টিপ পরছোস ক্যান : ব্যক্তি স্বাধীনতা কোথায়?

Shimul Yousuf

০৪ এপ্রিল ২০২২, ১১:৪৮ এএম


টিপ পরছোস ক্যান : ব্যক্তি স্বাধীনতা কোথায়?

ছবি : সংগৃহীত

আমার সংগ্রহে যত টিপ আছে তা এক জীবনেও পরে শেষ করা যাবে না। আমার টিপ ছাড়া কপাল কেউ দেখেছে কি না সন্দেহ আছে। জীবনে প্রথম কপালে টিপ দিয়ে দিল আমার মা। বড়দা বেশি সাজগোজ কখনোই পছন্দ করতেন না। কিন্তু টিপের বেলায় ছিলেন উদার। তিনি বলতেন চোখে কাজল আর কপালে টিপ এটাই বাঙালি মেয়েদের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়।

টিপ পরি আমি আমার মতো করে। কখনো একটা, কখনো দুই রঙের দুটো, আবার ছোট বড় মিলিয়ে তিনটাও হয়ে যায়। টিপ নিয়ে রাজনীতি বা ধর্ম আসলো কীভাবে? একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, মেয়েদের মাথায় হিজাব নামক মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হলো

এই সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের সুযোগ নিয়ে কাজটা খুব সুচারুভাবে সম্পন্ন করে ফেলল তারা। তারা কারা? যদি জানতে চান তবে আমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বললে কিছুটা আঁচ করতে পারবেন।

তখন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন চলছে। হ্যাঁ-না ভোট হচ্ছে। নজরুল সংগীত গাইবার জন্য আমার বিটিভিতে ডাক আসলো। আমি সবসময় বাসা থেকেই তৈরি হয়ে যাই। সেদিনও এর ব্যতিক্রম ছিল না। শাড়ির সাথে সবসময়ই আমি বড় টিপ পরি।

...প্রচুর বিরক্তি নিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলার চেষ্টা করলো, এই সব টিপ ফিপ পরে অনুষ্ঠান করা যাবে না, গান গাইতে হলে এসব খুলে ফেলতে হবে। প্রচুর তর্ক করেও সে আমার কপাল থেকে টিপ সরাতে পারেনি।

অনুষ্ঠানটি আগে ধারণ করা হবে, পরে সম্প্রচার করবে। তো আমি ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালাম। হঠাৎ প্যানেল থেকে একজন দৌড়ে এসে বলল, ‘আপা টিপ পরে গান গাওয়া যাবে না উপর থেকে স্যার বলে দিয়েছেন।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন স্যার?’

সে যা বলল তাতে আমার সারা শরীর রাগে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। প্যানেলে প্রযোজক যিনি বসে আছেন তার কিছু করার নেই কারণ তার ঘাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে আর্মির লোকজন। মূলত তারাই এইসব আদেশ দিচ্ছে। এসব শুনে আমি লোকটাকে বললাম, ‘যে টিপ পরতে বারণ করেছে তাকে আসতে বলুন। কারণ আমি এই বিটিভির জন্মলগ্ন থেকে অনুষ্ঠান করি।’

সে এলো এবং প্রচুর বিরক্তি নিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলার চেষ্টা করলো, এই সব টিপ ফিপ পরে অনুষ্ঠান করা যাবে না, গান গাইতে হলে এসব খুলে ফেলতে হবে। প্রচুর তর্ক করেও সে আমার কপাল থেকে টিপ সরাতে পারেনি।

আমি চলে আসছিলাম, তখন সে পেছন থেকে ডাক নিয়ে বলে, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে আপনি টিপ পরেই রেকর্ড করেন পরে দেখা যাবে।’ আমার মোটেও সেদিন গান গাইবার ইচ্ছা ছিল না কিন্তু টিপ পরেই গান গেয়েছিলাম।

এই দেশটা আমাদের অগোচরে পাল্টে যাচ্ছিল অনেক আগে থেকেই। এতটা পাল্টে যাবে, তা ধারণার বাইরে ছিল। ভেবেছি আমরা সবাই বাঙালি, বাঙালি সংস্কৃতিকেই সবাই ধারণ করে। ভুল ভেবেছি। কখন যেন আমাদের অজান্তেই স্বাধীনতার স্বর্ণ শস্যগুলো ইঁদুরের থাবায় চলে গেল বুঝতেও পারলাম না।

আমার কপাল অনেক চওড়া। কে যেন সেদিন ব্যঙ্গ করে বলল, উঠান কপাল। আর এই চওড়া কপালের জন্য অনেক আজেবাজে কথা শুনেছি। স্রষ্টা আমাকে যেভাবে পাঠিয়েছেন, তাতেই আমি খুশি। কপালটা যখন উঠানের মতো তবে সেখানেই তো আলপনা আঁকবো সুন্দর করে সাজাবো।

এই দেশটা আমাদের অগোচরে পাল্টে যাচ্ছিল অনেক আগে থেকেই। এতটা পাল্টে যাবে, তা ধারণার বাইরে ছিল। ভেবেছি আমরা সবাই বাঙালি, বাঙালি সংস্কৃতিকেই সবাই ধারণ করে। ভুল ভেবেছি।

আর এখনতো দরকার না থাকলেও টিপ পরবো। আর হেলাফেলা করা যাবে না। একটাই অনুরোধ সকল বাঙালি মেয়েদের কাছে, যারা টিপ পরেন না তারাও প্রতিবাদ করার জন্য হলেও একবার টিপ পরুন।

খুব অসম্মানিত বোধ করছি পুলিশের এই ঘটনাটি জেনে। সেই দাড়িওয়ালা পুলিশকে যদি জিজ্ঞেস করতে পারতাম, ‘আপনি দাড়ি রেখেছেন কেন?’ কী জবাব দেবে সে? কারণ দাড়ি কোনো ধর্মের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়।

হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ, খুঁজলে সবধর্মেই কমবেশি দাড়িওয়ালা মানুষ পাওয়া যাবে। তারা তাদের ব্যক্তিগত ভাবনা থেকে দাড়ি রেখেছে। তাতে কেউ কি আপত্তি তুলেছে? তুলেনি। তাহলে টিপ নিয়ে কেন আপত্তি?

সব কথার শেষ কথা, টিপ আমি পরবোই, যত বাধা আসুক।

শিমূল ইউসুফ ।। নাট্যজন

Link copied