করোনায় দারিদ্র্যের হার বেড়ে দ্বিগুণ

মহামারি কোভিড-১৯ এর প্রভাবে দেশে দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ বেড়েছে বলে দাবি করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। তাদের তথ্য অনুযায়ী, শহরাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালে ছিল ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১৮ সালে ছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। করোনাকালীন সময়ে ২০২০ সালে এই হার বেড়ে হয়েছে ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ।
শানিবার (২৩ জানুয়ারি) ‘দারিদ্র্য ও জীবিকার ওপর কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাবঃ সানেমের দেশব্যাপী জরিপের ফলাফল’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এ দাবি করা হয়। জরিপের ফল উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। এতে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান এবং অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।
করোনাকালীন সময়ে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ, ২০১৮ সালে জিইডি-সানেমের জরিপে যা ছিল ২১ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২০১৬ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা জরিপ অনুসারে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ...
জরিপের ফল উপস্থাপনের সময় সেলিম রায়হান বলেন, এই জরিপের মূল উদ্দেশ্য ছিল কোভিডের আগের সময়ের সঙ্গে কোভিড পরবর্তী সময়ে দারিদ্র্য, বৈষম্য ও কর্মসংস্থানের স্বরূপ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া। ২০১৮ সালে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সঙ্গে সানেমের করা জরিপের মধ্যে থেকে ৫ হাজার ৫৭৭টি খানার ওপর এই জরিপটি ফোন কলের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ২০২০ সালের ২ নভেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশব্যাপী জরিপটি পরিচালিত হয়।
কোভিডের কারণে যে ক্ষতি হলো এটি কি স্বল্পমেয়াদি, নাকি এত বছরের অগ্রগতির ওপরে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ল, সেটি ব্যাখ্যার বিষয়। এটি নির্ভর করবে ক্ষতির ধরণ কেমন, কোন খাত কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং সরকার যে জরুরি পদক্ষেপ নিল তা কতটুকু পর্যাপ্ত তার ওপর। আয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যারা আছেন তাদের বিষয়েও গবেষণা হওয়া দরকার
ড. এম এম আকাশ
জরিপের তথ্যানুযায়ী, করোনাকালীন সময়ে সার্বিক দারিদ্র্যের হার (আপার পোভার্টি রেট) বেড়ে হয়েছে ৪২ শতাংশ, ২০১৮ সালে জিইডি-সানেমের জরিপে যা ছিল ২১ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২০১৬ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা জরিপ অনুসারে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। বিবিএস এর খানা জরিপ অনুসারে ২০১৬ সালে গ্রামাঞ্চলের সার্বিক দারিদ্র্য ছিল ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ, ২০১৮ সালের জিইডি-সানেম জরিপ অনুসারে যা ছিল ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ, করোনাকালীন সময়ে ২০২০ সালে এই হার বেড়ে হয়েছে ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ। শহরাঞ্চলে সার্বিক দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালে ছিল ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১৮ সালে ছিল ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। করোনাকালীন সময়ে ২০২০ সালে এই হার বেড়ে হয়েছে ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ।
চরম দারিদ্র্যের হারের (লোয়ার পোভার্টি রেট) ক্ষেত্রে ২০১৬ সালে বিবিএস এর খানা জরিপ অনুসারে এই হার ছিল জাতীয়ভাবে ১২ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১৮ সালে জিইডি-সানেম জরিপ অনুসারে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ, তবে ২০২০ সালে মহামারির প্রভাবে এই হার বেড়ে হয়েছে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে চরম দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালে ছিল ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০১৮ সালে ১১ দশমিক ২ শতাংশ এবং মহামারির সময়ে ২০২০ সালে গ্রামাঞ্চলে চরম দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ। শহরাঞ্চলে চরম দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালে ছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৬ দশমিক ১ শতাংশ, কিন্তু ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে ১৯ শতাংশ।
নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যে ধরনের উদ্যোগ বা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার জরুরি সেটি আমরা দেখছি না, যদিও করোনা মোকাবিলার পাশাপাশি এই উদ্যোগগুলো নেওয়া সম্ভব
ড. ফাহমিদা খাতুন
