিনায়ক লোকমান খান শেরওয়ানীর পৌত্রী শিক্ষাবিদ মমতাজ লতিফ, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ সেলিম ও নির্মূল কমিটি যশোর শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সাংবাদিক সাজেদ রহমান।
এইচএন/এমএইচএস