২০২০ সালে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বরিশালে ছিল ২৯ দশমিক ৩ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৩৫ দশমিক ১ শতাংশ, ঢাকায় ৩৮ দশমিক ৪ শতাংশ, খুলনায় ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৪৬ দশমিক ২ শতাংশ, রাজশাহীতে ৫৫ দশমিক ৫ শতাংশ, রংপুরে ৫৭ দশমিক ৩ শতাংশ এবং সিলেটে ৩৫ শতাংশ।
মহামারির ফলে কাজ হারানো, পারিশ্রমিক না পাওয়া, কর্মক্ষেত্র বন্ধ হওয়াসহ বিভিন্ন কর্মসংস্থান-সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কেবল ১৭.৩ শতাংশ পরিবারের দাবি ছিল যে তাদের সদস্যরা আগের মতো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে পেরেছে। ৫৫.৯ শতাংশ পরিবার দাবি করেছে যে কাজ থাকা সত্ত্বেও তাদের আয় হ্রাস পেয়েছে, ৮.৬ শতাংশ দাবি করেছে তারা কাজ হারিয়েছে, ৭ শতাংশের কাজের সময় হ্রাস পেয়েছে এবং ৩৩.২ শতাংশ বলেছে তাদের কাজ শুরু হওয়ার পরে কিছু সময়ের জন্য বন্ধ থেকে আবার শুরু হয়েছে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবরের মধ্যে, সব ধরনের কর্মসংস্থানে গড় আয় হ্রাস পেয়েছে, যা স্ব-নিযুক্তদের জন্য ৩২ শতাংশ, বেতনভিত্তিক কর্মীদের জন্য ২৩ শতাংশ, দিনমজুরের জন্য ২৯ শতাংশ এবং অন্যদের জন্য ৩৫ শতাংশ।
ড. এম এম আকাশ বলেন, কোভিডের কারণে যে ক্ষতি হলো এটি কি স্বল্পমেয়াদি, নাকি এত বছরের অগ্রগতির ওপরে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ল, সেটি ব্যাখ্যার বিষয়। এটি নির্ভর করবে ক্ষতির ধরণ কেমন, কোন খাত কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং সরকার যে জরুরি পদক্ষেপ নিল তা কতটুকু পর্যাপ্ত তার ওপর। আয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যারা আছেন তাদের বিষয়েও গবেষণা হওয়া দরকার, যা দেশব্যাপী জরিপে সাধারণত উঠে আসে না। এসময় তিনি দেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে পুনরুদ্ধারের জন্য শিক্ষাখাতকে যত দ্রুত সম্ভব চালু করা, স্বাস্থ্যখাতে ভর্তুকি দেওয়া, কর্মসংস্থানের পরিবর্তনগুলো স্বীকার করে ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন।
পুনরুদ্ধারের আশা আমরা দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু বেশকিছু জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে পুনরুদ্ধার এখনও চ্যালেঞ্জিং। ৩২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য মোকাবিলার জন্য আগের সঞ্চয় ব্যবহার করছেন। আবার অনেককে খাদ্যতালিকায় অনিচ্ছাকৃত পরিবর্তন আনতে হচ্ছে
ড. সায়মা হক বিদিশা
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, মধ্যম থেকে দীর্ঘমেয়াদি পর্যায়ে দারিদ্র্যের ওপর প্রভাব পড়ছে এবং কোভিড-১৯ এর আগের দারিদ্র্য বিষয়ক অর্জনগুলো কোভিড-১৯ এর প্রভাবে উল্টে যাবে, সেই ধারণাটি আরও জোরালো হয়েছে এই সমীক্ষার মাধ্যমে। স্বাভাবিক সময়েও আয় বৈষম্য, সম্পদ বৈষম্য ও ভোগ বৈষম্য বজায় ছিল, অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল অসম। এই কঠিন সময়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে দরিদ্রদের জন্য যথেষ্ট উপায় নেই, আর যারা সচ্ছ্বল তাদের ওপর তেমন প্রভাব পড়ে না। কাজেই এই অসাম্য থেকে হয়ত আমরা খুব তাড়াতাড়ি মুক্তি পাব না। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যে ধরনের উদ্যোগ বা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার জরুরি সেটি আমরা দেখছি না, যদিও করোনা মোকাবিলার পাশাপাশি এই উদ্যোগগুলো নেওয়া সম্ভব।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দারিদ্র্যের ভৌগোলিক আওতা ছড়িয়ে পড়েছে, গ্রামেও যে হারে দারিদ্র্য বেড়েছে শহরেও সেই একই হারে বেড়েছে। আবার যেখানে আগে দারিদ্র্য কম ছিল সেখানেও ব্যাপক বেড়েছে, যেখানে বেশি ছিল সেখানেও ব্যাপক বেড়েছে। দারিদ্র্যের বহুমুখী ধারণা, যেমন শিক্ষা-চিকিৎসায় প্রভাব, সে বিষয়গুলোও উঠে এসেছে। শিক্ষায় দারিদ্র্য বেড়েছে, শিক্ষায় ব্যয় কমেছে, বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থায় বেশিরভাগই অংশ নিতে পারছে না। বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থা আগের শিক্ষা ব্যবস্থার তুলনায় কতটা কম কার্যকর সেটিও জানতে পারলে আরও ভালো হত। সঙ্গত কারণেই দেশব্যাপী জরিপে অতি ধনীদের আওতাভুক্ত করার সুযোগ হয় না।
ড. সায়মা হক বিদিশা বলেন, একটি বিশাল সংখ্যক মানুষ আছেন যারা দারিদ্র্যরেখার ওপরে ছিলেন, কিন্তু কোভিডের আঘাতে দারিদ্র্যরেখার নিচে নেমে আসার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, অর্থাৎ তারা দরিদ্র না হয়েও দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে রয়েছেন। পুনরুদ্ধারের আশা আমরা দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু বেশ কিছু জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে পুনরুদ্ধার এখনও চ্যালেঞ্জিং। ৩২ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্য মোকাবিলার জন্য আগের সঞ্চয় ব্যবহার করছেন। আবার অনেককে খাদ্যতালিকায় অনিচ্ছাকৃত পরিবর্তন আনতে হচ্ছে, এতে করে দীর্ঘমেয়াদে পুষ্টি ও সুস্বাস্থ্যের ওপর আঘাত থেকে যাবে, যদি তারা প্রয়োজনীয় সহায়তা না পান। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এই বিষয়গুলো আরও বেশি মাথায় রাখা প্রয়োজন।
এসআই/জেডএস